শুভ নববর্ষে আসুন আমরা সংকল্প গ্রহণ করি, নব্যমানবতাবাদের পথ ধরে জাত-পাত-সম্প্রদায় ভুলে সবাইকে সাথে নিয়ে হাতে হাত মিলিয়ে,কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা এগিয়ে চলি৷
আন্তর্জাতিক নববর্ষ ২০২০৷ নববর্ষে সবার কল্যাণ হোক, সকলে ভাল থাকুক৷ সকলেরই শারীরিক, মানসিক, আত্মিক উন্নতি হোক এই শুভকামনা করি৷ বর্ষ শুরুতে এই শুভ সংকল্প নিয়ে আমাদের নতুন করে যাত্রা শুরু করতে হবে৷ পুরাতন দিনগুলির যা কিছু ভুল ত্রুটি সমস্ত শুধরে নিয়ে আমাদের নতুন ভাবে পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে৷ এর জন্যে আত্মসমীক্ষা দরকার৷ এই আত্মসমীক্ষা আত্ম সংশোধনের জন্যে৷ ব্যষ্টিগত ক্ষেত্রে ও সমষ্টিগত ক্ষেত্রে এই উভয় ক্ষেত্রেই এটা করণীয়৷ তবেই সফলতা আশা করা যায়৷
ব্যষ্টিগত ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে আমাদের শরীর, মন ও আত্মা---তিনদিকেই নজর দিতে হবে৷ শরীরকে সুস্থ রাখতে হবে৷ মনের দিক থেকেও আমাদের মজবুত হতে হবে৷ মনে রাখতে হবে জীবন একটা মহৎ আদর্শের প্রবাহ৷ একটা মহৎ আদর্শকে অবলম্বন করেই মানুষ বড় হয়৷ মানুষের জীবনের সাফল্য আসে৷ জীবন সার্থকতার পথে এগিয়ে যায়৷ আর আদর্শ তাই---যা একাধারে আত্মবিকাশ ঘটাতে পারবে, আত্মশক্তির স্ফূরণ ঘটাতে পারবে, জীবনের পরম লক্ষ্যের পানে---পরিপূর্ণতার পানে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে৷ অর্থ রোজগার জীবনের চলার পথে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে রসদ জোগায় ঠিকই, কিন্তু কেবল অর্থ জীবনের সার্থকতা আনতে পারে না৷ জীবনে যথার্থ আনন্দ বা শান্তি দিতেও পারবে না৷ তাই দেহ, মন ও আত্মার চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সামঞ্জস্য রেখেই আমাদের চলতে হবে৷ সেই অনুসারে নববর্ষের শুরুতে আমাদের পরিকল্পনা করে এগোতে হবে৷
এ তো মানুষের ব্যষ্টিগত দিক৷ আর একটা হ’ল সমাজ ও রাষ্ট্রগত দিক৷ যেহেতু মানুষ সামাজিক জীব---তাই সমাজ তথা রাষ্ট্রকে আমরা অবহেলা করতে পারি না৷
প্রভাত সঙ্গীতে বলা হয়েছে---
মানুষ যেন মানুষের তরে সবকিছু করে যায়
একথাও যেন মনে রাখে পশুপাখী তার পর নয়৷
তরুও বাঁচিতে চায়৷
তাই আমরা চারপাশের মানুষের জন্যে ও সবাইকার জন্যে আমাদের ভাবতে হবে৷ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে মিলে মিশে আমাদের এগিয়ে চলতে হবে৷ বিশ্বের সবাই একই পরমপিতার সন্তান৷ সেই অনুসারে সবাই আমাদের ভাইকোন একথা ভুলে গেলে বা ভুল থাকলে চলবে না৷ তাতেই পরমপুরুষ সন্তুষ্ট হবে৷ শুধু মানুষই নয়, পশুপাখী, তরুলতা সবাইকে ভালবাসতে হবে৷ এককথায় আমাদের নব্যমানবতার ভাবনা নিয়ে এগিয়ে চলতে হবে৷ নব্যমানবতাবাদই আজকের নিপীড়িত মানবতার একমাত্র নির্ভরযোগ্য আশ্রয়৷ আজকের দিনে একমাত্র সামাজিক আদর্শ৷
কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার সারা দেশে এন আর সি লাগু করার নাম নিয়ে ও সংসদে সংখ্যাধিক্যেরর জোরে সিএএ আইন পাশ করিয়ে এই আইনকে সর্বত্র কার্যকরী করার কথা ঘোষণা করে অশান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে৷ এর জেরে অসম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু করে উত্তরপ্রদেশ, দিল্লী, ব্যাঙ্গালোর---এমনিভাবে দেশের প্রায় সর্বত্র আগুন জ্বলছে৷ তার ওপর আবার কেন্দ্রীয় সরকার এন পি. আর (ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিষ্টার) নিয়ে নতুন করে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছেন৷ যেন মোদী শাহ জুটি দেশের সমস্ত মানুষের বৈধ নাগরিকত্ব নিয়ে নতুন ভাবে পরীক্ষা নিতে বসেছেন৷ ভারতবর্ষকে হিন্দু রাষ্ট্র করার জন্যে মোদী-শাহ জোট যেন মুখিয়ে আছেন৷ প্রকারান্তে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বিভিন্ন কথাবার্তায় তা সুষ্পষ্ট হয়ে উঠছে৷
