শত শরদং জীবতু

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

যেসব দেশ অত্যন্ত ঠাণ্ডা সেই দেশগুলোতেই বসন্ত ঋতুর আবির্ভাব ভাল ভাবে ৰোঝা যায় ও লোকে বসন্ত ঋতুকে ভাল ভাবে খুশী মনে গ্রহণ করে৷ কিন্তু যেসব দেশে শীত প্রচণ্ড নয় সেইসব দেশে শরতেরই কদর বেশী৷ এই ৰাঙলাতেও জ্যোতিষিক মতে যাই হোক না কেন, ছ’টা ঋতুই আছে বটে কিন্তু আসলে তিনটে ঋতু–গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরৎ৷ শীত তো নামে মাত্র৷ গরম জামা বার করতে না করতেই  আবার বাক্সে ভরতে হয়৷ সেই জন্যে এখানে শরৎকালের কদর সবচেয়ে বেশী৷ প্রধান ফসলটাও কেমন হবে শরতেই তার আন্দাজ পাওয়া যায়৷ বাকী বছরটা কেমন যাবে শরতেই  তার আন্দাজ পাওয়া যায়৷ আকাশে শাদা মেঘ আর ধরিত্রীর কুশ–কাশ–শেফালী নূতন এক আমেজ এনে দেয়৷ তাই কেবল যে ভারতবর্ষের সংস্কৃত গ্রন্থেই শরতের মহিমা কীর্ত্তন করা হয়েছে তাই নয়, বেদেতেও কোন মানুষকে আশীর্বাদ করার সময় সেকালে বলা হত ‘‘শত শরদং জীবতু’’৷ ‘‘শত বসন্তং জীবতু’’ বলা হত না অর্থাৎ তুমি যেন এক শ’ শরৎকালে বেঁচে থাক, জীবনে এক শ’টা  এই ধরনের সুন্দর শরৎকাল দেখে যাও৷

এক শ’ বছরের বেশী মানুষ কমই বাঁচত যদিও অষ্টোত্তরীয় জ্যোতিষিক মতে মানুষের আয়ু ধরা হত ১০৮ বছর, বিংশোত্তরীয় মতে ১২০ বছর, কিন্তু এক শ’র বেশী কম মানুষই বাঁচত৷ তাই ওই আশীর্বাদ করা হত ‘শত শরদং জীবতু’৷ আমি কিন্তু বলতে চাই, মানুষ ‘শত শরদং’ কেন, তার চেয়ে বেশী অষ্টোত্তরীয় মত বা বিংশোত্তরীয় মত অনুযায়ী বাঁচুক, ভালভাবে কাজ করে যাবার জন্যে৷ নিজেদের অস্তিত্বকে ঠিকভাবে কাজে লাগাবার জন্যে ‘শত শরদং’ কেন, ‘অষ্টোত্তর শত শরদং’, ‘বিংশোত্তর শত শরদং’ বাঁচুক–আমি তো এই আশীর্বাদই করব৷ আর আমি তোমাদের বলব চেষ্টা করো যাতে আরো বেশী কাল পৃথিবীতে বেঁচে থাক৷ আর বেঁচে থাকাটা যেন কর্মের ভেতর দিয়ে সার্থকতা লাভ করে৷ কাজ বাদে যে বেঁচে থাকাটা তা মরণের চেয়েও হেয়৷ তাই কাজ করবার জন্যে বেঁচে থাক৷

‘‘কুর্ব্বণেবেহ কর্মাণি জিজীবিষেচ্ছতং সমাঃ’’৷

অর্থাৎ কাজ করে যাবার জন্যে ‘শতং সমাঃ’ অর্থাৎ শত বৎসর বেঁচে থাকার আশা পোষণ করো৷ তাই আমিও বলছি, আমিও চাই, তোমরা খুব বেশীদিন বেঁচে থাক৷ শত বৎসরকেও পেরিয়ে যাও, সেটাকেও টপকে যাও আর কাজের ভেতর দিয়ে প্রমাণ রেখে যাও যে একদিন তুমি বলে একটি মানুষ পৃথিবীতে এসেছিল, যথাসাধ্যি কাজ করে গেছল৷ আর কেঁদে জন্মেছিল কিন্তু হেসে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিল৷ তুলসীদাস বলেছিলেন–

‘‘তুলসী জব্ তুম জগ্মে আয়ে হসে জগ্ তুম্ রোয়ে,

এ্যাইসে কাম করতে চলো হঁসো তুম জগ্ রোয়ে৷’’

*    *    *    *

‘‘তুলসী, যখন তুমি প্রথম এলে ধরায়,

     কাঁদলে তুমি, উঠল ধরা হাসি’,

এমন কাজ করো যাতে যাবার বেলায়

     হাসবে তুমি, কাঁদবে জগৎবাসী৷’’

 তোমাদেরও তাই বলব, পৃথিবীতে যতদিন আছ ততদিন যত লোকের দায়িত্ব নিতে পার নাও৷ আর খুশী মনে বেঁচে থাক, খুশী মনে কাজ করো৷ আর পৃথিবী থেকে যে চলে যেতে হবে সেকথা না ভেবেই কাজ করো কারণ অন্যের সেবা করা, বিশ্বের সেবা করা ধর্মাচরণ৷ আর শাস্ত্রে বলেছে, ধর্মাচরণ যখন করবে সেটাকে কর্তব্যৰোধে করবে, বয়সের কথা না ভেবে অর্থাৎ পাঁচ বছরের শিশুও ধর্মাচরণ করবে৷ সবাইকার জন্যে৷ আজকাল কাজ করবার সময় কর্ম–কর্ম, ধর্ম–ধর্ম বিচার করেই করবে৷ সারাদিন ধরে ধেই ধেই করে যদি কেউ নেচে চলে সেটাও কর্ম৷ সারাদিন ধরে সব সময় যদি কেউ হাউ হাউ করে খেয়ে যায় সেই খাওয়াটাও কর্ম৷ ‘ভুজ্’ ধাতুও ক্রিয়া, ‘খাদ্’ ধাতুও ক্রিয়া কিন্তু সে ক্রিয়ার মানে হয় না৷ কাজ এমনভাবে করবে যাতে তা কর্ম হয়, অকর্ম বা বিকর্ম না হয়৷

অকর্ম হচ্ছে যে কর্ম তাকে অথবা অন্যকে জড়ত্বের দিকে নিয়ে যায় বা ক্ষতিগ্রস্ত করে তা’ আর বিকর্ম হচ্ছে কি না, কোন ভাল কর্মকে অর্থাৎ সৎকর্মকে প্রতিহত করবার জন্যে যে বিপরীত কর্ম তা’৷ আর প্রকৃত কর্ম হচ্ছে নিজের ও অন্যের কল্যাণের জন্যে যা করা হয় তা’৷ ‘‘আত্মমোক্ষার্থং  জগদ্ধিতায় চ’ ঃ নিজের মোক্ষের জন্যে ও জগতের হিতের জন্যে যা করা হয় তাই কর্ম৷ এই যে সত্যিকারের কর্ম তা করে যাবার জন্যে শত বছর বেঁচে থাকার ইচ্ছা মনে পোষণ কর৷ শত বর্ষ মানে শত কর্মময় বর্ষ৷ আমিও চাই, ‘‘ত্বং শত শরদং জীবতু’’, ‘যূয়ম্ শত শরদং  জীবন্তু’৷ তোমরা ১০০ বৎসর কাল বেঁচে থাক৷

(দুর্গাষ্টমী, ২৭ সেপ্ঢেম্বর ১৯৯০, তিলজলা, কলিকাতা)