আমি নানান স্থানে, নানান অনুষ্ঠানে একটা কথা বলেছি–মানসিক সাম্য অথবা মানসিক সাম্যাবস্থা৷ ভগবান শিবের একটি উক্তি আছে, জীবনে সম্পূর্ণ সফল হওয়ার পিছনে চতুর্থ তত্ত্বটি হ’ল ‘সমতাভাব’, অর্থাৎ মানসিক সাম্য, মানসিক ভারসাম্য৷ মনে কোন রকম কম্প্লেক্স রাখলে চলবে না৷ না মহামান্যতা ৰোধ, না হীনমন্যতা ৰোধ৷
মানসিক ভারসাম্য আনতে গেলে, প্রতিটি সৃষ্ট সত্তার সঙ্গে প্রতিটি মানুষের সঙ্গে তোমায় এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যাতে তোমার মনে অথবা তুমি যাদের সঙ্গে মেলামেশা করছ তাদের মনে কোনপ্রকার মহামান্যতা বা হীনমন্যতা ৰোধ না জাগে৷ যে কোন ধরনের কম্প্লেক্স মানেই একটা মানসিক ব্যাধি, একটা মানসিক রোগ৷ নিজেকে অন্যের চেয়ে বড় মনে করা একটা বিরাট মানসিক ব্যাধি৷ ঠিক তেমনি নিজেকে অন্যের চেয়ে ছোট মনে করাও একটা ভুল৷ হীনমন্যতায় ভোগাও একটা মানসিক রোগ৷ তোমরা হীনমন্যতা ৰোধ বা মহামান্যতা ৰোধ কোনটাকেই প্রশ্রয় দিও না৷ তোমাদের মনের সমতা বা মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে৷ ভারসাম্যযুক্ত মনই পরমপুরষের দিকে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে৷ তাই বলা হয়েছে, ‘‘তৃণাদপি সুনীচেন’’–মানুষের ঘাসের চেয়েও অধিক বিনয়ী হওয়া দরকার৷ মানুষের মধ্যে সাধারণতঃ হীনমন্যতার চাইতে মহামান্যতা ৰোধটা বেশী দেখা যায়৷ এমনকি যাদের কেবল অক্ষরজ্ঞান আছে তারাও নিজেকে একেবারে নিরক্ষরদের চাইতে অনেক বড় ভাবে৷ এটা খুবই সাধারণ ব্যাপার৷ সেইজন্যে ‘‘তৃণাদপি সুনীচেন’’ নীতিটা মনে রাখতে হবে৷
তারপর ‘‘তরোরিব সহিষ্ণুণা’’৷ মানুষের মনে রাখা দরকার, একটা বিশেষ বস্তু অন্য একটা বস্তুতে আঘাত করলে, দ্বিতীয় বস্তু থেকে আঘাতটা তৎক্ষণাৎ ফিরে আসতে পারে৷ কিন্তু বিরুদ্ধে শক্তি যাচাই করাটাই বেশী ভাল৷ মনে কর, কেউ তোমাকে আঘাত করল, আর তুমি তাকে প্রত্যাঘাত করলে৷ এক্ষেত্রে আঘাতকারীর আঘাতটা যাচাই করলে না, বরং ফিরিয়ে দিলে৷ তুমি যদি চালাক হও তুমি আঘাতটা সহ্য করবে, আর পরে এটাকে যাচাই করার পর বেশী শক্তি দিয়ে তাকে প্রত্যাঘাত করবে৷ এটা যেমন ধর, একজন কারোর দিকে তির ছুঁড়ল, এখন তিরটা যদি প্রথম ব্যষ্টির দিকে সমান গতি ও শক্তিসহ ফিরিয়ে দেওয়া হয়, তখন এর একটা (বিরাট) প্রভাব পড়তে বাধ্য৷ তাই বলা হয়েছে, ‘‘সহ্য কর’’৷
সহ্য করা মানে, তোমার ওপর তোমার শত্রুর আরোপিত শক্তিকে মেপে নেওয়া৷ তুমি এটাকে যাচাই করে দেখ৷ এটা নয় যে তুমি সহ্য করার জন্যে সহ্য করবে৷ বরং তুমি ধৈর্য ধরবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে শত্রুকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে৷ সেইসময়, তোমার শত্রুর শক্তিও হ্রাস পেয়ে যাচ্ছে৷ প্রত্যেকের তাই সহ্যশক্তির অনুশীলন করা দরকার, (যা) খুবই প্রয়োজনীয়৷ তার মানে অবশ্য এই নয় যে তুমি অশেষভাবে সহ্য করতে থাকবে ও শেষে মৃত্যুকে আমন্ত্রণ করবে৷ তাই সহ্যের খাতিরে সহ্য করা ভালো অভ্যাস নয় কিন্তু শক্তিসঞ্চয় ও শক্তিবৃদ্ধির জন্যে সহ্য করাটা লাভজনক৷
তারপর ‘‘অমানীনম্ মানদেন’’৷ পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ মানুষ৷ এর মধ্যে শতকরা নিরানব্বই জন সামাজিক মর্যাদা পায় না৷ তিনটি মূল তত্ত্ব রয়েছে যার ফলে তারা সামাজিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয় ঃ প্রথমত, সমাজ তাদের স্বীকৃতি দেয় না সমাজ তাদের স্বীকৃতি দিতে চায় না৷ দ্বিতীয়ত, যেহেতু তারা অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু, অর্থনৈতিকভাবে জর্জরিত তাই তাদের অশেষভাবে সবকিছু মেনে নিতে হয়৷ তৃতীয়ত, তাদের মধ্যে শিক্ষার বা জ্ঞানের অভাব থাকে৷
তুমি যদি চাও কেউ ঙ্মসম্মান পাকৰ, তোমাকে তাহলে তাকে এক এক করে এই তিনটি বিষয় দিতে হবে (স্বীকৃতি, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ও শিক্ষা)৷ তবেই তুমি তাকে শ্রদ্ধা করতে পারবে৷ প্রত্যেককে শ্রদ্ধা করা ধর্মেরই এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ৷ লক্ষ্য রাখতে হবে তাদের যেন সামাজিক প্রগতি হয়, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা আসে আর আত্মসম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে চলতে পারে৷ জাতের বিচারে কেউই উঁচু বা নিচু নয়৷ হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে যে ধর্ম–ভিত্তিক বিভেদ তাও নিন্দনীয়৷ মানুষ একই জাতের৷ তারা সবাই ঈশ্বরের সন্তান৷ তাই সবাইকে সমান সামাজিক মর্যাদা দিতে হবে৷
তৃতীয় তত্ত্ব যা বললুম, তা হচ্ছে, তাদের অর্থনৈতিক দিকটা তোমাদের দেখতে হবে যাতে সকলে উপযুক্ত খাদ্য–বস্ত্র পায়, শিক্ষা ও চিকিৎসা পায়–অন্যের দয়ার ওপর নির্ভর না করে সসম্মানে মাথা উঁচু করে একজন সম্মানীয় মানুষের মত বাঁচতে পারে৷
তাই তুমি যদি সত্যি সত্যিই মানুষকে সম্মান দিতে চাও, বিশেষ করে ‘অমানীনম্’–যাদের কোন সামাজিক মর্যাদা নেই, তোমাকে তাহলে তাদের শিক্ষা, সামাজিক স্থিতি ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করতে হবে৷
২ ডিসেম্বর ১৯৭৯, কলিকাতা