তুলসীর পরিচয় ও প্রজাতি ঃ বিশ্বে এক শতাধিক প্রজাতির তুলসী বা চ্ত্রব্দন্প্ত বর্গীয় গাছ রয়েছে৷ তুলসী জন্মায় আইবেরিয়ায় (স্পেন ও পর্তুগাল) সবচেয়ে বেশী৷ ৰাঙ্গালীস্তানের মাটি, জল, আবহাওয়া তুলসীর পক্ষে খুবই উপযোগী৷ শুধু ৰাঙ্গালীস্তান নয়, সমগ্র ভারতের প্রতি গৃহেই তুলসীর গাছ রাখার বিধি, এর ঔষধীয় গুণের কথা ভেবেই৷ সমগ্র তুলসী বর্গীয় গাছের একটা নিজস্ব বর্ণ–গন্ধ আছে৷ যদিও সকল রকম স্বভাবের তুলসীর ৰীজ অনেকটা এক ধরনের ও তুলসী বর্গের মূল গন্ধ সবাইতে আছে, তবুও সবাইকারই স্বকীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে নিজস্ব গন্ধও আছে৷ যে কয়েক প্রজাতির তুলসী ৰাংলার একেবারে স্থানীয় অর্থাৎ ব্যাঞ্জালাইটিস বর্গীয়, তাদের মধ্যে রাধাতুলসী ও বাবুইতুলসী অন্যতম৷ কৃষ্ণতুলসী এসেছে উত্তর ভারত থেকে৷ যে তুলসীর পাতা সবুজ ও একটু বড় আকারের কিন্তু গাছও খুব ৰড় হয় না, তাকে রাধাতুলসী বলে৷ রাধাতুলসী মুখ্যতঃ দু’টি প্রজাতির হয়, তাদের গন্ধেরও তারতম্য আছে৷ পাতার আকার প্রকারেও অল্পসল্প ভেদ আছে৷ একটি প্রজাতির পাতার রঙ ফিকে সবুজ গন্ধ একটু বেশী ও মৃদু ধরনের৷ আর একটি প্রজাতির পাতা আরও ফিকে সবুজ –বলতে পারি সাদাটে সবুজ, তার গন্ধ একটু কম৷ কৃষ্ণতুলসী গাছের আকার রাধাতুলসীর চেয়ে অনেক ৰড়৷ আমি বিহারে একটি ধার্মিক পরিবারের বাড়ীর বাগানে প্রায় দুই মানুষ উঁচু কৃষ্ণতুলসীর গাছ দেখেছি৷ বিশ্বে সব প্রজাতির তুলসীর মধ্যে এরই আকার সব চেয়ে ৰড় হয়৷ গাছ ও ঝাড় রাধা তুলসীর চেয়ে অনেক বেশী৷ পাতা কালচে সবুজ৷ পাতা কখনও মাঝারি ধরনের, কখনও বা কিছুটা ছোট৷ তাতে কালো দাগ রয়েছে৷ বাবুই তুলসীর গন্ধের সঙ্গে অল্প–স্বল্প রক্ত চন্দনের গন্ধের মিল আছে৷ চন্দন তুলসীর গন্ধ অত্যন্ত ঝাঁঝালো যেন ঙ্মচন্দন ওৰ তুলসীর গন্ধের সঙ্গে নাগদোনার ঝাঁঝ মিশে রয়েছে৷ রামতুলসী কালচে রঙেরও হয়, লালচে রঙেরও হয়৷ লালচেগুলি বেশী খরখরে৷ তাই এর পাতার স্পর্শ মোটেই আরামদায়ক নয়৷ গন্ধ খারাপ না হলেও ভাল নয়৷ স্বাদও তেমন ভাল নয়৷ রাবণ তুলসীরও পৃথক বৈশিষ্ট্য রয়েছে৷ ঙ্মরাবণ তুলসীকে কেউ কেউ বলবান তুলসীও ৰলেন৷ এছাড়া আর এক প্রকার তুলসী আছে যার নাম কর্পূর তুলসী৷ এর রসের নির্যাস থেকে কর্পূর পাওয়া যেতে পারে.....কর্পূরের নিজস্ব গাছ তো আছেই৷ৰ
