পূর্ব প্রকাশিতের পর
কুসুমে সুরভি যে কেবল দেবতার কাম্য তা নয়৷ ভক্ত তার হৃদয়ের সুরভি দিয়ে মালা গাঁথে তার ইষ্টের জন্যে৷ কুসুমে সুরভি না থাকলে সে কুসুম ভক্তের কাছে কোন মূল্য বহন করে না৷ এখানে মনে রাখতে হবে, কুসুমের সুরভি আর ভক্তের হৃদয়ের কোমল মাধুরী দু’য়ে মিলে এক অনবদ্যতা এনে দেয়৷
এখানে কুসুমের সুরভি কী? জাগতিক কাজে ভক্তের যে প্রাণঢালা ভালবাসা সেটাই কুসুমের সুরভি৷ আর ইষ্টের প্রতি যে প্রাণঢালা ভালবাসা তাই ভক্তহৃদয়ের মাধুরী৷ এ দুয়ে মিলেই হচ্ছে ভক্তের গাঁথা মালা৷ কুসুমের সুরভি যদি থাকল কিন্তু ভক্ত হৃদয়ের মাধুরী যদি না থাকল তবে ইষ্টের জন্যে মালা গাঁথা যায় না৷ তাই মালা পরাবার প্রশ্ণও ওঠে না৷ আর তেমনি ফুল সাজিভর্ত্তি অবস্থাতেই রিক্ততার গ্লানিতে আর অপ্রাপ্তির বেদনায় সাজিতেই শুকিয়ে মরে৷ ভাল যাকে বাসিনি মালা যদি সে গ্রহণ না করে তখন সাজিভর্ত্তি ফুল নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে লাভটাই বা কি
‘‘ভরা সাজি কি গো
হে মোর দেবতা,
এমনি ভরিয়া রবে৷’’
শিবকে পাতঞ্জল দর্শন ঈশ্বররূপে হয়তো মেনেছে, তবে তাঁকে প্রাণের ঠাকুর বলে ডাকতে শেখায়নি৷ এটা শিবের প্রতি চরম অবিচার৷ কারণ, শিব যে ছিলেন প্রাণের ঠাকুর৷ তাই পাতঞ্জল যোগ দর্শনের আলোকে শিবের মহিমা ঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি৷ হবে কী করে? পাতঞ্জল যোগদর্শনের আলো একান্তই নিষ্প্রভ৷ শিবের অসামান্য আলোকছটার সামনে তার দ্যুতি খদ্যোতের চেয়েও তুচ্ছ৷...
শিব এই সৃষ্ট জগৎকে প্রাণ ঢেলে ভালবেসেছিলেন৷ শিক্ষা, চিকিৎসা, সমাজনীতি, নৃত্য ঙ্মতাণ্ডব নৃত্য শিবই প্রথম প্রবর্ত্তন করেনক্ষ গীত [সুরসপ্তক তথা সঙ্গীত–শাস্ত্র], বাদ্য, আধ্যাত্মিক সাধনা–এই সবকিছুই তাঁর স্নেহের সন্তানদের কোলে বসিয়ে গাল টিপে আদর করে নিজের হাতে শিখিয়ে গেছেন৷ জগৎকে তিনি যদি মিথ্যে বলে ভাবতেন তবে তিনি নিশ্চয়ই সব সময় ঊর্ধ্বগ দৃষ্টিতে জগৎকে উপেক্ষা করে পড়ে থাকতেন৷ শিব তাহলে শিবের পরিচিতি বহন করতে পারতেন না, তিনি শব হয়ে পড়ে থাকতেন৷...
