১৯০৬ সালের ১৪ই এপ্রিল, বরিশালে প্রাদেশিক সম্মিলনীর দিন৷ .......বেলা তখন দুটো হাবেলী থেকে বিরাট শোভাযাত্রা চলেছে প্যাণ্ডেলের দিকে৷ শোভাযাত্রার সম্মুখভাগে রয়েছেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মতিলাল ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা৷ তাঁদের পেছনে যুবকবৃন্দ৷ দু’পাশে সশস্ত্র পুলিশ-বাহিনী৷ মিছিলটি কিছু দূর অগ্রসর হতেই একেবারে পিছন দিকের অ্যান্টি সারকুলার সোসাইটির তরুণ সভাদের ওপর রেগুলেশন লাঠি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লো পুলিশ বাহিনী৷
শুরু হলো বেদম মার৷ প্রতিনিধিদের ‘বন্দেমাতরম্’ ব্যাজ ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া হলো৷.... কারো ফাটলো মাথা... কারো ভাঙলো ঠ্যাং.... কারো মচকালো হাত...৷ মারের চোটে চিত্তরঞ্জন গুহঠাকুরতা ছিটকে গিয়ে পড়লেন কাছের পুকুরের জলে৷
ব্যাপারটা তখনো নেতাদের কানে পৌঁছয়নি৷ কারণ, তাঁরা তখন অনেকদূর এগিয়ে গেছেন৷ ললিতমোহন ঘোষাল ছুটে গিয়ে খবর দিলেন, আপনারা আর এগোবেন না৷ পেছনের শোভাযাত্রীদের পুলিশ আক্রমণ করেছে৷
শুনেই তড়িৎবেগে পেছনে ছুটে চললেন সুরেন্দ্রনাথ৷ কিছুদূর এগোতেই পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট মিঃ কেম্পের সঙ্গে দেখা৷ সুরেন্দ্রনাথ তাঁকে বললেন, আমাদের লোকদের আপনারা কেন অকারণে প্রহার করেছেন? তাদের যদি কোন অপরাধ থাকে তো তার জন্য আমি দায়ী৷ আপনি আমায় গ্রেপ্তার করতে পারেন৷
মিঃ কেম্প বললেন,আপনি আমার বন্দী৷ মতিলাল ও ভূপেন্দ্রনাথ বললেন আমাদের বন্দী করুন৷
মিঃ কেম্প বললেন, ‘না৷ কেবল সুরেন্দ্রনাথকেই গ্রেপ্তারের নির্দেশ পেয়েছি৷’
সুরেন্দ্রনাথকে ধরে আনা হলো ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ ইমারসনের ঘরে৷ সঙ্গে এলেন লাকুটিয়ার জমিদার ‘‘বিহারীলাল রায়, অশ্বিনীকুমার দত্ত ও পণ্ডিত কালীপ্রসন্ন কাব্য-বিশারদ৷
কালীপ্রসন্নকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া হলো না৷ বিহারীলাল ও অশ্বিনীকুমার দু’খানা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন৷
দেখাদেখি সুরেন্দ্রনাথও বসতে যাবেন, এমন সময় মিঃ ইমারসন বললেন, আপনি আসামী--- অপরাধী৷ অতএব আপনাকে এখানে আনা হয়েছে বিচারের জন্য, চেয়ারে বসাবার জন্য নয়৷
সুরেন্দ্রনাথও সতেজে বলে উঠলেন, তা বলে মনে করবেন না আমি এখানে অপমানিত হতে এসেছি৷ আমি এখানে ভদ্রোচিত সৌজন্যপূর্ণ ব্যবহারই প্রত্যাশা, করি৷’
মহৎ ব্যাক্তি নিজের দোষ বুঝতে পারলে সব সময় তা শোধরাতে চেষ্টা করেন৷ কিন্তু বদলোকের স্বভাব--- নিজের দোষ কেউ ধরিয়ে দিলে তার ওপর রেগে যাওয়া৷ ইমারসন ছিলেন সে-স্তরেরই লোক৷ তৎক্ষণাৎ তিনি সুরেন্দ্রনাথের নামে অভিযোগের নথিটি পড়ে শুনিয়ে তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে বললেন৷
সুরেন্দ্রনাথ বললেন, আমার কোন অপরাধ নেই৷ কিছু সময় দিলে আমি তা প্রমাণ করে দিতে পারি৷
ইমারসন বললেন--- সে সময় পাবেন না৷ আপনাকে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হবে৷ দু’জনের মধ্যে শুরু হলো বাদানুবাদ৷
সময় বয়ে চলেছে৷ বিতর্কের মীমাংসা কিছুতেই হচ্ছে না৷ তখন নিতান্ত বিরক্ত হয়ে নোয়াখালির ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ লিজ এগিয়ে এলেন৷ সুরেন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, কেন মিছিমিছি গোলযোগ বাধাচ্ছেন? আপনি ক্ষমা চেয়ে নিন৷’
‘বটে ! আমরা কি এতই নির্জীব? চোখ মুখ লাল করে হুংকার দিয়ে উঠলেন সুরেন্দ্রনাথ আর কখনো এ ধরনের উপদেশ আমাদের কাছে দিতে আসবেন না৷ আমরা সে-ধাঁচের মানুষ নই৷’
- Log in to post comments