তুলসীর গুণাগুণ ঃ ৰাংলার গ্রামে রাধাতুলসী যতটা জনপ্রিয়, বাবুই তুলসী বা কৃষ্ণতুলসী ততটা জনপ্রিয় নয়৷ সব তুলসীর ঔষধীয় গুণ প্রচুর৷ তবে ঔষধীয় গুণে সবার সেরা রাধাতুলসী, তারপর বাবুইতুলসী, তারপরে চন্দন তুলসী, তারপরে কৃষ্ণতুলসী৷ রাধাতুলসী মানুষের বয়স যত কম থাকে তার ওপরে তত বেশী প্রভাব বিস্তার করে৷ যত বয়স ৰাড়ে রাধাতুলসীর ঔষধীয় প্রভাব তার তুলনায় তত কম হয়৷ মানুষের বয়স যত বেশী হবে কৃষ্ণতুলসীর ঔষধীয় গুণের প্রভাব তত বেশী কাজে লাগবে৷ আর বয়স যত কমতে থাকবে ঔষধীয় গুণের প্রভাব তত কমতে থাকবে ঙ্ম দ্রব্যগুণের ভিত্তিতে চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোন বিশেষ রোগে যে প্রকার তুলসী বেশী কার্যকরী, তা না পাওয়া গেলে অন্য প্রকার তুলসী ব্যবহার করলে তত ফল না হলেও অনেকখানি ফল পাওয়া যায়ৰ৷
শিশুদের রোগে রাধাতুলসী ঃ প্রায় পঁচিশ প্রকার শিশু রোগের ঔষধ হচ্ছে এই তুলসী৷ সাধারণভাবে শিশুদের সর্দিজ্বরে ও সর্দিতে মধু সহ রাধা তুলসীর রস বিশেষ কার্যকরী৷ আতুরে শিশুর অসুখ (সর্দি–কাশি) হলে মধু সহ রাধাতুলসী (পাতার রস) খুব কার্যকরী হয়ে থাকে৷
তরুণ বয়সের রোগে রাধাতুলসী ঃ তরুণ বয়সের কয়েকটি ব্যাধির আশ্চর্যজনক ওষুধ হচ্ছে তুলসী, বিশেষ করে রাধাতুলসী৷ ১৬ থেকে ২৪ বৎসর বয়সের ছেলেদের অতি মাত্রায় শুক্রক্ষয়ে এক কনিষ্ঠাঙ্গুলি পরিমাণ রাধাতুলসীর মূল (আসল মূল বা শাখা মূল দুই–ই চলতে পারে অভাবে কৃষ্ণতুলসীর মূল) ছাঁচি পানের সঙ্গে (ৰোঁটা বাদে) খালি পেটে চিবিয়ে খেলে ঔষধটি চমৎকার কাজ দেয়৷ রোগের ৰাড়াৰাড়ি অবস্থায় প্রত্যহ সেবন করতে হয়৷ রোগ সেরে যাবার পরেও চারটি রবিবার ভোরে উঠে খেতে হয়৷
হাঁপানি রোগে বাবুই তুলসী ঃ বাবুই তুলসীর রস শ্বাসরোগের ঔষধ৷ বাবুই তুলসীর গাছে এক ধরনের ছোট পোকা বাসা ৰাঁধে৷ বাসা সমেত ঐ পোকাটি লাল সুতোয় ৰেঁধে পুরুষ দক্ষিণ হস্তে ও নারী বাম হস্তে ধারণ করলে হাঁপানি কষ্টের উপশম হয়৷ যাদের মাতৃকুলে হাঁপানি রোগ আছে তাদের হাঁপানি রোগের সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে৷ প্রাচীন কালের লোকের ধারণা ছিলো হাঁপানি রোগটি মাতৃকুল থেকেই আসে৷ যাই হোক যাদের মাতৃকুলে হাঁপানি রোগ আছে তাদের যদি