দর্শনশাস্ত্র প্রথম লিখলেন (তখন অক্ষর উদ্ভাবিত হয়েছে) মহর্ষি কপিল*৷ লোকে তাঁর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হ’ল৷ প্রথম দর্শনের প্রবক্তা হিসেবে সমাজের সমস্ত পণ্ডিতেরাই এক বাক্যে ‘‘আদি বিদ্বান’’ বলে তাঁর মাথায় সম্মানের শিরোপা চড়িয়ে দিলেন৷ রাঢ়ের এই সারস্বত পুরুষ সৃষ্টিরহস্যের মূল কারণগুলো সংখ্যাক্ষদ্ধ করে বিদ্বৎসমাজে সাজিয়ে তুলে ধরলেন৷...
শিব ছিলেন এক প্রচণ্ড পুরুষ৷ সাংখ্য দর্শনের অধিক্ষেত্রে এই রকম পুরুষকে ব্যাখ্যাত করা গেল না৷ শিব যা বলে গেছেন তার সঙ্গে সাংখ্য দর্শনের বক্তব্যেরও গরমিল রয়েছে৷ শিব স্পষ্টই বলে গেছেন, জগতের উৎপত্তি এক চিন্ময় সত্তা থেকে৷ এক চিন্ময় সত্তার বিরাট দেহেই তার অবস্থিতি৷ আর সেই চিন্ময় সত্তার স্বরূপই তার চরম স্থিতি৷ শিবের বিরাটত্ব সাংখ্যা দর্শনের বাদ–জল্প–বিতণ্ডা তিনটেকেই স্তম্ভিত করে দিয়েছিল৷
একটি সর্বাত্মক দর্শনের মূল ভিত্তি বাদ–জল্প–বিতণ্ডাতে দাঁড়িয়ে থাকে৷ এই ভিত্তিটা সুদৃঢ় না থাকলে তার অস্তিত্ব ধোপে টেকে না৷ সাংখ্য দর্শন অনেক পরবর্তী দর্শনকেও তার যুক্তিজালে, তার বাদ–জল্প–বিতণ্ডার আয়ুধ–বলে পরাভূত করেছিল, আজও করে থাকে৷ কিন্তু সে তার চেয়ে অনেক পুরাতন শিবের মহিমাত্বে বা জ্যোতিপ্রোজ্জ্বলতায় এতই অভিভূত হয়ে পড়েছিল যে শিব সম্বন্ধে সে কোন ধারণাই মানুষকে দিতে পারে নি...তার নিজের চোখ ঝলসে গেছল৷
* * * *
দর্শনশাস্ত্র প্রথম লিখেছিলেন রাঢ়ের মহর্ষি কপিল৷ সাংখ্য দর্শনের অনেক পরে রাঢ়েতে এলেন আর এক সারস্বত পুরুষ–মহর্ষি পতঞ্জলি৷ মহর্ষি পতঞ্জলির দর্শন পাতঞ্জল দর্শন বা ‘সেশ্বর সাংখ্য’ নামে পরিচিত৷ সর্বনিয়ন্তা ঈশ্বরকে এখানে স্পষ্ট ভাবে মানা হয়েছে৷ পাতঞ্জল যোগ রাজযোগ নামে পরিচিত৷ রাজযোগের একটা বড় ত্রুটি হ’ল ভক্তির স্থান এখানে নেই৷ শিবাদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাজাধিরাজ যোগে কিন্তু ভক্তিকে উচ্চস্থান দেওয়া হয়েছে৷
* * * *
হ্যাঁ, বলছিলুম দর্শনের তিনটে আয়ুব–বাদ–জল্প–বিতণ্ডা৷ এদের একটি হচ্ছে যৌক্তিকতার বলে নিজেকে শক্তিশালী করা৷ দ্বিতীয় হচ্ছে তর্ক–শক্তিতে অন্য দর্শন বা মতবাদকে পরাভূত করা৷ আর তৃতীয় হচ্ছে পরাভূত দর্শনের ক্ষৌদ্ধিক দুর্গকে দখল করা৷ সাংখ্য দর্শনে এই তিনটিই ছিল৷ কিন্তু শিবের বাস্তবতাভিত্তিক বিরাট পৌরুষকে সে দূর থেকেই এড়িয়ে গেছল৷
সাংখ্যের প্রকৃতিকে পার্বতীর সঙ্গে তুলনা করা, সাংখ্যের পুরুষকে শিবের সঙ্গে তুলনা করা একেবারেই হাস্যাস্পদ ব্যাপার হয়ে যায়৷ কারণ শিব অগণিত পুরুষের মধ্যে একটি পুরুষ বলে গণ্য হবার–খ্যাত হবার নন৷...
