শ্রাবণী পূর্ণিমা

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

......আমাদের এই শ্রাবণী পূর্ণিমা–অনেকেই জান, এটা জানা জিনিস আমি তখন খুবই ছোট্ট৷ তখন বিদ্যাসাগর কলেজে পড়ি৷ একদিন সন্ধ্যায় একটা ঘটনা ঘটল৷ একজন লোক–সে লোকটি দুষ্ট প্রকৃতির ছিল৷ আমরা এই কথাটা ব্যবহার করছি এই জন্যে যে আজ যে মানুষটা দুষ্ট, কাল সে সাধু হতে পারে৷ আজ যে মূঢ় কাল সে জ্ঞানী হতে পারে–এ সবকিছু আপেক্ষিক জগতের আপেক্ষিকতার দ্বারা অভিষিক্ত৷ তাই এর কোন শাশ্বত রূপ নেই৷ কোন মানুষকে স্থায়ীভাবে দুষ্ট বলা চলে না৷ সব সময় মনে রাখতে হবে যে আমি এই দুষ্টের ভেতরে যে ভাল জিনিসগুলো নিহিত রয়েছে সেইগুলোকেই জাগিয়ে দিয়ে, বাড়িয়ে দিয়ে একে ভাল করে তুলবো৷ ভাল মানে কী?–না, সংস্কৃত ‘ভদ্র’ শব্দ থেকে ‘ভাল’ শব্দটা এসেছে৷ সংস্কৃতে ‘ভদ্র’, প্রাকৃতে/পালিতে ‘ভদ্দ’, তাই থেকে অর্ধ প্রাকৃতে ‘ভল্ল’, তাই থেকে প্রাচীন বাংলায় ‘ভালা’/‘ভাইলা’, বর্ত্তমান বাংলায় ‘ভাল’৷ ফরিদপুর জেলার গ্রামাঞ্চলে একটা ছড়াই ছিল–‘ভালা আইল বুরা গেল’, ‘ভালা’ মানে ‘ভাল’৷ আবার বার শ’ বছরের পুরোনো বাংলার ছড়াতেও আছে–

‘‘পার গজর সঙ্গ সোই দুর্জন সঙ্গ অবসর তোই৷

নাদ ন বিন্দু ন রবি ন শশীমণ্ডল৷৷

উজুরে উজু ছাড়ি না লেও রে বাংক৷

নিওড়ি বোহি ন খাওরে লংকা৷৷

হাতে কংকন, না লেও দাপন৷

অপ্পনে অপ্প বুঝত নিয় মন৷৷

পার গজর সোই দুর্জন সঙ্গ অবসর তোয়ি৷

বাম দাহিন যো খলু বিখলা৷৷

সরহভনই বাপ্পা উজু বাট ভৈলা৷’’

‘ভাইলা’ শব্দের নিদর্শন দেখিয়ে দিলুম৷ তা ভাল বলতে, সংস্কৃতে ‘ভদ্র’ বলতে তাকেই বোঝায় যে সুষ্ঠুভাবে ত্রিভূতেই–শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিকে এগিয়ে চলে৷ ভাল সে নয় যে বসে বসে মার খাচ্ছে, অপমান সহ্য করছে, বা শোষণের পর শোষণের পালা চলেছে আর মুখ বুজে সেটাকে বিধিলিপি বলে মেনে নিচ্ছে৷ এ সমস্ত ভাল লোকের লক্ষণ নয়৷ ভাল লোকের লক্ষণ হ’ল যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, ন্যায়কে দৃঢ় হস্তে ধরে রাখে, দুর্বলকে রক্ষা করে, পাপীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, সেই–ই ভাল৷ যারা অত্যন্ত নিরীহ, যারা শান্ত–শিষ্ট (goody goody boys), তারা ভাল নয়৷

তা হয়েছিল কী? –না, একজন দুষ্ট প্রকৃতির লোক আমার কাছে এসেছিল৷ আমি সাধারণ একটি ছোট্ট ছেলে–আমার কাছে আর কী পাবে? কিন্তু আমার কাছে এসেছিল৷ আমি তাকে মানব মনের যা স্বাভাবিক সাইকোলজি তদনুযায়ী জিজ্ঞাসা করেছিলুম–কী চাও? কেন এ পথে নেমেছ? ইত্যাদি৷ তারপর খানিকক্ষণ আমার সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছিল৷ সে বুঝেছিল–তার কিছু করা উচিত আর পরে সে দীক্ষাও নিয়েছিল৷ সেইটাই প্রথম দীক্ষা৷