মানুষ যাগ–যজ্ঞ করতে শিখেছিল অনেক দিন আগে৷ মানুষ নীতিগতভাবে বুঝেছিল ঈশ্বর রয়েছেন৷ কিন্তু ঈশ্বরকে প্রাপ্তির জন্যে কী করতে হবে, কীভাবে ঈশ্বর–প্রাপ্তির চেতনা জাগাতে তথা বাড়াতে হবে, কীভাবে নিজেকে ঈশ্বর–প্রাপ্তির উপযুক্ত আধার রূপে গড়ে তুলতে হবে এসব তারা কিছুই জানত না, কিছুই বুঝত না৷ শিব সাধনামার্গ তৈরী করে দিলেন৷ শিব বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে মন্ত্রের সাহায্যে মনকে গড়ে তুলতে হয়৷ ‘‘মননাৎ তারয়েৎ যস্তু সঃ মন্ত্রঃ পরিকীর্ত্তিতঃ৷’’ মন্ত্রযোগ, রাজযোগ, ও অন্যান্য রাজাধিরাজ যোগের সমন্বয়ে কীভাবে অধ্যাত্ম–স্তরে উন্নতি করা যায় সে শিক্ষাও শিব মানুষকে শিখিয়েছিলেন৷ লোকে এক বাক্যে মেনে নিলেন শিবই হচ্ছেন ‘মন্ত্রাধিপতি’, ‘মন্ত্রেশ’৷ শিব মানুষ–পশু সকলকে সমান ভালবেসেছিলেন৷ পশুর আশ্রয়দাতা হিসেবে তিনি ‘পশুপতি’ নামে খ্যাত ছিলেন৷ অধ্যাত্ম জগতে বীর সাধকের আশ্রয়দাতা হিসেবে তিনি ‘বীরেশ্বর’ নামে খ্যাত ছিলেন৷ আর উন্নত স্বভাবের উন্নতধী সাধককুলের রক্ষক হিসেবে তিনি ‘মহাদেব’ নামে পরিচিত ছিলেন৷ আর শিব ছিলেন ‘দেবানাং দেবঃ ইত্যর্থে মহাদেব’৷ যুগ যুগ ধরে ‘দেব’ আখ্যায় ভূষিত মানুষেরা তাঁর উদ্দেশে বলে এসেছে–
‘‘তব তত্ত্বং ন জানামি কীদৃশোসি মহেশ্বর৷
যাদৃশোসি মহাদেব তাদৃশায় নমো নমঃ৷৷’’
‘‘হে মহেশ্বর, তোমাকে বোঝা, তোমাকে চেনা, আর তোমাকে মাপা অণুমানসের কর্ম নয়৷ যখন যে ক্ষেত্রেই তোমার গভীরতা মাপতে গেছি থই পাইনি৷ তাই তুমি কেমনটি তা জানি না, কিন্তু তুমি যেমনি তেমনটি তোমাকে বারবার নমস্কার করছি৷’’...
ধর্মানুরক্তি বা পরানুরক্তি মন্যুষসহ সকল জীবের সহজ বৃত্তি৷ কুলকুণ্ডলিনীতে প্রসুপ্ত প্রাণশক্তির সহজ প্রবণতা হচ্ছে পরমপুরুষের ভাবে নিষিক্ত হওয়া৷ তাই কুলকুণ্ডলিনী তত্ত্বের মাধ্যমে সাধনা হচ্ছে সহজ সাধনা৷
‘‘মুরলী শুণিয়া মোহিত হইবে সহজ কুলের বালা৷
দ্বিজ চণ্ডীদাস কয় তখনি জানিবে পীরিতি কেমন জ্বালা৷৷’’
এই সহজ তত্ত্বের ওপর নির্ভর করে বৌদ্ধযুগে বাংলায় বৌদ্ধ–শিব তটস্থ যুগে সহজিয়া নামে একটা সাধনা মার্গের প্রবর্ত্তন হয়েছিল৷ এর কিছু অংশ আনন্দমার্গের রাজাধিরাজ যোগের অন্তর্ভূক্ত৷...
