স্বাধীনতার সত্তর বর্ষপূর্তি প্রসঙ্গে কিছু কথা

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট থেকে শুরু করে ২০১৭ সালের ১৫ই আগষ্ট--- ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের সত্তরটি বছর পূর্ণ হল৷  প্রথম স্বাধীনতা প্রাপ্তির   দিনটিতে আমরা অনেকেই জন্ম গ্রহণ করিনি বা শৈশব-কৈশোর অবস্থায় থাকার কারণে স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই রক্তঝরা দিনগুলোর কথা লোক মুখে বা ইতিহাস পুস্তক পাঠের মাধ্যমে বিশদে জানতে পেরেছি৷ কিন্তু অনুভূতি ও মননের ব্যঞ্জনায়  যখন সেই দিনগুলির ছবি মানসপটে ভেসে ওঠে, মহান বিপ্লবী  দেশপ্রেমিকদের আত্মত্যাগ ও দেশ মাতৃকার  শৃঙ্খল মোচনের সংগ্রামে জীবন বিসর্জন দেওয়ার উন্মাদনা তখন আমাদের শিহরিত, রোমাঞ্চিত করে৷ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের অত্যাচার ও নিপীড়নের হাত থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করার জন্য বীরবিপ্লবীদের মরণপণ সংগ্রাম ও আত্মবলিদানের আদর্শ আমাদের আজও অনুপ্রাণিত করে৷ স্বাধীনতার সত্তর বছর পর মনে প্রশ্ণ জাগে,  আমরা কী পেরেছি সেই অমর শহীদদের আত্মাহুতির যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করতে--- দেশের মানুষের দু:খ-দুর্দশার সত্যিকারের সমাধান করতে?

কূটচক্রে অত্যন্ত পারদর্শী ইংরেজ শাসকবর্গ  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আন্তর্র্জতিক কঠিন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে ভারত ত্যাগ করার সময় ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রদানের অছিলায় দ্বিজাতিতত্ত্বের নামে তৎকালীন কতিপয় স্বার্র্থন্বেষী ক্ষমতালোভী নেতৃবর্গের সহায়তায় অখন্ড ভারতকে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়গত ভাবে তিন টুকরো করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি রাষ্ট্রের জন্ম দেয়৷ পূর্ব ও পশ্চিম অংশ যায় পাকিস্তানে আর মধ্যবর্তী অংশ ভারতরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়৷ এই বিভাজনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় পূর্র্বংশের বাংলা ও পশ্চিমাংশের পঞ্জাব৷ দুইদেশের জনগণের স্থানান্তরের সময় হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা বাধে তাতে হাজার হাজার সাধারণ মানুষের রক্তে দুই সীমান্ত লালে লাল হয়ে যায়৷  লক্ষ লক্ষ মানুষ সহায় সম্বলহীন হয়ে ছিন্নমূল  উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়৷  তৎকালীন নেতৃবৃন্দ  এই উদ্বাস্তুদের  সম্পূর্ণ পুনর্বাসন দেওয়ার  প্রতিশ্রুতি দিলেও পরবর্তীকালে  পশ্চিম প্রান্তের পঞ্জাবী  উদ্বাস্তুদের যথোচিত পূনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়েছে, কিন্তু  পূর্ব প্রান্তের বাঙালী উদ্বাস্তুদের পূনর্বাসন ও অন্যান্য সমস্যা সমাধান হয়নি ৷ উদ্বাস্তু বাঙালীরা আজও ছিন্নমূল ভাসমান জনগোষ্ঠী হিসেবে ভারবর্ষের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের আনাচে-কানাচে শোষিত , লাঞ্চিত , নিপীড়িত ও নির্র্যতিত হয়ে চলেছে৷

