স্বাধীনতার ভাবনা

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

আগামী ১৫ই আগষ্ট আমরা ভারতবর্ষের ৭২-তম  স্বাধীনতা দিবস পালন করতে চলেছি৷ আজ আমাদের আত্মসমীক্ষা করতে হবে৷ আমরা কী এই স্বাধীনতা দিবসের মর্যাদা রাখতে পেরেছি? বা প্রকৃত অর্থে আমাদের দেশবাসী কতখানি স্বাধীনতা উপভোগ করতে পেরেছে৷

প্রথমে অর্থনৈতিক কষ্টিপাথরে এই স্বাধীনতাকে যাচাই করা যাক৷ অর্থনৈতিক ক্ষেত্র আলোচনা করতে গেলে সমাজের যারা একেবারে নিম্নস্তরে অবস্থান করছে তাদের কথাই চিন্তা করতে হবে৷ কেননা, স্বাধীনতা লাভের পূর্বেও সমাজের কিছু ধনী বা উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মানুষ ছিলেন, অর্থনৈতিক ভাবে তাঁরা স্বচ্ছল ছিলেন৷ আর্থিক অভাবের সম্মুখীন হতে হয়নি তাঁদের৷ তাই তাঁদের অবস্থা এখানে আলোচ্য নয়৷ আলোচ্য তাঁদের কথা, যাঁরা মাঠে মাঠে ফসল ফলায়, যাঁরা কলকারখানায় পরিশ্রম করে আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সামগ্রীর যোগান দেয়৷ আর সবচেয়ে বেশী যেটা চিন্তার, সেটা হ’ল বেকার সমস্যা---অন্যদিক থেকে বলতে হয় কর্মসংস্থানের সমস্যা৷

কৃষিক্ষেত্রে আমরা যতই বড়াই করি না কেন, খাদ্য উৎপাদনের ভারত নাকি উদ্বৃত্ত---এসব বাণী যতই ছড়ানো হোক না কেন, যতই আমাদের দেশের আমরা ও মন্ত্রীরা এ ব্যাপারে পরিসংখ্যান  হাজির করুন না কেন, এই কয়েকদিন আগেই তো ভারতের রাজধানীতেই খাদ্যাভাবে একই পরিবারের তিনটি শিশুর মৃত্যু হ’ল৷ দেশের সর্বত্রই সমাজের একটা স্তরের মানুষের মধ্যে চরম অভাব, ক্ষুধা, বেকারত্ব আজও যে লক্ষণীয় ভাবে রয়েছে সে কি অস্বীকার করা যাবে?

সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের এক মামলার সূত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে আদালতে পেশ করা একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায় এদেশের বছরে গড়ে প্রায় ১২ হাজার চাষী আত্মহত্যা করে৷ কেন তারা আত্মহত্যা করে? ঋণ শোধ করতে না পেরে হতাশ হয়ে তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়৷ তারা তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল পায় না৷ নানান প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে তাদের ফসল ফলাতে হয়৷ প্রাকৃতিক কারণে ফসল নষ্ট হলেও তাদের ফসলের বীমা না থাকায়, তাদের প্রচণ্ড ঋণভারে জর্জরিত হতে হয়৷ শেষ পর্যন্ত আত্মহনন করে৷ অথচ এইভাবে ঝঁুকি নিয়ে চাষ না করলে দেশবাসীর প্রয়োজনীয় খাদ্য ও বস্ত্রাদির উৎপাদনও হবে না৷ দেশবাসীকে তারা খাওয়ায় ও পরায়, কিন্তু তাদের নিজেদের পর্যাপ্ত খাদ্য, বস্ত্র মেলে না৷ স্বাধীনতা দিবসের উৎসবে মেতে থাকে সমাজের ওপরতলাকার মানুষ কিন্তু এই যারা পিলসুজের মত সমাজের প্রদীপটিকে মাথায় তুলে রেখেছে এরা প্রদীপের আলো পায় না, এরা থাকে অন্ধকারে, এদের শরীর বেয়ে গড়িয়ে পরে পোড়া তেল৷ সরকারী চাকুরীতে বা দেশের বড় বড় কিছু কোম্পানীর কাজে যাঁরা কর্মে নিযুক্ত তারা বেশ ভালো বেতন পেলেও দেশের বেশীরভাগ মানুষ যারা নামমাত্র বেতনে অসংঘটিতভাবে বিভিন্ন বে-সরকারী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত বা যারা  একেবারে কর্মহীন বেকার, চরম আর্থিক অনিশ্চিততার মধ্যে দিয়ে তাদের জীবন কাটাতে হচ্ছে৷ বিশেষ করে আমাদের দেশের বেকার সমস্যা যে কত ভয়াবহই, তা বোঝা যায় বিভিন্ন গ্রামে গেলে৷ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে দেখা গেছে গ্রামাঞ্চলের বেশীরভাগ যুবক ছেলে কাজের সন্ধানে ভিন্ন রাজ্যে চলে গেছে, আজকাল  মেয়েরাও কাজের সন্ধানে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে৷ ঠিকা শ্রমিক হিসেবে কোন রকমে তারা জীবিকা নির্বাহ করছে৷ তাদের চাকুরীর কোনও নিশ্চিততাই নেই৷ তাই, চরম হতাশা গ্রাস করেছে আজকের যুবসমাজকে৷

