বাঙলার সাংস্কৃতিক অবক্ষয় কোন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, গত ৬ই মার্চ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বসন্ত উৎসব উপলক্ষ্যে আগত কিছু বিকৃত মানসিকতার ছাত্রছাত্রার কার্যকলাপ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল৷
সোস্যাল মিডিয়ার দৌলতে সেই নক্কারজনক ঘটনা আজ আর কারো অজানা নয়৷ সেই সঙ্গে ভাইরাল হয়েছে মালদা সহ কয়েকটি জায়গায় কিছু ছাত্রছাত্রার রবীন্দ্র সঙ্গীতের লাইনকে কদর্য ভাষায় গাওয়ার দৃশ্যটি৷ ছাত্রছাত্রা সকলেই স্কুল ইয়ূনিফর্মে ছিল৷ এই ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তারা অবশ্যই অপরাধী৷ তবে শুধু তাদেরকেই দায়ী করলেই হবে না৷
সাধারণতঃ ওই বয়সের ছেলেমেয়েরা অনুকরণপ্রবন হয়৷ ছাত্রছাত্রাদের এই মানসিকতা বুঝে এই ধরণের অসংস্কৃতি বাঙলায় ভরিয়ে দিচ্ছে একশ্রেণীর সাহিত্য, চলচিত্র প্রভৃতির মাধ্যমে বিনোদন জগতের কুশীলবেরা৷ ইচ্ছাকৃতভাবেই ছাত্রযুব সমাজের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিতে এক ধরণের অশ্লীল অসংস্কৃতির প্রদর্শন করা হচ্ছে৷ সমাজে মানুষের আদিম প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে সুস্থ চিন্তাভাবনা থেকে দূরে রাখাই উদ্দেশ্য৷
বাঙলার ছেলেমেয়েদের কিভাবে কর্মবিমুখ, কিভাবে নৈতিকতাহীন করা যায় সেই চক্রান্ত অহরহ চলছে৷ রবীন্দ্রভারতীর ঘটনা তারই প্রতিফল৷ এটা আকস্মিক বা অনিচ্ছাকৃত কোন ঘটনা নয়৷ বসন্ত উৎসব পালনের দিন যে নক্কারজনক ঘটনা রবীন্দ্রভারতীতে ঘটল --- সংস্কৃতির এই অবক্ষয়ের সূচনা বহুদিন আগে থেকেই৷ বাঙলার সংস্কৃতিকে বিকৃত করার ঘটনা তাই এই প্রথম নয়৷ বর্তমানে বাঙালীর পোশাক-আশাক, খাদ্যাখাদ্য, রীতিনীতি দেখলেই বোঝা যায় তার অবক্ষয়৷
বিভিন্ন সংস্কৃতির আদান-প্রদানে বা মেলবন্ধনে উন্নত সংস্কৃতি আবিষ্কার হতে পারে কিন্তু তা হতে হবে প্রগতিশীল ও উন্নত রুচির পরিচায়ক৷ বাঙালী ব্রিটিশের কাছ থেকে প্যাণ্ট পরিধান শিখেছে, তা নিম্ন রুচির নয়৷ কিন্তু বর্তমানে দেখা যায় আধুনিকতার নামে ছেঁড়া জিনিসকেও পরিধান করা হচ্ছে৷ এটা কি উন্নত সংস্কৃতির পরিচায়ক?
এই রকম বিভিন্ন বিকৃত রুচিকে বাঙালী সংস্কৃতির মধ্যে সূচিকাকরণ করা হচ্ছে অনেক আগে থেকেই৷ আজ যাঁরা প্রতিবাদে সরব হয়েছেন সেদিন তারা কোথায় ছিলেন৷ তাই আজ শুধু ওই ছেলেমেয়েদের দোষ দিলেই চলবে না৷ তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা সব দেখে বুঝে চুপটি করে গুডি গুডি বয় / গার্ল হয়ে বসে থাকবেন, নিজেদের বুদ্ধিকে পুঁজিবাদীদের অর্থের কাছে বিকিয়ে দিয়ে তাদের শোষণের সহায়ক হবেন আর এখন এই অশ্লীলতার দায় ছাত্রছাত্রীরাই বয়ে বেড়াবে তা হতে পারে না৷ আমরা সবাই হিন্দী সাম্রাজ্যবাদের মানস-অর্থনৈতিক শোষণের শিকার৷ প্রথম যখন এই শোষণ শুরু হয়েছিল তখন যদি আজকের প্রতিবাদীরা রুখে দাঁড়াতেন তাহলে আজ রোদ্দুর রায়রা এইভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে বিকৃত করার সাহস পেত না৷ ধিক্কার জানাই এইসব বুদ্ধিজীবীদের ও রোদ্দুর রায়ের মত বিকৃত মানসিকতার দ্বিপদ জীবদের৷
এখনও বাঙলায় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিদ্বৎজন আছেন৷ তাদের কাছে বিনীত অনুরোধ আপনারা গর্জে উঠুন, জনমানসকে সচেতন করুন বাঙলার উন্নত সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে৷ বাঙলার ছাত্র-যুব সমাজকে আপনারা পাশে পাবেন৷
আজ ভারতবর্ষ যে বিশ্বের দরবারে অন্যতম শ্রেষ্ঠ আসনের দাবীদার তার যথার্থ সূচনা কিন্তু বাঙালীর হাত ধরেই হয়েছিল একথা ভুললে চলবে না৷ বাঙলার ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতিই বাঙালীর অহঙ্কার৷ তাই বাঙলার সংস্কৃতিকে বিকৃত করে বাঙালীকে হেয় করার চক্রান্ত অতি সুচতুরভাবে করে যাচ্ছে হিন্দী সাম্রাজ্যবাদীরা৷ রবীন্দ্রভারতীতে তারই কদর্য প্রকাশ আমরা দেখলাম৷ এরপরও বাঙালী যদি মুখবুজে সহ্য করে তবে অচিরেই বাঙলার ভাষা-কৃষ্টি-সংস্কৃতির সঙ্গে বাঙালী জাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে৷
আমি আশা করি ছাত্র-ছাত্রারা এই ধরণের অশ্লীল কাজ আর করবে না৷ দোষ-ত্রুটি মানুষ মাত্রেই হয় কিন্তু নিজেকে সংশোধন করে সঠিক পথে চলা ও অন্যকে সঠিক দিশা দেখানোই মহৎ কাজ৷ ভুল মানুষ মাত্রেই করে কিন্তু ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই সঠিক পথে চলতে হয়৷ রবীন্দ্রভারতীর এই নক্কারজনক ঘটনা সেই শিক্ষাই দিক৷ পরিশেষে মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের রচিত প্রভাত সঙ্গীতের একটি লাইন স্মরণ করে শেষ করছি---
‘‘বাঙালীর ছেলেমেয়েরা বাঙালীর বোধি পসরা
সার্থক হোক হে প্রভু মহতের ভাবে মিশি৷
- Log in to post comments