শ্যামাপ্রসাদের ভাবনায় কি পরিবর্তন এসেছিল?

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধান রহস্য ও শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যু রহস্য স্বাধীনতার ৭২ বছর পরও রহস্যই রয়ে গেল । বর্তমান রাজনীতির আবর্তে সুভাষচন্দ্র অন্তরালেই থেকে যাবেন, কারণ সুভাষ চন্দ্রের  আত্মপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়ের আত্মপ্রকাশ হয়ে যাবে । যে কলঙ্কের কালি থেকে  ডান-বাম-রাম কেউই রেহাই পাবে না । কারণ সেদিন কংগ্রেস, কম্যুনিষ্ট, আর এস.এস সুভাষ বিরোধিতায় সবাই এক  পক্ষ ছিল । স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষের রাজনীতি ডান-বাম-রামের  বিষাক্ত বৃত্তেই আবর্তিত হচ্ছে । তাই সুভাষ নিয়ে কোন পক্ষই মুখ খুলবে না । কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ নিয়ে নীরব কেন বর্তমান কেন্দ্রের শাসক দল? যারা শ্যামাপ্রসাদকেই আঁকড়ে ধরে বাঙলার মাটিতে পা-রাখতে চাইছে ।

স্বাধীনতার পূর্ব মুহূর্তে দেশভাগের সময় শরৎচন্দ্র বসু ও আরো কয়েকজন চেয়েছিলেন দেশকে তিনভাগ করতে অর্থাৎ ভারত পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসে আলাদা অখণ্ড বাঙলা একটি দেশ হবে । সেই সময় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ভেবেছিলেন পূর্ববঙ্গের বৃহত্তম মুসলিম বাঙালীদের হাতে বাংলা ভাষা সংসৃকতি বিপন্ন হবে, হিন্দু বাঙালীরা বিপদে পড়বে, তাই তিনি শরৎচন্দ্রের প্রস্তাবের চরম বিরোধিতা করেন । সেই সময়ের পরিস্থিতি কিছুটা শ্যামাপ্রসাদের ভাবনার অনুকুল ছিল, কিন্তু অন্ধ হিন্দুত্বের মোহে আবদ্ধ শ্যামাপ্রসাদ বুঝতে পারেননি পরিস্থিতি তৈরির পেছনে ছিল গান্ধী, পটেল, নেহেরু,আরএসএস ও কমিউনিষ্টরা । তাই সেদিন কংগ্রেসের বৃহৎ অংশ বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিম ভারতের নেতারা ও কমিউনিস্ট পার্টি শ্যামাপ্রসাদের ভাবনাকে সমর্থন দিয়েছিল । সেই সময় দুই বাঙলার মানুষকে ডাক দিয়ে শরৎচন্দ্র বলেছিলেন ‘ও আমার পূর্ব বাঙলার  মুসলিম বাঙালী ভাইয়েরা করাচি থেকে তোমাদের পাওয়ার কিছু নেই, ও আমার পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালী ভাইয়েরা দিল্লির কাছ থেকে তোমাদেরও পাওয়ার কিছু নেই । সেদিন শরৎচন্দ্রের কথায় শ্যামাপ্রসাদ ও কংগ্রেস কমিউনিষ্ট নেতারা কর্ণপাত করেনি । ফলে  ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে বাঙালা বিভক্ত হয়ে করাচি ও দিল্লি উর্দু ও হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের শাসনে চলে যায় । শ্যামাপ্রসাদ তখনও হিন্দুত্বের মোহে মশগুল, বাঙলার কংগ্রেস কমিউনিষ্ট নেতারা  দিল্লির অঙ্গুলি হেলনে চলছে ।

পাঞ্জাব ও বাঙালী উদ্বাস্তু নিয়ে দিল্লির দ্বিচারিতায় শ্যামাপ্রসাদের মোহ ভাঙতে শুরু করে । ১৯৫১ সালে তিনি জনসংঘ পার্টি তৈরি করেন । ১৯৫২ সালে পূর্ব বাঙলায় ভাষা আন্দোলনে একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস শ্যামাপ্রসাদ এর ভুল ভাঙ্গায় । তিনি বুঝলেন ওপার বাঙলার বাঙালি মুসলিম ভাইদের হাতে আর যাইহোক বাংলা ভাষা সংসৃকতি বিপন্ন নয় । শ্যামাপ্রসাদের এই মনোভাব হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন তার সহগামী হিন্দুত্ববাদী নেতারাও । তাই ১৯৫৩ সালে ঝিলামের ডাকবাংলোয় তার রহস্যজনক মৃত্যুর আজও কিনারা হয়নি । বাঙলার পথে ঘাটে যারা শ্যামাপ্রসাদের প্রেমে গদগদ হয়ে ভাষণ দেয় ৬ বছর তারা দিল্লীর শাসন ক্ষমতায় বসে আছে, কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ এর মৃত্যু নিয়ে একটা কথাও বলেনি । আজ ভাবতে হচ্ছে আরএসএস ও বাঙালী বিদ্বেষী হিন্দুত্ববাদীদের মৌন সমর্থনেই শ্যামাপ্রসাদকে ঝিলামের বাংলোয় বন্দী করা  হয়েছিল । সেই বাঙালী বিদ্বেষীদের যোগ্য উত্তরসূরি অমিত শাহ বাঙলায় আসছে সোনার বাঙলার দুঃস্বপ্ন নিয়ে । বাঙালী আর কতদিন এই দুঃস্বপ্ন দেখবে?