রাসবিহারী বসু

লেখক
শ্রীমাখনলাল রায়চৌধুরী

১৯১২ সালের ২৩ ডিসেম্বর দিল্লীতে বিপ্লবী বসন্ত বিশ্বাসের দ্বারা বড়োলাট হার্ডিঞ্জের ওপর যে বোমা নিক্ষেপ করা হয় (মূলত এতে তার হস্তী চালকের মৃত্যু হয়, বড়োলাটের পিঠে গভীর ক্ষতেরও সৃষ্টি হয়), তার মূল কারিগর ছিলেন ইনিই৷ একথা বেশ কিছুদিন চাপা থাকলেও তিনিই যে এই বোমা কাণ্ডের নায়ক - তা পুলিশের অগোচরে রইলো না আর৷ তাঁকে ধরার জন্য অনেক টাকা পুরষ্কার স্বরূপ ঘোষিত হল৷ অতঃপর ১৯১৫ সালের জানুয়ারি মাসে সর্বদলীয় বিপ্লবী সম্মেলনের কলকাতা অধিবেশনে স্থির হল যে - ১৯১৫ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি স্বাধীন ভারত ঘোষণা করা হবে৷ সেইদিন এই মহান মানুষটি পশ্চিম ভারতে বিপ্লবের কার্যভার গ্রহণ করেছিলেন৷ বাঙলার ভার ছিলো যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও ডাঃ যাদুগোপালের ওপর৷ সকল কর্মীই প্রস্তুত ছিলো কিন্তু বিদ্রোহ আরম্ভ হবার দুদিন আগে বেনারসে কৃপাল সিংহ ও জববলপুরে বিনায়ক বিশ্বাসঘাতকতা করায় ওনাকে ছদ্মবেশে চন্দননগরে চলে আসতে হয়৷ ভাবনা চিন্তা করে আবার নতুন কর্মপন্থা স্থির করলেন৷ কিন্তু গভীর চিন্তা ভাবনার পর তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে দেশে থেকে আর কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব না, কারণ এতে সময় এবং অর্থ দুইয়েরই অপচয় হবে৷ তাই কর্মকেন্দ্র স্বরূপ তিনি জাপানকেই ঠিক করলেন৷ কিন্তু তাঁর নামে মামলা থাকার দরুন তাঁর নিজস্ব নামে ছাড়পত্র পাওয়া সম্ভব নয়৷ আবার এদিকে একটি দারুন সুযোগ এসে গেল৷ তিনি জানতেন যে সেই সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জাপানে আমন্ত্রিত করা হয়েছিলো৷ তাই তিনি এই আমন্ত্রণের বিষয়কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইলেন৷ এজন্য তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহযাত্রীদের মধ্যে অন্যতম সভ্য রূপে মিঃ পি এন টেগোর ছদ্মনামে পাসপোর্ট তৈরি করালেন এবং জাপান যাত্রার কারণ স্বরূপ বললেন - তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মীয় এবং পথে তাঁর আহার ও বাসস্থানের সম্পূর্ণ বন্দোবস্তের জন্যই তিনি অগ্রগামী দূত হিসেবে চলেছেন৷

তখন ১৯১৫ সালের মে মাস৷ তিনি তখন চন্দননগরে মতিলাল রায়ের অতিথি৷ সেখান থেকে নৌকা করে গোঁসাই ঘাট হয়ে কলকাতা পৌঁছালেন এবং খিদিরপুর থেকে জাহাজ ধরলেন৷ জাহাজে পৌঁছে নিজের কেবিনে না গিয়ে তিনি প্রথমেই জাহাজের ক্যাপ্ঢেনের সাথে দেখা করেন এবং তাঁর নিজের ছাপানো কার্ডে যে পরিচয় ছিলো তা দেখালেন

‘পি এন টেগোর, সেক্রেটারী অব আর এন টেগোর, শান্তিনিকেতন’

এরপর তিনি ভারতভূমি ছেড়ে এগিয়ে চললেন নিশীথ সূর্যের দেশের উদ্দেশ্যে৷ এটাই শেষবারের মতো ভারতভূমি অর্থাৎ নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ৷ এর পর আর নিজের দেশে ফেরেননি তিনি৷ কিন্তু তিনি দেশকে ভোলেননি৷ তাঁর প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিলো দেশপ্রেম, ভারতভূমির প্রতি অগাধ স্নেহ, ভক্তি ও ভালোবাসা৷

যথাসময়ে এই মহান বিপ্লবী সাংহাই বন্দরে পৌঁছালেন, সেখান থেকে কোবে বন্দরে এবং পরে টোকিওতে উপস্থিত হলেন৷ সেখানকার ‘‘ব্ল্যাক ড্রাগন’’ দলের নেতা দার্শনিক মিতসু তোয়ামার আতিথ্য গ্রহণ করলেন তিনি৷ তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেক্রেটারী হিসেবে প্রথমে নিজেকে পরিচয় দিলেও কিছুদিনের মধ্যেই নিজের আসল পরিচয় তোয়ামার কাছে প্রকাশ করলেন - যে তিনিই হলেন সেই ব্যক্তি যিনি দিল্লীতে বড়োলাটের ওপর বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি বাঘাযতীনের সশস্ত্র বিদ্রোহের পরিকল্পনায় সৈন্যবিদ্রোহের ভার গ্রহণ করেছিলেন তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি নিজে দেশত্যাগ করে সুদূর জাপানে এসেছেন শুধু মাত্র একটি লক্ষ্যেই, তা হলো দেশের মুক্তি৷ তিনি শ্রীরাসবিহারী বসু৷