সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মাতৃত্ব

লেখক
লীনা দাস

 ‘মা’ এই একাক্ষরী মন্ত্রে জোর অনেক৷ এই মন্ত্র সকলেই বলে মধুক্ষরা৷ মা হতে গেলে বিশেষ বেদনার সাথে অনুভূত হয় এক বিশেষ আবেগ৷ সহ্য করতে হয় অপরিমেয় কষ্ট কিন্তু সন্তান যদি কন্যা হয় তা হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মা হওয়ার আনন্দ নয়, সহ্য করতে হয় পারিবারিক, সামাজিক ও সামগ্রিকভাবে ক্ষেত্র বিশেষে অপরিসীম মানসিক যন্ত্রনা৷

তবু এখানে পাশ্চাত্যের মত পুরুষ জাতির নিপাত কামনা করা হয় না আর্থাৎ এখানে পাশ্চাত্যের মত কট্টর নারীবাদ বা কট্টরভাবে পুরুষ বিরোধিতা সেভাবে নেই৷ তবে ‘প্রাচ্য’ সন্তান যদি পুরুষ হয় তা হলে নিরাপত্তাজনিত কারণে সেই মা ও সন্তানকে বিশেষ মর্যাদা ও স্বীকৃতি দেওয়া হয়৷ এতেই নারী পুরুষের বিভেদ স্পষ্ট হয়৷ অন্যদিকে পরিবার ও বংশের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার কারণে যদি নারী সন্তান ভূমিষ্ট হয় তাহলে মাতা ও কন্যা উভয় নারীই হয় চরম অবহেলার স্বীকার৷ পুত্র সন্তানকে যেমন ভগবানের প্রদত্ত উপহার বা আশীর্বাদ বলে মনে করা হয় তেমনইভাবে কন্যা সন্তানকে এই একবিংশ শতাব্দীতেও ‘পাপ’ বা ‘অভিশাপ’ বলে মনে করা হয়৷

আধুনিক কালে এই সৃজিত লিঙ্গ বৈষম্যের জন্য ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ করা এমনকি গর্ভপাত ঘটানো হয়৷ এইভাবে রক্ষণশীল মতবাদে পাশ্চাত্যের জনগণও মনে করেন-যে শিশু জন্মায় নি সেই ভ্রূণ হত্যা করা অপরাধ নয় কারণ তারা মনে করেন সেই ভ্রূণ একটা মাংসপিন্ড মাত্র তার কোন জীবনবোধ নেই৷ তাই স্বার্থবোধও নেই এবং প্রত্যক্ষিত না হওয়ার পার্থিব জগতের মানবগণের তার সম্বন্ধে কোন বিশেষ অনুভূতি জন্মায় নি৷ প্রাচ্যের জনগনও অন্য দৃষ্টিতে কন্যাকে শুধুমাত্র পারিবারিক সামাজিক দায়দায়িত্ব বলে মনে করেন যা তাদের কাছে তা এক বিরাট ভীতি স্বরূপ৷ তাই কন্যা সন্তানের জীবনের বিশেষ কোন মূল্য ৰা মর্যাদা স্বীকৃত নয়৷ আর সেই মায়ের মানসিক ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোন মর্যাদা দেওয়া হয় না৷ কারণ কন্যাসন্তান কেবলমাত্র মন খারাপের বার্তা বাহিকা হয়েই জন্যায়৷ এই একবিংশ শতাব্দীতেও কথাশিল্পীর ‘‘স্বরাজ সাধনায় নারী’’ প্রবন্ধের ‘‘মেয়ে মানুষকে কেবলমাত্র মেয়ে বলিয়া নয়, মানুষ বলিয়া প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে, সেইখানেই পিতৃত্বের সত্যিকার গৌরব’’ এই উক্তির যথার্থতা আমরা এখনও উপলব্ধি করতে পারিনি৷ আজও আমরা সেভাবে আধুনিক মনস্ক হয়ে উঠতে পারিনি ! প্রাচীনকাল থেকে রামায়ণ, মহাভারত, বেদ, শ্রী গীতা প্রভৃতি গ্রন্থে আমরা নারীকে পরিবারের ও বিশ্ব - সমাজের চালিকা শক্তি হিসেবে দেখতে পাই৷ তাদের গুরুতৃপূর্ণ ভূমিকা ও সাফলোর নজিরও রয়েছে প্রচুর৷ এমনকি আধুনিক কালে রান্নাঘর থেকে পার্লামেন্টে কন্যারা অপরিসীম দক্ষতায় স্বীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িতৃগুলি সফলভাবে পালন করে চলেছে৷ কিছু পাশ্চাত্যের উদারপন্থী মতবাদে বিশেষ বিশেষ কারণে গভপাতকে সমর্থন করা হলেও ভুণ হত্যাকে কখনও সমর্থন করা হয় না৷ এই মতবাদে প্রাচ্যের মতই একটি শিশুকে সবচেয়ে সুন্দর পবিত্র এবং অনাগত ভবিষ্যতের উত্তরাধিকারী বলে বিবেচনা করা হয়৷ তাই নির্র্দেষ ভ্রূণ হত্যাকে এখানে অন্যায় বলা হয়৷ এখানে অনাগতদের জীবনবোধ ও তার প্রতি বিশেষ অনুভূতির সঞ্চারকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়! মা যদি -নিজের শারীরিক বিপদের বা সন্তানের শারীরিক বিপদের সম্ভাবনা দেখতে পান কিংবা দ্বিতীয়বার মা হওয়ার সম্ভবনা কম থাকে বুঝতে পারেন, তবেই তিনি গর্ভপাত করাতে পারেন৷ নিজের ভবিষৎ ও সন্তানের ভবিষৎ জীবনকে সুরক্ষিত করার জন্য বা কর্মজীবনের উন্নতির প্রয়োজনে তিনি গর্ভপাত করাতে পারেন৷ কিংবা এরফলে চাকুরীরতা হলে কার্যক্ষেত্রে যদিকোন বিশেষ কারণে তিনি এমন গ্রামীন পরিবেশে যান যেখানে এই চিকিৎসা পরিষেবার সুযোগ গ্রহন সম্ভব নয় কিংবা বিভ্রাটের সম্ভবনাই বেশি যার ফলে মা ও সন্তান উভয়েরই জীবন সংকট হয় তাহলে তিনি গর্ভপাত করাতে পারেন! সেক্ষেত্রে পাশ্চাত্য সমাজ তার মাতৃত্ববোধের ওপর কোন সংশয় প্রকাশ করবেনা বা তাকে সামাজিক অপরাধী হিসাবে গণ্য করবে না৷ কিছু প্রাচ্যের জীবন যাত্রায় কন্যাগনের এত সাফল্যের পরও তার জন্ম হয় ভাগ্য বিধাতার পরিহাস স্বরূপ৷ জন্ম মুহূর্তে তাকে বলা হয় না সুস্বাগতম৷ সেও পুত্রের মতই মাতৃত্ব পিতৃত্বের সফল স্বীকৃতি এনে দিতে পারে - এই বিশ্বাসের অভাব এখনও রয়েছে প্রাচ্যের পরিবার ও সমাজে৷ কেন রয়েছে সে উত্তর যদি দাবী করা হয় তাহলে পুরুষ শাসিত সমাজ উত্তর দেবে যে কেবলমাত্র বাস্তবিক নিরাপত্তাজনিত কারণে৷ অথচ প্রাচ্যে দৈবী অর্ধনারীশ্বর আদর্শকে যথেষ্ট মান্যতা দেওয়া হয়৷