আজ আবার সেই দিনই ঘুরে ফিরে এসেছে–

অনেক দিন হ’ল৷ তখন সেটা ছিল সম্ভবত ১৯৩৯ সাল.....৷ একচল্লিশ বৎসর আগেকার ঘটনা৷

তা মানব মনীষার কোরকে যে শুভভাব নিহিত রয়েছে তাকে জাগিয়ে তোল৷ তাকে জাগাতে গেলে কী করতে হয়? বকা–ঝকা, তিরস্কার–শাসন, শক্তি প্রয়োগ সব কিছুই করতে হয়৷ আবার সঙ্গে সঙ্গে চেষ্টাও চালাতে হয় যাতে সেই প্রষুপ্ত কোরক বিকশিত হয়৷ তার রূপে–রসে–গন্ধে সমগ্র সমাজ উপকৃত হয়৷ আজকে সেই মানুষকে প্রেরণা যুগিয়ে, দরকার মত শাসন করতে হয়৷

শাসন বর্জনীয় নয়৷ শাস্ত্রে বলা হয়েছে–‘হিতার্থে শাসনম্ ইত্যর্থে অনুশাসনম্’. ভালর জন্যে যে শাসন তাকেই বলা হয় অনুশাসন৷ সমাজে শাসনের প্রয়োজন রয়েছে৷ শাস্ত্রে বলা হয়েছে–

‘নিগ্রহানুগ্রহে শক্তো গুরুরিত্যভিধীয়তে’৷

যিনি কড়া শাসন করতে পারেন আর কড়া ভালও বাসতে পারেন অর্থাৎ খুব বেশী ভালও বাসেন, আবার খুব বেশী শাসনও করেন তিনিই গুরু৷ যিনি কেবল শাসন করেন তিনি গুরু নন–তিনি শত্রু৷ যিনি কেবল ভালবাসেন, আদর করেন তিনিও গুরু নন–তিনিও শত্রু৷ কারণ মাত্রাধিক্য ভালবাসায় মানুষ খারাপ হয়ে যায়৷ যিনি দু’টোই করতে জানেন তিনিই গুরু৷

তাই তোমরা মানুষকে আদরে–শাসনে তৈরী করবে৷ যেখানে আদরে কাজ হ’ল না সেখানে শাসনের প্রয়োজন আছে৷ ওষুধ মাত্র–ই যে মিষ্টি হবে এমন কোন কথা নেই৷ তেঁতো ওষুধেরও প্রয়োজন আছে৷ রোগী অনেক সময় তেঁতো ওষুধ খেতে চাইবে না–কাঁদবে৷ কিন্তু ভাল চিকিৎসক তাকে জোর করে চেপে ধরে ওষুধ খাইয়ে দেবে৷ এই হচ্ছে বিধি৷

তোমাদের আমি বলব–গোটা মানবসমাজ আজ ক্ষত–বিক্ষত৷ নানান ব্যাধিতে, নানান ভাবজড়তায় তার সর্বাঙ্গ আজ পুঁতিগন্ধময়৷ সর্বাঙ্গ কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে৷ এ অবস্থায় ভেবে চিন্তে যখন যেমনটি চিকিৎসার দরকার তখন তেমনটি চিকিৎসার ব্যবস্থাই করে মানুষ জাতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে৷ আর একবার বলছি, কোন মানুষকে প্রথমেই দুষ্ট বা খারাপ বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছুবে না৷ তার ভেতরের ভাল জিনিসগুলো খুঁজে বের করবার চেষ্টা করবে৷ আর ভালো জিনিসের মাত্রা বেড়ে গেলে সমাজ তাকে শ্রদ্ধা করবে৷ প্রত্যেক মানুষকে শ্রদ্ধার আসনে বসাবার চেষ্টা করবে৷ কিন্তু শ্রদ্ধার আসনে বসাবার তুমি যে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছো তা যে সমর্থন করবে না, যে মানব সমাজের অবারিতভাবে ক্ষতি করে যেতেই থাকবে তার বিরুদ্ধে অত্যন্ত দৃঢ়তাপূর্বক ব্যবহার তোমাদের করতে হবে বৃহত্তর মানব জাতির স্বার্থে, ভূ–লুন্ঠিত মানবতার স্বার্থে, পরমপুরুষের তৃপ্ত্যর্থে, প্রীত্যর্থে৷     (কলিকাতা, ২৫শে আগষ্ট,

               শ্রাবণীপূর্ণিমা, ১৯৮০)