কিন্তু মোদী সরকার বুঝছেন না এই বিংশ শতাব্দীতে মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা নিয়ে দেশের সংখ্যাগিিরষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে সাম্প্রদায়িক সেণ্টিমেণ্টের সুড়সুড়ি দিয়ে মাতিয়ে তুলে হিটলারি মানসিকতা নিয়ে দেশ শাসন করা চলে না৷ আজকের প্রাগ্রসর চিন্তাধারায় মানুষ এটা মেনে নেবে না৷ নব্যমানবতার আদর্শ মেনে সাম্প্রদায়িকতার বিভেদ ভুলে সব মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সার্বিক উন্নয়নের পথে চলতে হবে৷ নইলে সমগ্র পৃথিবীর কাছে পরিহাসের পাত্র হতে হবে৷
বিজেপি, এনআরসি ও সিএএ নিয়ে যতই যুক্তির জাল বিস্তার করুক তা যে কত অন্তঃসারশূন্য তা তো প্রাথমিক স্তরে অসম মডেল থেকেই বাস্তবে দেখা যাচ্ছে৷ ওরাই বলুন অসমে এন আর সি করে এই যে ঊণিশ লক্ষ মানষকে নাগরিকপঞ্জী থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে যার মধ্যে প্রায় ১২ লক্ষ হিন্দু ৬ লক্ষ মুসলিম আর বাকীরা অন্যান্য, এদের নিয়ে কি করবেন? ওরা তো হিন্দুত্ববাদের প্রচার করছেন, তাহলে অসমে ১২ লক্ষ হিন্দুর আজ এই দূরবস্থা কেন? কেন হিন্দু মুসলিম সবাইকে অসমে ডিটেনশন ক্যাম্পে পচে মরতে হচ্ছে৷ তাদের ও তাদের পরিবারদের আজ অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে কেন?
যে বাঙালীদের অবর্ণনীয় ত্যাগের বিনিময়ে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করেছে, এই কি তার প্রতিদান? এই বাঙলার ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বিনয়-বাদল-দীনেশ, বাঘাযতীন, প্রীতিলতা, সূর্য সেন, প্রভৃতি স্বাধীনতার জন্যে হাসতে হাসতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন৷ সেই বাঙালীর উত্তর-পুরুষরা ভারতে বিদেশী? বাঙলার বীর বিপ্লবী নেতাজী সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রাম ভারতের জনমন থেকে শুরু করে ভারতের সেনাবাহিনতেও যে বিপ্লবের দাবানল প্রজ্জ্বলিত করেছিল, সেই দাবানলের আতঙ্কেই যে ব্রিটিশরা প্রকৃতপক্ষে ন্যাজ গুটিয়ে ভারত ছেড়ে ব্রিটেনে পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছিল---এই কথা ইতিহাসবিদগণই স্বীকার করেছেন৷ সেই নেতাজীর বাঙলার বাঙালীরাই স্বাধীন ভারতবর্ষে বিদেশী? আর যাদের ভারতের স্বাধীনতার জন্যে বিশেষ কোনও অবদানই নেই অথচ স্বাধীনতার সমস্ত সুফল চেটেপুটে খেয়ে চৈেলছে তারাই এই ভারতের সাচ্চা স্বদেশী? বাঙালীরা এই অন্যায় নীতি কখনোই মেনে নিতে পারে না৷
জাত-পাত-সম্প্রদায়ের ভেদ ভুলে সবাইকে সাথে নিয়ে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে চলতে হবে৷ নববর্ষের শুরুতে নব্যমানবতাবাদের এই আদর্শকেই আমাদের চলার পথের একমাত্র পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করতে হবে৷ আর এর বিরোধী সমস্ত বিভেদমূলক ভাবধারা ---বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম করেই এগিয়ে চলতে হবে৷ অসত্যের সঙ্গে আপোষহীন সংগ্রামের মাধ্যমেই সত্য ও কল্যাণ্যের প্রতিষ্ঠা হয়৷
আজকের এই পূণ্য প্রভাতে তাই শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের প্রভাত সঙ্গীতই হোক আমাদের চলার পথের পরম প্রেরণা---
বৎসর, নব বৎসর তুমি কল্যাণ এনো চারিদিকে
নূতন ভোরের হাতছানিতে নূতন ঊষার নবালোকে৷৷
বৃহক্ষলতারা সবুজে ভরুক, ‘‘
বন্যবশুরা নিরাপদ হোক,
পাখীরা কণ্ঠে অমিয় ভরিয়া উড়িয়া বেড়াক দিকে দিকে৷৷
মানুষে মানুষে ভেদ দূর হোক ,
বুদ্ধির অবক্ষয় রোধ হোক,
শক্তির সর্বনাশ প্রতাপ সংযত হোক সব দিকে৷৷
- Log in to post comments