সামাজিক অবক্ষয় ঃ সমাধানের পথ কী

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

সম্প্রতি আর.জি.করের মর্মান্তিক ঘটনা সমাজে একটা নাড়া দিয়ে ছিল৷ মানুষ হয়তো সজাগ সচেতন হচ্ছে৷  কিন্তু  পেছন থেকে ক্ষমতা হারানো একটি রাজনৈতিক দল দলীয় স্বার্থ সিদ্ধি করতে গিয়ে সেই আন্দোলনকে বিপথে চালিত করে৷

তবে শুধু আর জি.কর নয় দেশজুড়ে চুরি–ছিনতাই, সমাজের ওপরের স্তর থেকে নীচু স্তর পর্যন্ত দুর্নীতি, প্রতারণা, ব্যভিচার – সর্বত্র এই যে অপরাধ প্রবণতা তা শান্তিপ্রিয় সমাজ হিতৈষী মানুষের চরম দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ কীভাবে সমাজের মানুষের এই অপরাধ প্রবণতা রোধ করা যায় এ নিয়ে অনেকে অনেক গবেষণা করছেন – কিন্তু কোনো কিছু স্থির করতে পারছেন না৷ অনেকে জিজ্ঞেস করছেন – এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য কী সেই উত্তর দিতেই এবারের সম্পাদকীয়ের অবতারণা৷

এটা নিঃসন্দেহ যে, সমাজের তৃণমূল স্তরে অর্থাৎ গরীব জনসাধারণের মধ্যে বর্তমানে যে সব চুরি, ছিনতাই, প্রতারণা চলছে – তার বেশীর ভাগটাই অর্থনৈতিক অভাবের কারণে৷ মানুষ যখন তার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী সৎপথে উপার্জন করতে অসমর্থ হচ্ছে, তখন সে অসৎ পথে উপার্জনের উপায় খুঁজছে৷ এইভাবে অভাবের কারণে ছোটখাটো অপরাধ করতে করতে পরে আবার তা স্বভাবেও পরিণত হচ্ছে৷

সমাজে যদি প্রতিটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের গ্যারান্টীর ব্যবস্থা করা হয়, অর্থাৎ প্রতিটি মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় ক্রয়ক্ষমতা অর্জনের ব্যবস্থা করা হয় – তাহলে সমাজের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধ প্রবণতা বন্ধ হয়ে যাবে৷ আইন ও প্রশাসনের চাপ সর্বক্ষেত্রে অবশ্যই রাখতে হবে, তবে এ ক্ষেত্রে আইন ও প্রশাসনের নিয়ম–কানুন মানার দিকে সাধারণ মানুষের ঝোঁক খুবই বৃদ্ধি পাবে৷

দ্বিতীয়তঃ  শিক্ষার অভাব৷ পশু জন্ম থেকেই পশু বৃত্তি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, এগুলো তাকে খুব একটা শেখাতে হয় না৷ কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে জন্ম থেকেই একটা শিশু প্রকৃত মানুষের স্বভাব–চরিত্র পায় না৷ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন– তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশু–পাখী সহজেই পশুপাখী কিন্তু মানুষ প্রাণপণ চেষ্টায় তবে মানুষ৷ তাই মানুষের ক্ষেত্রে শিক্ষার একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে৷ সেই কারণে শিক্ষাকে মানবজাতির মেরুদণ্ড বলা হয়৷ সেই শিক্ষার যদি ত্রুটি থেকে যায় তাহলে তা মানুষের সমাজে প্রতিফলিত হবেই হবে৷ প্রকৃত শিক্ষা বলতে কেবল জীবিকা উপার্জন তথা অর্থ সংগ্রহের  উপায় শিক্ষা নয়, শিক্ষার প্রকৃত অর্থ ‘মানুষ’ হওয়ার শিক্ষা, সমাজ–চেতনা বৃদ্ধির শিক্ষা, সৎ–নীতিবাদী হওয়ার শিক্ষা, জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী, কীভাবে মনুষ্যত্বের যথার্থ বিকাশ হবে – সেই সব শিক্ষা৷ সমাজে এই শিক্ষার খুবই অভাব, তাই সমাজের সর্বস্তরে অপরাধ প্রবণতা এত বৃদ্ধি পাচ্ছে৷