স্বার্থপর ক্ষমতালোলুপ , অপরিণামদর্শী নেতৃবৃন্দের  অবিমিষ্যকারিতায় দেশ বিভাজনের এই ক্ষত ভারতবাসীর মধ্যে যে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও  স্থায়ী অবিশ্বাসের  দুঃসহ বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে তার কবল থেকে দেশ এই সত্তর বছরেও মুক্ত হতে পারেনি ৷ ভারতবাসীর মধ্যে যে মৈত্রী ও ঐক্যের ঐতিহ্য সূদূর অতীত থেকে  প্রবহমান ছিল--- বিভিন্ন দলীয়-উপদলীয়, গোষ্ঠী-সম্প্রদায়গত তথা ব্যষ্টিগত স্বার্থ সংঘাতে তা ব্যাহত হয়ে চলেছে৷  ফলে স্বজন-পোষণ, গোষ্ঠী তোষণ ও মেরুকরণ ইত্যাদি সামগ্রিক ঐক্য বিনষ্টকারী প্রক্রিয়া উৎসাহিত হচ্ছে ও ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থা এক চরম সংকটের সম্মুখীন৷  সমগ্র দেশ বিভিন্ন জাত -পাত, গোষ্ঠী-সম্প্রদায়, দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে  জাতীয় ঐক্যের মূল সুর থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন৷ এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্যের নেতৃবৃন্দের মধ্যে যে সুষ্ঠু সমন্বয়  ও সৌহার্দ্য থাকা উচিত, তার অভাবে আভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা ও সন্তুলনের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে৷ শুধু তাই নয়, বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের সীমানা পুনর্ঘটনের সময় অন্যায়, অনৈতিক ও অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণের ফলে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে৷ এই প্রক্রিয়ায়  সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাঙালীর বাসভূমি হিসেবে চিহ্ণিত পশ্চিমবঙ্গ৷ বৃহৎ বাঙালী জনগোষ্ঠীকে টুকরো টুকরো করে অসম, ত্রিপুরা , বিহার, ওড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ, পরবর্তীকালে ঝাড়খন্ড ইত্যাদি রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করার ফলে বাঙলা ভাষা ও বাঙালীর জাতিসত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ বিভিন্ন প্রদেশে অবস্থিত বাঙালী জনগোষ্ঠীকে সেই প্রদেশের ভাষা ও সংসৃকতি গ্রহণ করতে বাধ্য করা হচ্ছে৷  ফলে  বাঙলা ভাষা ও বাঙালী সামগ্রিকভাবে অবদমিত হয়ে চলেছে৷ সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামলা বাঙলার খনিজ সম্পদ , উর্বর ভূমি, মেধাসম্পদ সমস্ত কিছুকে খন্ড বিখন্ড করে শোষণের জাঁতাকলে ফেলে বাঙালী জাতি সত্তাকে ধবংস করার সুপরিকল্পিত  চক্রান্ত চলেছে আজও৷ কেড়ে নেওয়া হয়েছে বাঙালীর স্বভূমি, স্ব-ভাষা ও স্বাধিকার৷ ফলতঃ বিভিন্ন প্রদেশ ও সামগ্রিকভাবে সারা দেশেই এক বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে যা আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সুরক্ষা ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিপজ্জনক৷

