আজ সকাম প্রার্থনা ও সগুণ উপাসনার নিরর্থকতা প্রসঙ্গে সংক্ষেপে কিছু বলতে চাই৷ ’’
পরমপুরুষ কোনো জাগতিক পরিমাপের আওতায় আসেন না৷ তাই কোনো প্রকার গুণগত অভিব্যক্তিই তাকে বাঁধতে পারে না৷ তিনি গুণাধীশ ও সব রকম গুণগত বন্ধনের বাইরে৷ পূজা বা উপাসনা জিনিসটা প্রশস্তিমূলকও adorative) হতে পারে, আবার বিশুদ্ধ ভাবাত্মকও ideative) হতে পারে কিন্তু তা কখনো সগুণাত্মক attributional) হতে পারে না৷
অণুমনের কতকগুলি বিশেষ বিশেষ সীমাবদ্ধতা আছে৷ অত্যন্ত সীমিত শক্তি নিয়ে এই অণুমন কতটুকু চিত্তা করতে পারে, কতটুকুই বা নিজেকে অভিপ্রকাশ বা অভিব্যক্ত করতে পারে? যদি সেই বিরাট পরমপুরুষ সম্বন্ধে কিছু বলতে চাও, তাহলে তোমার সীমিত ব্যক্তীকরণ-শক্তি ও বন্ধনের মধ্যে থেকে তোমার সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য৷ তাই কবি পদ্মদন্ত বলছেন ঃ
‘‘অসিতগিরিসমং স্যাৎ কজ্জলং সিন্ধুপাত্রে৷
সুরতরুবরশাখা লেখনী পত্রমুবর্বী ৷৷
লিখতি যদি গৃহীত্বা সারদা সর্বকালম্
তথাপি তব গুণানামীশ পারং ন যাতি৷৷’’
প্রকাণ্ড হিমালয় পর্বতটাকে যদি কালির বড়ি ধরা হয়, ৰৃহত্তর মহাসমুদ্রকে যদি দোয়াত ধরা হয়, স্বর্গের নন্দনকাননের পারিজাত বৃক্ষশাখাকে যদি কলম হিসেবে ব্যবহার করা হয় আর সমগ্র ধরাপৃষ্ঠকে যদি কাগজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়, আর সেই দোয়াত, কালি, কলম ও কাগজ নিয়ে স্বয়ং বিদ্যাদেবী সরস্বতী অনন্তকাল ধরে লিখতে থাকেন, তথাপি পরমপুরুষের অনন্ত গুণরাজি লিখে শেষ করা যাবে না৷ তাই সগুণাত্মক পূজা বা উপাসনা একান্তই অর্থহীন৷ আর যেহেতু এটা নিরর্থক, তাই এটা অবাস্তবও৷ সেই জন্যে সগুণ উপাসনা মানেই সময়ের অযথা অপব্যয় মাত্র৷
আবার উপাসনা জিনিসটা স্তুতিমূলকও হতে পারে কারণ তিনি তো সকলের স্তব-স্তুতির পাত্র৷ সীমিত সামর্থ্য নিয়েও অণুমন তো সেটা করতে পারে, অথবা করার চেষ্টা তো করতে পারে৷ অনুরূপভাবে আধ্যাত্মিক ভাবনাজগতে in the world of ideation) অণুমন যখন তাঁকে ছুঁয়ে যায়, অণুমানস যখন বিন্দুস্থ হয়, ভাবনা জগতে তার নাগাল পাওয়া যায়৷ তাই ideational worship সমর্থনযোগ্য৷ বস্তুতঃ একমাত্র এইটাই যথার্থ উপাসনা পদ্ধতি, একমাত্র গ্রহণযোগ্য বা সমর্থনযোগ্য উপাসনা প্রকরণ৷
অনুরূপভাবে সকাম প্রার্থনায় non-cardinal prayer) নিরত হওয়াও নিরর্থক৷ মানবীয় মৌল নীতিগুলোকে সবাই স্বীকার করে৷ সসীমের সাহায্য নিয়ে তারা অসীমকে স্পর্শ করে বরং বলা যেতে পারে, মিষ্টিসিজমের সঙ্গে, অতীন্দ্রিয় ভাবের সঙ্গে তাদের একটা নিবিড় যোগসূত্র আছে৷ এখন এই মিষ্টিসিজম জিনিসটা কী ধরনের? সসীম ও অসীমের মধ্যে সম্বন্ধ নির্ণয়ের এক অন্তহীন প্রয়াসকে বলা হয় মিষ্টিসিজম সুতরাং নিষ্কাম প্রার্থনায় এটা কিছুটা সমর্থনযোগ্য কিন্তু সকাম প্রার্থনায় এটা সময়ের অপব্যয় মাত্র৷
ঈশ্বরের কাছে এটা-ওটা চাওয়া নিরর্থক কারণ তোমার যা’ সত্যিই প্রয়োজন তা’ পরমপুরুষই বেশী জানেন৷ শিশু জানে না তার কী প্রয়োজন কিন্তু মা জানেন তার সন্তানের কী প্রয়োজন৷ তদনুযায়ী তিনি তার বন্দোবস্তও করেন৷ ঠিক তেমনি তোমার কী কী জিনিস প্রয়োজন, তুমি তা’’ জান না কিন্তু পরম পিতা জানেন ও তদনুযায়ী তিনি তার ব্যবস্থাও করে দেন, ভবিষ্যতেও করবেন৷ তাই তোমার বোঝা load) তারও বোঝা৷ ‘‘হে ঈশ্বর, আমাকে এটা দাও, ওটা দাও” বলবার কোনো প্রয়োজনই নেই৷ তাই বলি, পরমপুরুষের কাছে এটা-ওটা পাবার জন্যে যে প্রার্থনা, সেটা একান্তই অর্থহীন৷ পরমা সম্প্রাপ্তির লক্ষ্যে জীবজগতের যে সর্বাত্মক অভিযান, তাতে এই ধরনের সকাম প্রার্থনায় কোনো গুরুত্বই নেই৷ যদি চাইতেই হয়, তাহলে তোমার চাওয়া উচিত, ‘‘হে ঈশ্বর, আমার মস্তিষ্ককে, আমার মনকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করো, আমাকে শুভ বুদ্ধি দাও৷ তোমার কাছ থেকে আমি কেবল এইটাই চাই---আর কিছু না৷’’
এছাড়া ঈশ্বরের কাছে অন্য কিছু প্রার্থনা জানাতে নেই৷ মানুষের বুদ্ধিটা যদি শুভ হয় তবে তারা সব কিছু পেয়ে যায়৷ এ ছাড়া আর কী প্রয়োজন! তাই তোমার একমাত্র প্রার্থনা হোক, ‘‘হে পরমপুরুষ তুমি আমার বুদ্ধিকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করো৷ তোমার কাছ থেকে আর কিছুই চাই না৷’’ আমার শারীরিক ও মানসিক প্রয়োজনের জন্যে তুমি যা উচিত মনে কর তা-ই করো৷ এই আমি তোমারই ভরসায় রইলুম৷’’ ‘আনন্দসূত্রম’ পুস্তকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আমি লিখেছি ঃ ‘‘প্রার্থনার্চনামাত্রৈম ভ্রমমূলম’’ তারই ওপর নির্ভর করো, তারই ওপর আস্থা রাখো, একমাত্র তাকেই ধ্যেয় হিসেবে গ্রহণ করো৷ তোমার আধ্যাত্মিক বিমুক্তির জন্যে আর কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই৷ দিল্লী, ২১ নবেম্বর, ১৯৭৮