ভগবৎ প্রদত্ত ক্ষমতায় একজন নারীই কেবলমাত্র গর্ভধারিনী হতে পারেন৷ একজন নারীই একজন পুত্র বা কন্যাকে গর্ভে ধারণ করতে পারেন৷ তাই নিরাপত্তাজনিত কারণে যদি কন্যা ভ্রূণ হত্যা করা হয় তাহলে একদিন পৃথিবী নারীশূন্য হবে সে ক্ষেত্রে ভবিষৎ প্রজন্মের ধারক বাহক হবে কে? অর্থাৎ এক্ষেত্রে মানব সভ্যতা ও সামাজিক প্রগতির সংস্কট উপস্থিত হবে৷ তাই এই সৃজিত লিঙ্গ বৈষম্যের অর্থহীন দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের একান্ত প্রয়োজন৷ সে কারণে যে সকল মায়েদের কন্যা সন্তান আছে ও এমন সকল ভাবী মা যাদের গর্ভে কন্যা ভ্রূণের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে সেই সমস্ত মায়েদের ও অনাগত সন্তানগণকে সহানুভূতি, সমমর্যাদা ও ভালবাসা দিয়ে গ্রহন করা উচিৎ৷ তবেই নারীকে সংসারে প্রকৃত আত্ম-প্রতিষ্ঠা, আত্ম-স্বীকৃতি ও আত্ম-শ্রদ্ধার সাথে তাদের নারীত্ব ও মাতৃত্বকে যথার্থভাবে অভিষিক্ত করা যাবে৷

ঐশ্বরিক ভাবের অনুশীলনে আমরা জানি যে সৃষ্টি ও শক্তি উভয়েই অভেদ ও পারস্পরিকভাবে সত্ত্বাবান৷ এই আদর্শ মেনে নিলে নারী পুরুষের সম মর্যাদার কথা মেনে নিতে হয়৷ তাদের প্রতি অভেদ দৃষ্টির মনোভাব পোষন করতে হবে৷ নয়তো তাদের মধ্যে বিভেদ রেখে নারী শক্তির অমর্যাদা করলে সত্য -শিক্ষা-সংস্কৃতি -কৃষ্টি অর্থাৎ সামাজিক প্রগতির যথার্থ ধারক --- বাহক হওয়া যাবে না৷ তা না হলে সত্যই ধবংস হয়ে যাবে এই সৃষ্টি৷ কারণ তা হবে মানব জাতি ও মানব সভ্যতার সংকট৷ তাই আমরা নারীত্বের অবমাননাকর দিকগুলি সরিয়ে ফেলে তাকে কলুষতা মুক্ত করে তার যথার্থ স্বাধীনতা ও প্রকৃত মর্যাদা প্রদান করব৷ তাকে মনুষ্যত্বে ও দেবত্বে প্রতিষ্ঠিত করব আমরা, তবেই সৃষ্টি সুরক্ষিত ও সুন্দর হবে৷ মাতৃত্ব -পিতৃত্ব পাবে তার যথার্থ সার্থকতা৷ ব্যক্তি জীবনে সত্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি কৃষ্টি অর্থাৎ সামাজিক প্রগতি থাকবে