সাংখ্য দর্শনের অনেক পরে রাঢ়েতে এলেন আরেক সারস্বত পুরুষ–মহর্ষি পতঞ্জলি*৷ তিনি সাংখ্য দর্শনের কয়েকটি মৌলিক ত্রুটি দূর করলেন৷ আবার কয়েকটি ব্যাপারে সাংখ্য দর্শনের চেয়ে পেছিয়ে রইলেন৷ এঁর দর্শন যা ‘পাতঞ্জল যোগদর্শন’ বা ‘যোগসূত্রম্’ বা ‘সেশ্বর সাংখ্য’ নামে পরিচিত তাতে বৈদুষ্য ও ক্ষৌদ্ধিকতার যথেষ্ট পরিচয় রয়েছে৷ কতগুলো জিনিস বেশ মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতিতে ক্ষোঝানোও হয়েছে৷ সর্বনিয়ন্তা ঈশ্বরকে স্পষ্ট ভাষায় মেনে নেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু কপিলীয় সাংখ্য দর্শনে যে বৈশ্লেষণিক বিস্তৃতি রয়েছে তা এতে নেই৷ পাতঞ্জল দর্শনের আরও একটি গুণ রয়েছে যে এতে যোগসাধক তাঁদের সাধনাপথেরও কিছু কিছু ইঙ্গিত ও ইশারা পেতে পারে৷
এই দর্শনের যে ত্রুটিটা সব কিছুকে ছাপিয়ে উঠেছে তা হ’ল সর্বনিয়ন্তা ঈশ্বরের সঙ্গে জীবের সম্পর্কটা খুব স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত নয়৷ ঈশ্বর কীভাবে সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছেন সে কথাটাও স্পষ্ট নয়৷ কেন মানুষ যোগসাধনা করবে, কেনই বা মানুষ চিত্তবৃত্তি নিরুদ্ধ করবে তারও যথাযথ বিস্তৃতি বা বিবৃতি করা হয়নি৷ পাতঞ্জল দর্শনে যিনি ‘ঈশ্বর’ তাঁর সঙ্গে শিবের মৌলিক পার্থক্যটাও লক্ষণীয়৷
শিব জগৎকে সন্তান রূপে দেখেছেন সন্তান রূপে স্নেহচ্ছায়ায় তাদের লালন–পালন করেছেন আর লৌকিক জীবনের অন্তে তাদের নিবিড়ভাবে নিজের কোলে টেনে নিয়েছেন৷ এই মাধুরীপূর্ণ শিবাদর্শের ছিটেফোঁটা ইঙ্গিতও পাতঞ্জল দর্শনে নেই৷ এ হচ্ছে একটি নীরস বিশুদ্ধ যোগসাধনা৷ এতে যোগীর হৃদয় সরসতায় পেলব হয় না৷ যোগীর হূদয়ে ভক্তিক্ষীজ উপ্ত হলে সরসতার অভাবে তা অঙ্কুরিত হয় না৷ আসল জিনিসটা হচ্ছে, যে ভক্তিরসতরঙ্গের দ্যোতনায় ও প্রেষণায় জীব ঈশ্বর–সম্বোধি লাভ করে সেই ভক্তিরসের অস্তিত্বের একান্ত অভাবেই পাতঞ্জল দর্শনের ভিত্তিতে কোন ভক্তমণ্ডলী, কোন হরিপরিমণ্ডল গড়ে উঠতে পারেনি৷
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)