কেন্দ্রীয়স্তরে ও রাজ্যস্তরে বিভিন্ন দলীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে সুসমন্বয় না থাকায় পারস্পরিক বৈরীভাবের সৃষ্টি হচ্ছে৷ ফলে সমগ্র দেশে প্রকৃত উন্নয়ন সংঘটিত হচ্ছে না ও আঞ্চলিক বৈষম্য, অসন্তোষ তথা  ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে৷ আর মানুষে মানুষে, সম্প্রদায়ে  সম্প্রদায়ে , গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে বিদ্বেষ ও বিভাজন ক্রমবর্ধমান৷ স্বাধীনতার সত্তর বছর পার করেও সমগ্র দেশ বাসীর জন্য নূ্যনতম প্রয়োজনীয় অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান  -শিক্ষা-চিকিৎসার সুব্যবস্থা সুদূর পরাহত, জনগণের বৃহদংশ অনাহারে-অর্র্ধহারে ক্ষুধার জ্বালায় জর্জরিত, শিক্ষার অভাবে মানুষ কুসংস্কার-ভাবজড়তার অন্ধকূপে নিমজ্জিত, সুচিকিৎসা ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত৷

স্বাধীনতা লাভের পর দেশীয় শাসকবর্গের যে বুদ্ধিমত্তা,  সমাজ সচেতনতা, সেবাধর্মী মানসিকতা ও সঠিক অর্থনৈতিক তথা পরিকাঠামোগত পরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল, তার অভাবে অথবা ইচ্ছাকৃত আন্তরিকতার অভাবে সত্তর বছর পরেও দেশের অগ্রগতি আশানুরূপ হয়নি৷ ভারতবর্ষের মতো বিশাল দেশে সঠিক প্রয়োজনকে অনুধাবন না করে ইংরেজদের প্রদর্শিত  গতানুগতিক পথে চলার ফলেই ধনীরা ক্রমশঃ স্ফীতোদর হয়ে সম্পদের বিস্তার ঘটিয়েছে আর সাধারণ মানুষ দিনের পর দিন বিভিন্ন সমস্যার অগ্ণিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েছে৷ দেশের ৯০ শতাংশ সম্পদ মুষ্টিমেয় ধনীর কুক্ষিগত আর তাদের অঙ্গুলিহেলনেই শাসনব্যবস্থা পরিচালিত৷ সাধারণ মানুষ যে তিমিরে সেই তিমিরেই নিমজ্জিত থেকে শোষিত, বঞ্চিত ও উপেক্ষিত ৷ তাই আজ স্বাধীনতার সত্তর বছর পরেও দেশে কোটি কোটি বেকার, অন্নবস্ত্রের চিন্তায় মানুষ দিশেহারা, চিকিৎসার অভাবে ৭ দিনে ১০০ এর বেশি শিশু মৃত্যুবরণ করে, সুসংহত পরিকল্পনার অভাবে কৃষি-শিল্পের সুষমবিকাশ উপেক্ষিত, প্রকৃতির রোষের মুখে  লক্ষ লক্ষ মানুষ অসহায় অবস্থার শিকার ৷ পরিকাঠামোর সঠিক উন্নয়ন না হওয়ায় আজও সমগ্র দেশবাসীর জন্য বাসস্থান, বিদ্যুৎ ও জীবিকার সংস্থান করা সম্ভব হয়নি৷ অথচ কালোবাজারি, ফাটকাবাজি, ও মুনাফাখোরদের রমরমা--- তাদের জগতে হাওয়ায় টাকা ওড়ে , ভোগবিলাসের হরেকরকম আয়োজন৷ তাদের সন্তানেরা লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে দেশবিদেশের  নামীদামী বিদ্যায়তনে শিক্ষালাভ করে, চিকিৎসার জন্য রয়েছে ব্যয়বহুল আধুনিক বিজ্ঞান সমুন্নত হাসপাতাল, নার্সিংহোম৷  অপরপক্ষে সাধারণ মানুষের জন্য রয়েছে পুতিগন্ধময় সরকারী চিকিৎসালয়ের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ , মিড-ডে-মিল সমৃদ্ধ শিক্ষায়তন যেখানে শিক্ষক আছে তো ছাত্র নেই, আবার কোথাও ছাত্র আছে তো শিক্ষক অপ্রতুল৷ সমাজের বৃহদংশ আর্থিক ও অন্যান্য বৈষম্যের শিকার হওয়ার ফলে সমাজে দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন দুষ্কর্ম, খুন-জখম , হিংসা ও অসামাজিক