সমাজে সম্মানিত আর বয়স্ক লোকেদের আচার–ব্যবহার অন্যের কাছে আদর্শস্বরূপ যুগের পর যুগ ধরে মানুষ তার অনুসরণ ও অনুকরণ করে চলে৷ আজ মানুষের সমাজে এক চরম দুর্দিন আর দুর্দশা সমুপস্থিত, আর তার একটাই কারণ, সমাজের ত্রুটিপূর্ণ নেতৃত্ব৷ মানুষ অন্ধের মত অর্বাচীন নেতাকেও অনুসরণ করে৷ নেতারা বড় বড় কথা, অঙ্গ–ভঙ্গি আর নাটুকেপনা দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে সম্মোহিত ও আকর্ষিত করে৷ এটা জেনে রাখবে যেকোনো দেশে, যে–কোনো মানুষের দারিদ্র্য আর দুর্দশার পেছনে রয়েছে নেতাদের পাপ৷ যারা যথার্থ নেতা তাদের সদা সতর্ক থাকতে হবে আর ভাবতে হবে সবচেয়ে ভালভাবে মানব সমাজের সেবা কীকরে করা যায়৷ তাদের সবসময় সতর্ক থাকতে হবে যে তাদের নির্দেশনার ফলস্বরূপ মানুষ যেন অন্ধকার, মৃত্যু আর অনৈতিকতার কবলে না পড়ে৷
যাদের অন্যকে পথ দেখানোর দায়িত্ব তাদের সর্বোৎকৃষ্ট চরিত্রের অধিকারী হতে হবে আর তাদের আচরণও হবে আদর্শস্বরূপ৷ তারা ও তাদের অনুসরণকারীদের সামূহিক উন্নতির আর শ্রেয়ের দিকে চলতে হবে৷
ইতিহাসের সব যুগেই কিছু মানুষকে বলতে শোণা যায়, ‘‘আজকের সমাজ উচ্ছন্নে গেছে, মানুষ একেবারে অধঃপতিত হয়ে গেছে৷ পুরোনো দিনে জীবন এর থেকে ভাল ছিল৷’’ সব যুগেই এই একই ভাবনা অভিব্যক্ত হয়৷ এর অর্থ কি এই যে মানুষ তার মনুষ্যত্বৰোধ হারিয়ে ফেলেছে? জীবজগতের বিবর্ত্তনে মানুষ কি আর সেই সর্ব্বোচ্চ স্থানে নেই?
মানবতার সর্বপ্রকার মানসিক রোগের মূল কারণ হচ্ছে জীবনে ভূমাদৃষ্টির অভাব৷ যারা এই রকম রোগগ্রস্ত তারা অন্যের কথা ভাবে না কিন্তু ভাবে কেবল নিজের কথা৷ তারা তাদের পরিবার, চাকরীর স্বার্থ ইত্যাদি নিয়েই ব্যস্ত থাকে, অন্যের কথা ভুলে যায়৷ এটা একটা সাংঘাতিক রোগ৷ কিন্তু এটা সঙ্কীর্ণ মনোভাবেরই একটা অভিপ্রকাশ আর উপসর্গ, যা মানসিক রোগের মূল কারণ৷ তাই এর নিদান হচ্ছে আচার ব্যবহারের গতিটাকে একেবারে বিপরীত দিকে করে দেওয়া যাতে অধঃপতিত মানুষ মনের সঙ্কীর্ণতা থেকে মুক্তি পেতে পারে৷ এর ঔষধ হচ্ছে কেবল একটাই– ৰ্রহ্মভাবনা৷ কিন্তু শুধু মহত্তম লক্ষ্যকে মেনে নিলেই তা ততক্ষণাৎ কাউকে সেখানে প্রতিষ্ঠিত করে দেবে না৷ আনন্দমার্গ সত্যের জন্যে সংগ্রাম করে চলেছে, আর যতক্ষণ না ব্যষ্টিগত আর সামূহিক জীবনে আমরা সামগ্রিকভাবে জয়লাভ না করছি ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম ৰন্ধ করলে চলবে না৷ সংগ্রামের সময় অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করে নেওয়া অসত্যের পরিচায়ক৷ শুধু শতকরা ৭৫ ভাগ সত্য আর ২৫ ভাগ অসত্য থাকলে সেটা কোনো জয়লাভ হ’ল না৷ কুইনাইন ম্যালেরিয়ার উপসর্গকে দমন করে রাখে কিন্তু মূল রোগ রক্তের মধ্যে থেকে যায়৷ কিন্তু উপযুক্ত চিকিৎসা হচ্ছে রোগকেই নির্মূল করে দেওয়া৷ তাই যতক্ষণ পর্যন্ত অসত্যকে একেবারে নির্বাসিত করা না হচ্ছে ততক্ষণ সংগ্রামের বিরাম নেই৷
সমাজ হচ্ছে যারা সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলছে তাদের সামূহিক নাম৷ পাপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ব্যষ্টিগত স্তরে যেমন চলতে থাকবে তেমনই সামূহিক স্তরে তা চলবে সম্পূর্ণ ঐক্যৰদ্ধভাবে৷ মার্কণ্ডেয় পুরাণে একটা গল্প আছে যে, অসুরেরা এক এক করে সব দেবতাকেই পরাজিত করল কিন্তু দেবতারা ঐক্যৰদ্ধভাবে নিজেদের শক্তিকে সংহত করে একটা প্রচণ্ড সামূহিক শক্তি তৈরী করল, আর তা দিয়ে অসুরদের পরাজিত ও উৎখাত করল৷ গল্প হিসেবে এটা খুব সুন্দর, ও এর যা তাৎপর্য সামূহিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার বৈবহারিক প্রয়োগ হওয়া উচিত৷