শৈবতন্ত্রের সিদ্ধান্তাচার, বামাচার, কুলাচার হিন্দু ও বৌদ্ধ দুই প্রথাতেই প্রচলিত৷ বৌদ্ধ বজ্রযান, মন্ত্রযান, তন্ত্রযান, কালচক্রযান এগুলির প্রত্যেকটিকেই স্বীকার করে এককালে অনুসরণ করত৷ শৈবতন্ত্রের বিশুদ্ধ অংশ যা দক্ষিণাচার, বামাচার দু’য়ের বাইরে, যা কৌলগুরুর কাছ থেকে সাম্রাজ্যদীক্ষায় সেকালে পেতে হত তা বর্ত্তমানে রাজাধিরাজ যোগে আধৃত৷ আনন্দমার্গের কিছু কিছু সূক্ষ্মতর সাধনা রাজাধিরাজ যোগের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে৷ মহর্ষি অষ্টাবক্র এককালে বক্রেশ্বর তীর্থে এই রাজাধিরাজ যোগ প্রবর্ত্তন করেছিলেন ও প্রথম দীক্ষা দিয়েছিলেন রাজকুমার অলর্ককে৷ হিন্দুতন্ত্রে, বৌদ্ধতন্ত্রে ও রাজাধিরাজ যোগে তিনেতেই প্রকাশ্যে বা প্রচ্ছন্নভাবে অনুচ্ছুন্না প্রকৃতির পরশিবতত্ত্ব স্বীকৃত হয়ে রয়েছে৷ কালচক্রযানের নৈরাত্মবাদী, কংকালমালিনী ঙ্মওক্ষ তন্ত্রের শূন্যাত্মদেবী পরশিবেরই নামভেদ মাত্র৷ পরবর্ত্তীকালে শৈবতন্ত্র তার উচ্চাঙ্গের সাধনা পদ্ধতি বিস্মৃত হয়৷ থেকে যায় বামাচারের কতকগুলি অভিচার ক্রিয়া যেমন–মৃতদেহ নিয়ে নাচা, কিছু কিছু কঙ্কাল নিয়ে সাধনা৷ তারও পরবর্ত্তীকালে জৈনতন্ত্রের তেরাপন্থী মতবাদ যখন সমগ্র উত্তর ভারতে ছড়িয়ে পড়ে প্রায় ১৫০ বছরের জন্যে, বামাচার শৈবতন্ত্র তখন ভারত তথা বাংলা–বিশেষ করে বাংলা থেকে নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেছে৷ অঘোরপন্থা বলে আজও যে জিনিষটি প্রচ্ছন্নভাবে অল্পস্বল্প রয়েছে সেটিও শৈবতন্ত্রের বামাচার মাত্র৷ শৈবতন্ত্রের মৌলিক অংশটুকু আজ দিশাহারা৷ উপযুক্ত কৌল, উপযুক্ত তন্ত্রাভিলাষীর অভাবে তার দশা কানাগলির মত৷
শাক্ত তন্ত্র, বৈষ্ণবীয় তন্ত্র যেমন বিভিন্ন শাস্ত্রের দ্বারা আধৃত, সৌরতন্ত্র, গাণপত্য তন্ত্র ও শৈব তন্ত্র ততটা নয়৷ এদের মধ্যে আবার সৌরতন্ত্রে ও গাণপত্য তন্ত্রে পুস্তক নেই বললেই চলে৷ লাল কালিতে লেখা তালপত্রে শৈবতন্ত্রের কিছু কিছু পুঁথি দেখেছিলুম৷ পুঁথির মালিকরা তা পড়তেও জানেন না, মানেও বোঝেন না, হস্তান্তরিত করতেও চান না৷ তবে এটুকু ঠিক, তার মূল সত্তা পরশিব কেন্দ্রিক আর বিশুদ্ধ দার্শনিক বিচারে ও সাধনার পন্থাগত বিচারে শৈবতন্ত্রের পরশিবই গুণময় “পরশিব”৷