সমাজ কলুষমুক্ত হবে কোন পথে?

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

ধনতন্ত্রের নিষ্ঠুর শোষনে ও শাসনে মানুষের সমাজ ও সভ্যতা আজ বিপর্যস্ত৷ প্রতিমুহুর্তে পরিলক্ষিত হচ্ছে মনুষ্যত্বহীন মানুষের পাশবিক রূপ৷ এক একটা নক্কার জনক ঘটনা ঘটছে, অপরাধ দমনে কঠোর আইন প্রয়োগের দাবীতে সরব হচ্ছে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ৷ কিন্তু আইন করে কি এই অপরাধ দমন  করা যাবে? আইন হয়েছে, প্রয়োগও হয়েছে তবু সমাজে নারী-নিগ্রহ, নারী-ধর্ষণ, খুন প্রভৃতি  সমানে চলেছে৷ কয়েক বছর আগে দিল্লীর এক গণধর্ষণের পর সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়, ধর্ষণ আটকাতে কড়া আইন তৈরী করতে হবে৷ সেই আইন আনা হ’ল৷ কিন্তু তাতেও কোনও পরিবর্তন দেখা গেল না৷ 

কেবল সংসদে আইন পাশ করে এই সমস্যার সমাধান হবে না৷ আইন হয়েছে, বেশ কিছু ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগও হয়েছে, তাতে অবস্থার হেরফের হচ্ছে না৷ বধূহত্যা, নারী নির্যাতন, নারী ধর্ষণ বন্ধ হচ্ছে না বা হ্রাসও পাচ্ছে না৷ আসলে চাই সমাজ চেতনা, চাই উপযুক্ত, শিক্ষা উন্নত মানসিকতা৷

কিন্তু প্রশ্ণ আসছে এই সমাজচেতনা বাড়বে কেমন করে? মোমবাতি মিছিল থেকে শুরু করে সেমিনার, পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি তো খুবই হচ্ছে৷ কিন্তু কাজের কাজ তো কিছুই হচ্ছে না৷ সেই পত্রিকা খুললে প্রায়ই বধূ নির্যাতন, বধূহত্যা, নারী ধর্ষণ প্রভৃতির খবরই চোখের সামনে ভেসে উঠছে৷

তাহলে রোগটা কোথায়? আসল রোগটা হচ্ছে আজকের পুঁজিবাদী সমাজ ভোগবাদের জোয়ারে ভেসে চলেছে৷ ভোগবাদকেই বর্তমান সমাজ তার আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে এগিয়ে চলেছে৷ আজকের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ, বেশির ভাগ রাজনৈতিক নেতা এই ভোগবাদের দ্বারা প্রভাবিত৷

সামাজিক-র্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুঁজিবাদীরা ও মার্কসবাদীরা উভয়েই ভোগবাদী৷ জড়বাদের পরিণতি ভোগবাদ, কারণ জড়বাদকেই তারা একমাত্র ভোগ্যবস্তু হিসেবে মেনে নিয়েছে৷

এই ভোগবাদ থেকেই জন্ম নেয় আত্মসুখবাদ৷ আমি একাই সব ভোগ করব, সমাজ চুলোয় যাক, এই মানসিকতা৷ স্বামী বিবেকানন্দও তাই পাশ্চাত্ত্যর মাটিতে দাঁড়িয়ে জড়বাদী তথা ভোগবাদী দুনিয়ার প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছিলেন, পাশ্চাত্ত্য সভ্যতা এক জীবন্ত আগ্ণেয়গিরির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে, যে কোনো মুহূর্তে এর বিস্ফোরণ ঘটবে৷ তাই তাঁর সাবধানবাণী ছিল-এই জড়বাদী পাশ্চাত্ত্যের মানুষকে নতজানু হয়ে ভারতের আধ্যাত্মিকতার কাছে দীক্ষিত হতে হবে, এছাড়া বাঁচবার কোনো রাস্তা নেই৷

এই জড়বাদ থেকেই আসে সর্বগ্রাসী সর্বধ্বংসী ভোগবাদ,  আর সেই ভোগবাদ সমাজকে চরমভাবে কলুষিত করে দেয়৷ এই ভোগবাদের ফলে পুরুষ নারীকে ভোগ্যপণ্যরূপেই দেখে৷ তারই প্রতিফলন আজকের দূরদর্শনের সিরিয়ালগুলিতে, আজকের সাহিত্য-শিল্প সাধনায়, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বা ম্যাগাজিনে৷ বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন-চিত্রে নারীকে তাই যতটা সম্ভব নগ্ণ করে দেখানো হচ্ছে৷ চলচ্চিত্রের বিভিন্ন কাহিনীতেও নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে৷ বলা বাহুল্য, এর পেছনে রয়েছে পুঁজিবাদী শোষণের চক্রান্ত - প্রাউটের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘মানস-অর্থনৈতিক শোষণ’৷

বিজ্ঞানের নিত্য নূতন আবিষ্কার মানুষের ভোগের উপকরণ যোগাচ্ছে, ভোগের উপকরণ চাহিদার তুলনায় খুবই কম৷ কারণ মানব মনের চাহিদা অসীম, অনন্ত, আর পৃথিবীর সম্পদ সীমিত, বিজ্ঞানের পক্ষে সম্ভব নয় মানব মনের এষণার পূর্ত্তি করা৷ তাই ভোদবাদই সমাজে বিপর্যয় ডেকে এনেছে

তাই বিজ্ঞানের গবেষনার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক চর্চা, আধ্যাত্মিক অনুশীলন অবশ্যই প্রয়োজন৷ তবেই মানুষ আত্ম-সংযমে প্রতিষ্ঠিত হবে, সমাজের সুচিতা রক্ষা হবে, সমাজ কলুষমুক্ত হবে৷

এই ভোগবাদের বিপর্যয় থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারে একমাত্র অধ্যাত্মবাদ৷ অধ্যাত্মবাদ বলছে ‘ঈশাবাস্যমিদং সর্বং / যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ / তে ত ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা / মা গৃধ কস্য সিদ্ধনম্’-বিশ্বের সবকিছু ঈশ্বরময়, সবকিছু ব্রহ্মের বিকাশ৷ মনের মধ্যে এই চেতনার বিকাশ ঘটিয়ে ‘ত্যাগের মাধ্যমে ভোগে’র নির্দেশ দিচ্ছেন উপনিষদের ঋষি৷ সেই প্রাচীন কালের সত্যদ্রষ্টা ঋষির কথা আজও সমভাবে প্রাসঙ্গিক৷ তাঁরা এটাই বলতে চান, ‘জড়’ নয় ‘চৈতন্য’ স্বরূপ ব্রহ্মকেই জীবনের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ কর৷ সবকিছুকে ব্রহ্মের বিকাশ হিসেবে ভাব৷ তাহলেই মন পবিত্র হবে, নিঃস্বার্থ হবে, সবার প্রতি শ্রদ্ধাভাব আসবে, প্রকৃত কর্তব্যবোধ আসবে৷ আর এই ভাবনা নিয়ে জগতের সমস্ত বস্তুর বা সত্তার যথাযথ উপযোগ গ্রহণ কর৷ এই হ’ল অধ্যাত্ম্যবাদের সারকথা৷