তোমাদের কাজ সামগ্রিক ভাবে সমাজকে নিয়ে ।
‘কর্মণা বদ্ধতে জীবঃ বিদ্যয়া তু প্রমুচ্যতে ।’
কর্ম যদি বিদ্যাহীন হয়, কর্মের সঙ্গে যদি জ্ঞানের সমর্থন না থাকে, বৈদ্যুষ্যের সমন্বয় না থাকে তাহলে কর্ম জাগতিক বন্ধনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, আর তার থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যে বিদ্যারই দরকার হয় । কোনও একটা ‘আইডিয়া’-একটা ভাবাত্মক সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণরূপে একটা নিস্ক্রিয় সত্তা রূপেও থাকতে পারে অথবা তাকে কোনও কাজেও লাগানো যেতে পারে । হ্যাঁ, তাকে কাজে লাগিয়ে মানুষের কল্যাণও হতে পারে, আবার অকল্যাণও হতে পারে । কোনোও এক ভাবাত্মক সিদ্ধান্তকে কার্যান্বিত করার আগে ভেবে দেখতে হবে সেই কাজের সূত্রপাত বাস্তবতার মাটি থেকে হচ্ছে, না কল্পনার আকাশ থেকে আসছে । যদি বাস্তবভূমি থেকে এসে থাকে তবেই তা সিদ্ধ হবে, সফল হবে ।
পৃথিবীতে অনেক থিওরী এসেছে, অনেক ভাবাত্মক সিদ্ধান্ত এসেছে । কেউ কেউ পৃথিবীর চরম ক্ষতি করে গেছে, আবার কেউ কেউ কিছুটা উন্নতিও করেছে । কিন্তু আজকের যে পরিস্থিতি, আজ মানবসভ্যতা যে অবস্থায় এসে পৌঁছেচে, এর যথার্থ উন্নতির জন্যে অথবা প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্বের কুফল থেকে বাঁচানোর জন্যে আমাদের দরকার হল এক খুবই দৃঢ়, শক্তিশালী ভাবাত্মক তত্ত্ব । আর একে কার্যান্বিত করার জন্যে তত্ত্বটা শুধু বাস্তবভূমি থেকে উদ্ভব হলেই চলবে না, এর জন্য দরকার দৃঢ় মন, দৃঢ় মনীষা ও পরিশ্রম ।
যখন কোনও তত্ত্ব সব মানুষকে নিয়ে এগোতে চায়, সকলের কল্যাণ করতে চায়, তখন যারা স্বার্থপরভাবে পৃথিবীতে বেঁচে আছে বা বেঁচে আসছে, তারা সর্বোতোভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে । তাদের পক্ষে এমন করাটাই স্বাভাবিক । এর জন্য তাদের উপর ক্রুদ্ধ হয়ে কোনও লাভ নেই । আবার সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়িত করতে সবাই যে প্রথমে এগিয়ে আসবে, তাও নয়;তারা দুকদম এগোলে তিন কদম পিছিয়ে যাবে । তারপর সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে গেলে তখন আর কোনও বাধা-বিপত্তি টেকে না । এর আগে যত সিদ্ধান্ত, যত থিওরী এসেছে সবাই মানব সমাজের একটা বিশেষ দিকেই নজর দিয়েছে ।
তারা মানব সমাজকে সামগ্রিক হিসাবে দেখেনি । কেউ নজর দিয়েছে শ্রমিক স্বার্থের উপর, কেউ কেউ দেখেছে কেবল পুঁজিপতিদের স্বার্থ । নানান জন সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে তাঁদের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সমাজকে তাঁরা সর্বাত্মকভাবে দেখেননি । সেজন্যে, যারা কেবল একটা দিক নিয়েই এতদিন কারবার করেছে, তারা সামগ্রিক তত্ত্ব নিয়ে যাঁরা চলেছেন তাদের কোনও ভাবে সহ্য করতে পারেন না । তোমাদের একথা মনে রাখতে হবে, যে তোমাদের বিরোধিতা করছে, তাদের বুঝিয়ে তোমাদের অঙ্গীভূত করে নিতে হবে । কারণ এরাও তোমাদের ভাই, তোমাদের আপনজন । তাদের কল্যাণের বীজও তোমাদের দর্শনে নিহিত । যখন কেউ জন্মগ্রহণ করেন, ভাবাত্মক সিদ্ধান্তের আবির্ভাব হয়, তখন তার প্রতিশক্তিও বিরোধিতার জন্যে দাঁড়িয়ে যায় । তোমাদের বিরুদ্ধেও এধরণের প্রতিশক্তি দাঁড়িয়েছিল, দাঁড়াচ্ছে আর ভবিষ্যতেও দাঁড়াবে । আর তোমরা যেহেতু সর্বাত্মক কল্যাণের জন্য কাজ করছ, সেজন্যে কোনও খণ্ড তত্ত্ব শেষ পর্যন্ত টিকবে না । প্রারম্ভিক স্তরে যে বিরোধিতা এসেছিল তোমরা তাতে সসম্মানে জয়লাভ করেছ, আর ভবিষ্যতে ছোট-বড়-মাঝারী ধরণের যে সব বাধা বিপত্তি আসবে তাতেও তোমরা জয়ী হয়ে এগিয়ে যাবে । কারণ, তোমাদের দৃষ্টিভঙ্গী সামগ্রিক ।
বঙ্গোপসাগর, কাম্বে উপসাগর বা কচ্ছ উপসাগর যতই অহঙ্কার করুক না কেন, তাদের একথা ভুললে চলবে না যে তারা ভারত মাহাসাগরেরই অঙ্গ । তেমনই সমস্ত আংশিক চিন্তাভাবনা সামগ্রিক চিন্তারই অঙ্গীভূত । তাই কোনও খণ্ড চিন্তাভাবনাই শেষ পর্যন্ত সামগ্রিক চিন্তার বিরুদ্ধে টিকতে পারে না । যেহেতু এই ধরণের সামগ্রিক চিন্তাভাবনা এর আগে পৃথিবীতে কখনও আসেনি, তাই বাধা কিছুটা বড় মনে হচ্ছে, তবে এতে ঘাবড়ে গেলে চলবে না । প্রয়োজন সাহস আর পরিশ্রমের । তোমরা সাহসী আর পরিশ্রমী হও । জয় তোমাদের হবেই ।
৩১শে অক্টোবর ১৯৭৮, কলিকাতা