কারবার৷ ভোট সর্বস্ব রাজনীতির অঙ্কে দেশের নেতাগণ দলীয় ও ব্যষ্টিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য সমস্ত রকম অনৈতিক ক্রিয়াকর্মকে উৎসাহ প্রদান করছেন, ভন্ড-ভেকধারী-দুর্নীতি পরায়ণ গুরু-বাবাজীদের চরণতলে নিজেদের সমর্পণ করছেন আর প্রশাসন হয়ে পড়ছে নিজীর্ব ও নিষ্ক্রিয়৷ এর প্রভাবে সমগ্র সমাজব্যবস্থায় সুস্থিতি তথা ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে৷ ঐক্য ও মিলনের ঐতিহ্যমন্ডিত দেশ এই ভারতবর্ষ বহুবিধ বৈষম্য, বিদ্বেষ ও বিভাজনের দুষ্টচক্রে ক্রমশ আভ্যন্তরীণ দিক দিয়ে  দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে চেলেছে যা সামগ্রিক সুরক্ষার ক্ষেত্রেও অতীব দুঃশ্চিন্তার বিষয়৷

সৃষ্টিলগ্ণ থেকেই ভারতের প্রতি শত্রু মনোভাবাপন্ন ও এই সত্তর বছর ধরেই কখনো প্রত্যক্ষ আবার বেশিরভাগ সময় পরোক্ষে জঙ্গী ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে ভারতের ক্ষতিসাধন করে চলেছে৷ অপর প্রতিবেশী রাষ্ট্র শক্তিশালী চীন স্বাধীন ভারতের জন্মলগ্ণ থেকেই আগ্রাসী ভূমিকা পালন করে চলেছে৷ চীন তার শক্তি প্রদর্শন করে ভারতের বিস্তীর্ণ অংশ  নিজের কবজায় রেখেছে--- এছাড়া অরুণাচলপ্রদেশ, লাদাখ ও সিকিম-ভুটান সীমান্তে অশান্তির পরিবেশ জারি রেখেছে৷ অতি সাম্রতিক কিছু ঘটনাপ্রবাহে প্রায় যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল৷ সিকিম-ভূটান সীমান্তে ডোকালাম অঞ্চল এখনো পুরোপুরি শান্ত হয়নি ৷ নেপাল ও ভূটান বন্ধুভাবাপন্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্র হলেও চীন ও পাকিস্তানের উস্কানিতে তাদের সঙ্গে আগের সেই বন্ধুত্বের উষ্ণতা অনেকটাই স্তিমিত ৷ নেপালের মানুষজন ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ বিশেষতঃ পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, ডুয়ার্স, তরাই অঞ্চলে অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে৷ তারা দার্জিলিং  ও সন্নিহিত অঞ্চলকে  গোর্র্খল্যান্ড নামে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করবার এক ঘৃন্য চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে৷ এই উদ্দেশ্যে দার্জিলিংয়ে ভয়ঙ্কর হিংসাত্মক  ও ধবংসাত্মক অশান্ত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে--- বহু সরকারী সম্পত্তি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নষ্ট করা হয়েছে, শিক্ষা, পর্যটন, চা শিল্প প্রায় ধবংসের মুখে, পাহাড়ের শান্তিকামী জনগণ সন্ত্রস্ত ও বিভ্রান্ত৷ ভারতের সক্রিয় সহযোগিতায় বাংলাদেশ সৃষ্টি হলেও সেখানকার পাকিস্তানপন্থী জঙ্গীগোষ্ঠীগুলি ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও সুস্থিতি নষ্ট করবার চক্রান্তে সামিল হয়েছে৷ সুতরাং বর্হিশত্রুর দিক থেকেও ভারতের সুরক্ষা এক বিরাট বিষম পরিস্থিতির সম্মুখীন৷  এমতাবস্থায় একমাত্র সমগ্র ভারতবাসীর সার্বিক ঐক্য ও সংহতিই ভারতের স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে পারে৷ স্বাধীনতার সত্তর বছরে ভাবতকে অর্থানৈতিক ও ভৌগোলিক দিক থেকে স্বাধীন ও অখন্ড রাখাটাই একটি চ্যালেঞ্জের বিষয়---তা দেশের সমস্ত নেতৃবৃন্দ ও আপামর জনগণকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে ও জাতীয় ঐক্য অটুুট রাখতে হবে৷ 