পাঁচ থেকে পনের বছরের মধ্যে কখনও কোন ধরনের শ্বাসরোগের বা শ্বাসকষ্টের লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে ওই শিশু (বা বালক) প্রতি শনিবার খালি পেটে ভোরে এক চামচ বাবুই তুলসীর রস (পাতার রস, গাছের রস নয়) পান করলে তাই থেকে মাতৃকুল সঞ্জাত হাঁপানি রোগের পুনরুদয়ের সম্ভাবনা থাকে না৷
জ্বর রোগ ও যক্ষ্মায় চন্দন তুলসী ঃ যক্ষ্মা রোগের প্রাথমিক অবস্থাতে চন্দন তুলসী চমৎকার কাজ দেয়৷ ঘুসঘুসে জ্বরেও চন্দন তুলসীর বটিকা মধু সহ বিশেষ ফলপ্রদ৷ দীর্ঘকালীন জ্বর রোগ যা কোন অবস্থাতে ছাড়তে চায় না, অল্প সৈন্ধব লবণ সহ একত্রে দুই বটিকা চন্দন তুলসী মেড়ে খেলে ওই রোগ সেরে যায়৷ চন্দন তুলসী স্নায়ু রোগেও ঔষধের কাজ করে৷ চন্দন তুলসী অত্যন্ত ঝাঁঝালো ভেষজ৷ শিশুর স্নায়ু রোগে এ মন্ত্রবৎ কাজ করে ঙ্মপাতার রসৰ৷
বিষক্রিয়া ও কৃষ্ণ তুলসী ঃ বিষক্রিয়া নাশনের গুণ কৃষ্ণতুলসীর মধ্যে মুখ্যভাবে রয়েছে৷ অন্যান্য তুলসীতে এই গুণ গৌণভাবে রয়েছে৷
রাম তুলসী ঃ রাম তুলসীরও যথেষ্ট ঔষধীয় গুণ আছে৷
তুলসীর অন্যান্য ব্যবহার ও উপকার ঃ শাদাটে ধরনের রাধাতুলসী থেকে যে কাঠ পাওয়া যায় তা থেকে তুলসীর মালা তৈরী হয় ও কন্ঠী হিসেবে কোন কোন সম্প্রদায়ের দ্বারা ব্যবহূত হয়৷ প্রাচীন ৰাংলায় বাবুই তুলসীর কাঠ থেকে নানান ধরনের ছোট ছোট পণ্যও তৈরী করা হতো৷ তুলসী যেহেতু একটি সুগন্ধি উদ্ভিদ তাই এর থেকে নানান ধরনের এসেন্স তৈরি হতে পারে৷ তুলসীর হাওয়া খুবই স্বাস্থ্যপ্রদ৷ দু’বেলা বিশেষ করে সন্ধ্যাবেলায় এর বেদীতে প্রদীপ জ্বালার রীতি ৰাংলা ও ভারতে প্রচলিত৷ ঙ্ম এই রীতির মাধ্যমে ৰ অন্য কোন পুণ্য না হলেও এর কাছ দিয়ে দু’বেলা যাওয়া আসা করলে এর হাওয়া শরীরের উপকার করে৷ তুলসীর ওপরে সূর্য ও চন্দ্রের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়৷ পূর্ণিমা রাত্রে তুলসীর ওপর চন্দ্রালোকের প্রভাব বেশী পরিলক্ষিত হয়৷
মউমাছি ও মধু