স্বাধীনতার আনন্দ এরা পায় না৷ স্বাধীনতার স্বাদটাই এরা উপলব্ধি করতে পারে না৷

এবার স্বাধীনতা দিবসের পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক এন আর সি ইস্যু নিয়ে দু-চার কথা বলা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক মনে করি৷ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের হাত থেকে ভারতবর্ষ যে স্বাধীনতা লাভ করেছে এর পেছনে মুখ্য ভূমিকা ছিল বাঙালীর৷ বিংশ শতাব্দীর গোড়াতেই ১৯০৫ সালে শ্রীরবিন্দের নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রকৃতপক্ষে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু৷ গোটা বাঙলা সেদিন স্বাধীনতা সংগ্রামে উত্তাল হয়ে উঠেছিল৷ ক্ষুদিরাম প্রফুল্ল চাকী থেকে শুরু করে বিনয়-বাদল-দীনেশ, বাঘা যতীন, মাষ্টারদা সূর্য সেন প্রভৃতি শত শত মহাপ্রাণ স্বাধীনতার বেদীমূলে আত্মোৎসর্গ করেছেন৷  কত মহাপ্রাণ সারা জীবন দ্বীপান্তরের অসহনীয় জ্বালা সয়েছেন৷ পৌরুষের বজ্রকৌস্তুভ নেতাজীর সুভাষচন্দ্র ও তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজের অভূতপূর্ব সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিতকে চরম ভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল৷ আর তারই ফলশ্রুতিতেই দেখা দেয় ব্রিটিশ নৌ-সেনার মধ্যে বিদ্রোহ৷ ৪২-এর আন্দোলনের মূল অনুপ্রেরণাও ছিল নেতাজীর বীরগাথা৷

শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট গান্ধী-নেহেরু গোষ্ঠী ভারত বিভাজনের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভ করে৷ কিন্তু এই মহাযজ্ঞে তৎকালীন নেতারা বলি দিল বাঙলা ও বাঙালী জাতিকে৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে হিন্দী সাম্রাজ্যবাদীরাও বাঙলাকে টুকরো টুকরো করে ছাড়ল৷ বাঙলার বুকের মধ্যিখানে ছুরি বসিয়ে ‘দ্বিজাতিতত্ত্বে’র ভূয়ো যুক্তিতে পশ্চিম বাঙলা ও পূর্ব বাঙলা করা হ’ল৷ বাঙলার উত্তরাংশ গোয়ালপাড়া, শিলচর, লামডিং কাছাড় প্রভৃতি এলাকা সহ বাঙলার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলকে বাঙলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে অসম, মণিপুর ও ত্রিপুরার সঙ্গে সংযুক্ত করে রাখা হ’ল৷ আবার বাঙলার পশ্চিমাংশকে কেটে জুড়ে দেওয়া হ’ল বিহার ও ওড়িশার সঙ্গে৷ পরবর্তীকালে বিহার ভাগ হয়ে তৈরী হয় ঝাড়খণ্ড৷ আর তার ফলশ্রুতিতে সাম্রাজ্যবাদী শোষক চক্রের কূট-কৌশলে অসম, মণিপুর, ত্রিপুরা প্রভৃতি রাজ্যে বিদেশী তক্মা দিয়ে ‘বাঙালী খেদাও’ আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে৷ সম্প্রতি  এন আর সি-র নাম করে প্রায় ৪০ লক্ষ বাঙালীকে অসম থেকে তাড়ানোর চক্রান্ত ক্রিয়াশীল৷

আজ বাঙালীদের মনে সঙ্গতভাবেই প্রশ্ণ উঠছে যে স্বাধীনতার জন্যে বাঙালীরা অকাতরে রক্ত ঢেলে দিয়েছে, সেই বাঙলা ও বাঙালীর এই দূরবস্থা কেন? এর জন্যে কারা দায়ী? কী এর প্রতিকার?