স্বাধীনতা লাভের পর দেশকে সর্র্বত্মক উন্নতির পথে পরিচালিত করার জন্য নেতৃবৃন্দ তথা দেশীয় শাসকগোষ্ঠীর যে আত্মত্যাগ , সেবাপরায়ণতা ,নৈতিকতা , আঞ্চলিকতাবাদের দোষমুক্ত সুষমদৃষ্টি ও সঠিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল---তার অভাবে সমগ্র দেশে উন্নয়ন ও স্বাধীনতার সুফল ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি৷  পরিবর্তে বিভিন্ন রকমের সংরক্ষণ, ধর্ম-বর্ণ-জাত-পাতের বিভাজন ইত্যাদির মাধ্যমে ক্রমে ক্রমে দেশবাসীকে বহুধা বিভক্ত করা হয়েছে৷ ভারতের অর্থনীতিকে মিশ্র অর্থনীতি নামে অভিহিত করলেও এর মূল চালিকাশক্তি পঁুজিবাদী ধণতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার মধ্যে নিহিত ৷ ফলে পঁুজিবাদের মুনাফাসর্বস্ব  অর্থনীতির সব দোষ ত্রুটিই ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় পরিলক্ষিত ও পরিপুষ্ট ৷ এই কারণেই ব্যষ্টিগত সম্পদ বৃদ্ধির জন্য নৈতিকতার অবমূল্যায়ণ , দুর্বৃত্তায়ণ ও দেশবাসীর মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ক্রমশঃ প্রকটতর হয়েছে৷ বিত্তবান হয়েছে আরও বিত্তশালী ও দরিদ্র হয়েছে দরিদ্রতর৷ ব্যষ্টিগত স্তরে সম্পদ সঞ্চয়ের ফলে অবশিষ্ট জনগণ হয়েছে  শোষিত ও বঞ্চিত৷ এছাড়া তথাকথিত সাম্যবাদ বা কম্যুনিজমও  এই সমস্যার গভীরে পৌঁছতে পারেনি৷ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়ণের মাধ্যমে জনগণের মানবিক মূল্যবোধের কন্ঠরোধ করা হয়েছে৷ সুতরাং কম্যুনিস্ট শাসন ব্যবস্থার দ্বারাও  সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়নি৷ বরং পঁুজিবাদ মানুষকে দরিদ্র করেছে আর কম্যুনিজম মানুষের মানবিকসত্তাকে ধবংস করে পশুত্বের পর্র্যয়ে নামিয়ে এনেছে ৷ তাই মানুষের তথা দেশের সার্বিক কল্যাণে প্রয়োজন নতুন জীবনাদর্শ ও অর্থনৈতিক দর্শন৷

ভারতবর্ষ সুপ্রাচীনকাল থেকেই  আধ্যাত্মিক আদর্শে সমুন্নত দেশ  হিসেবে পরিগণিত৷ বহু মুনি-ঋষি-মহাপুরুষের চরণস্পর্শে পবিত্র এই দেশের মাটি৷ তাঁদের পথ নির্দেশনায় ভারতের মানুষ আধ্যাত্মিকতা, নৈতিকতা, সেবাপরায়ণতা ও আত্মত্যাগের ব্রতে মহিমান্বিত৷ বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে  বহু মানুষ বিভিন্ন সময়ে ভারতের এই মহান আদর্শের আকর্ষণে ছুটে এসেছেন ও এই আদর্শকে নিজেদের জীবনচর্র্যর অঙ্গীভূত করেছেন৷ ভারতবাসীও মহামিলনের মন্ত্রে সকলকে আপন করে নিয়েছে৷ এই মহাপুরুষেরা শিখিয়েছেন--- পৃথিবীর জাগতিক সম্পদ সীমিত  কিন্তু মানুষের চাহিদা অনন্ত, অসীম৷ তাই সীমিত ভৌতিক সম্পদ মানুষের অনন্ত চাহিদাকে পরিতৃপ্ত করতে পারে না৷ সেই কারণে ভৌতিক সম্পদ  বন্টনে সামঞ্জস্য বিধান করে মানুষের জাগতিক প্রয়োজনগুলিকে মিটিয়ে  অনন্ত চাহিদাকে অসীম মানসিক তথা আধ্যাত্মিক সম্পদের প্রতি প্রধাবিত করতে হবে৷ অনন্ত আধ্যাত্মিক সম্পদই পারে মানুষের অনন্ত চাহিদাকে তৃপ্ত করে শান্ত ও সন্তুলিত রাখতে৷  ভারতবর্ষের মনীষীগণ এই সত্য নিজেদের জীবনে উপলদ্ধি ক’রে মানুষকে সেই শিক্ষা ও পথনির্দেশনা দিয়েছেন আর তারই ফলশ্রুতিতে ভারতবর্ষ শান্তি, সম্প্রীতি, উন্নতি ও মৈত্রীর দেশ হিসেবে সমাদৃত৷