ভারতে সাধারণতঃ তিন ধরনের মউমাছি দেখা যায়– রক্–ৰী, ৰুশ–ৰী ও এপিস ইণ্ডিকা৷ রক–ৰী ৰড় জাতের মউমাছি, মধু প্রস্তুত করে প্রচুর পরিমাণে৷ চাক ৰড় ৰড়, সাধারণতঃ বটগাছে বা ৰড় ৰড় গাছের ডালে চাক ৰাধে৷ অনেক সময় চাক এত ৰড় হয় যে চাক ফেটে টস্ টস্ করে মধু মাটির ওপরে পড়তে থাকে৷ রক–ৰীর দ্বারা তৈরী মধু একটু ঝাঁঝাল হয়৷ এই মধু উগ্রবীর্য নামে খ্যাত৷ মানুষের প্রাণশক্তি যেখানে কমে এসেছে –মৃত্যুর হিমশীতলতা যেখানে তার অবসন্ন দেহে নেবে এসেছে, অনেক সময় সেই অবস্থায় এই উগ্রবীর্য মধু নোতুন করে প্রাণসঞ্চার করে দেয়৷ প্রাণশক্তি কমে যাওয়া মানুষের শরীরের অভ্যন্তরে যদি কোন রক্তক্ষয়ী রোগ না থাকে, তবে তিনটে কৃষ্ণতুলসীর পাতার সঙ্গে দশ ফোঁটা মধু প্রাতঃকালে খালিপেটে পান করলে তাতে অতি উত্তম ফল পাওয়া যায়৷ তবে কারও যদি অর্শ, রক্ত–আমাশায় বা দেহের অভ্যন্তরে ক্ষত (আলসার) থাকে তবে তার পক্ষে এটা পান করা অনুচিত৷
ৰুশ–ৰী হচ্ছে ছোট প্রজাতির মউমাছি৷ এরাও ভারতের প্রাচীন অধিবাসী৷ গাছে চাক তৈরী করা ছাড়াও এরা মাটির ঘরের দেওয়ালে চাক তৈরী করতে বেশী পছন্দ করে৷ এক একটি চাক থেকে মধু পাওয়া যায় খুবই কম৷ তবে মধু বেশ সুসন্তুলিত৷ স্বাদে গন্ধে ভাল৷ অন্যান্য মধুর চেয়ে লঘুবীর্য৷ ভাল নিম্ব মধু (নিম ফুলের মধু) এরাই তৈরী করে৷ এরা সহজে কামড়ায় না৷
এপিস–ইণ্ডিকা ভারতের সাবেকী মউমাছি৷ এদের আকার মাঝারি, এরা মাঝারি আকারের গাছে বাস করে৷ যে সব গাছে পুষ্পমধু ন্দ্রপ্তপ্সব্জ্ত্রপ্ত ন্দ্বন্তুব্ধ্ত্রব্জগ্গ বেশী পরিমাণে হয় তারা সেই গাছে বা সেই গাছের নিকটবর্ত্তী এলাকায় চাক তৈরী করে৷ এরা অনেক দূর পর্যন্ত উড়ে যেতে পারে৷ সরষে ফুলের মধু এরাই ভাল তৈরী করে৷ আয়ুর্বেদীয় ঔষধ প্রস্তুতিতে এদের তৈরী মধুই বৈদ্যরা বেশী পছন্দ করেন৷ সুন্দরবনে শীতের শেষে এরাই প্রথমে চাক তৈরী করতে এগিয়ে আসে৷ এদের চাকের মধুত্থ (মোম) বেশী নমনীয়৷
(পোষা) মউমাছিকে আখের রস খেতে দিলে সে তা থেকে অতি উত্তম মানের মধু তৈরী করতে পারে৷ বছরে সব সময় যথেষ্ট পরিমাণে ফুল না থাকায় কখনো কখনো পুষ্প–মধুর ন্দ্রপ্তপ্সব্জ্ত্রপ্ত ন্দ্বন্তুব্ধ্ত্রব্জগ্গ অভাব ঘটে৷ তাই সে সময় মউচাকে যথেষ্ট মধু জমা পড়ে না৷ পোষা মউমাছিকে চ্ন্দ্বন্দ্ব–ন্সন্দ্বন্দ্ব্ আখের রস খাওয়ালে এ সমস্যার সহজেই সমাধান হতে পারে৷ ঙ্মদ্রব্যগুণের চিকিৎসায় অনেক ঔষধ–প্রস্তুতিতে মধু অনুপান হিসেবে ব্যবহূত হয়ৰ৷
(শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের ‘দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য’ থেকে)