কেননা, মনুষ্যত্বের বিকাশের প্রকৃত শিক্ষা না পেলে মানুষও তো জীব, তাই অন্যান্য জীবের মধ্যেকার যে স্থূল বৃত্তি তা–ই মানুষের মধ্যে প্রকট হয়ে উঠবে৷ মানুষ তখন তার স্থূল ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তির দ্বারাই পরিচালিত হবে৷ নীতি–মনুষ্যত্ব ভুলে কীভাবে সহজে সুখ পাওয়া যাবে, যেন তেন প্রকারেণ কীভবে সুখের সামগ্রী সংগ্রহ করা যাবে, এইটাই তখন মানুষের ধ্যান–জ্ঞান হয়ে যাবে৷ মানুষ তখৱ তার বিবেকের কণ্ঠরোধ করে বুদ্ধির অপব্যবহার করবে৷ সোজা কথা মানুষ তখন সুবুদ্ধি বা শুভবুদ্ধি ছেড়ে কু–বুদ্ধির দ্বারা চালিত হবে৷ তখন তো সমাজে অপরাধ প্রবণতা বাড়তে বাধ্য৷

তৃতীয়তঃ, অতিরিক্ত সঞ্চিত অর্থের অপব্যবহার৷ যে সমস্ত মানুষের হাতে অতিরিক্ত সম্পদ রয়েছে, যা তার প্রকৃত প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি, ওই প্রয়োজনাতিরিক্ত সঞ্চিত অর্থ মানুষকে কু–পথে চলতে প্রলুব্ধ করে৷ এই সমস্ত ধন–কুবেররা চোরাকারবারি, মাদক দ্রব্যের ব্যবসা – এসব করে৷ এরাই অসৎ রাজনৈতিক নেতাদের ভুড়িভুড়ি টাকা দিয়ে নির্বাচনে জেতাতে সাহায্য করে৷ পরে তারা ক্ষমতায় এলে তাদের সাহায্যে অসৎ পথে সম্পদ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করে৷ এরাই সংস্কৃতিকে কলুষিত করে৷ এরা সিনেমার দূরদর্শনের সিরিয়ালে অশ্লীলতা, কুরুচি, নগ্ণতা – এ সবের আমদানি করে দেদার মুনাফা  লুঠতে থাকে৷ কারণ তারা জানে এইসব সিনেমা বা সিরিয়াল বেশী জনপ্রিয় হবে৷ জল যেমন নিম্ন  গামী, সাধারণতঃ মানুষের মনও তাই৷ এই সমস্ত সিনেমা, সিরিয়াল বিশেষ করে যুব সমাজের নৈতিক মেরুদণ্ডকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়৷ তাই মানুষের হাতে প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ থাকাটা সমাজের পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকর৷

চতুর্থতঃ, অতিরিক্ত সঞ্চিত অর্থের মত, প্রকৃত নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষারহিত বুদ্ধিজীবীরাও তাঁদের জ্ঞান–বুদ্ধির অপব্যবহার করে সমাজের অকল্যাণ করেন৷ তাঁরা তাঁদের কু–বুদ্ধি ও  

কু – পরামর্শ দিয়ে শোষক তথা প্রতারক শ্রেণীকে নানান্ভাবে সাহায্য করে’ কু – পথে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করেন৷ সমাজের বিভিন্ন ঘটনাবলীর দিকে তাকালে এ সত্য সহজেই চোখে পড়ে৷

অপরাধ প্রবণতার পঞ্চম কারণ হ’ল, গতিহীনতা (ষ্ট্যাগনেন্সী)৷ মানুষের জীবনের একটা স্বাভাবিক গতি রয়েছে৷ আর গতিটা পূর্ণতার অভিমুখে৷ মানুষ যদি তার মনুষ্যত্বকে পূর্ণতার অভিমুখে পরিচালিত করার প্রয়াস না করে তা হলে জীবন গতিহীন হয়ে পড়ে ও কলুষতা পূর্ণ হয়ে ওঠে৷ তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, যে নদী পথ হারিয়ে সম্মুখ পানে চলতে না পারে, সে নদীকে অজস্র শৈবাল এসে বেঁধে ফেলে, ঠিক তেমনি যে মানবগোষ্ঠী সামনের দিকে এগিয়ে না চলে তাদের জীবন কলুষিত হয়ে পড়ে৷

সামনের দিকে এগিয়ে চলা মানে মনুষ্যত্বের পূর্ণতার পথে এগিয়ে চলা, মনুষ্যত্বের বিকাশই দেবত্ব আর এর পূর্ণতাই ব্রহ্মত্ব৷ মানুষের জীবনই পূর্ণত্বের পানে এগিয়ে চলার জন্যে৷ তা যদি না করে তাহলে জীবনে কলুষতা আসবে৷ তারা কেবল নিজেরাই সমাজের বোঝাই হবে না, তারা সমাজের অগ্রগতিতে বাধাস্বরূপ হয়ে উঠবে৷ তাই যারা প্রকৃত প্রগতির পথের যাত্রী তাদের বাধার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সমাজের অগ্রগতির পথকে বাধামুক্ত করতে হবে৷