ভারতীয় সংসৃকতির এই ঐতিহ্য ও মানবমনের অনন্ত চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার  এক যুগান্তকারী অর্থনৈতিক দর্শন - ‘প্রাউট’ (প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব) প্রবর্ত্তন করেছেন যা শুধুমাত্র ভারতবর্ষই নয়,  সমগ্র বিশ্বচরাচরে সকল মানুষের জন্যই  প্রযোজ্য৷ প্রাউট দর্শন অনুযায়ী বিশ্বের কোনো সম্পদই কোন ব্যষ্টির একার সম্পত্তি নয়- বিশ্বের সকল মানুষের যৌথ সম্পত্তি---এতে রয়েছে সকলের সমানাধিকার৷ তাই সামবায়িক সংস্থার সুস্পষ্ট অনুমোদন ছাড়া ব্যষ্টিগত পর্র্যয়ে কেউ জাগতিক সম্পদ সঞ্চয় করতে পারবে না---সমগ্র ভৌতিক-আধিভৌতিক , আধি দৈবিক, আধ্যাত্মিক সম্পদের  সর্র্বধিক উপযোগ গ্রহণ করতে হবে ও সকলের মধ্যে সুসামঞ্জস্যপূর্ণভাব্ বন্টন করতে হবে৷ আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের অনন্ত চাওয়াকে অনন্ত আধ্যাত্মিক জগতে পরিচালিত করে নীতিবাদের আশ্রয়ে জাগতিক সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে হবে যাতে প্রতিটি মানুষ-জীব-জড় সকলেই জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়ার সমান সুযোগ পায়৷ বিশ্বের সমস্ত কৃষিসম্পদ, ভূসম্পদ, বনজ সম্পদ,খনিজসম্পদ, জল সম্পদকে সর্র্বধুনিক বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তির ব্যবহারের দ্বারা সামবায়িক ব্যবস্থায় সকলের কল্যাণে নিয়োজিত করতে হবে যেন সকলের ক্রয় ক্ষমতা ও বিনিময় ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ও বেঁচে থাকার  নূ্যনতম প্রয়োজনগুলি, যেমন-অন্ন,বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, সহজলভ্য হয়৷ কেউ যেন ব্যষ্টিগতভাবে কোন সম্পদকে কুক্ষিগত করে সমাজে শোষণ না চালাতে পারে ---সে বিষয়ে সকলকে সদা সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে৷ সমাজের নেতৃত্বে থাকবেন  আধ্যাত্মিকতা সমুন্নত, নৈতিক ও চারিত্রিক বলে বলীয়ান, স্বার্থত্যাগে সদা প্রস্তুত, সেবাব্রতের আদর্শে উদ্বুদ্ধ ব্যষ্টিগণ যাঁদের এক কথায় বলা হয় ‘সদ্বিপ্র’৷ তারা হবেন আপোষহীন, কঠোরনীতিবাদী ও যমনিয়মে প্রতিষ্ঠিত৷ তাঁদের নেতৃত্বে যে সমাজ গঠিত হবে সেখানে থাকবে না কোন স্বজন পোষণ ও শোষণ-তোষণ৷  এই ব্যবস্থা শুধুমাত্র ভারতবর্ষই নয় সমগ্র বিশ্বের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ও কল্যাণপ্রদ৷  একমাত্র সদ্বিপ্রের পরিচালনায় শোষণহীন মানবসমাজ গড়ে তুলতে পারলেই স্বাধীনতা সংগ্রামের বেদীমূলে উৎসর্গীকৃত-প্রাণ বীর বিপ্লবীদের প্রতি প্রকৃত সন্মান প্রদর্শন সার্থক হবে--- এছাড়া দ্বিতীয় পথ নেই৷