সাধনার ভিত্তিভূমি নৈতিকতা৷ প্রথমেই মনে রাখা দরকার যে এই নৈতিকতা (morality) সাধকের চরম লক্ষ্য (ultimate goal) নয়, আর এই নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া বা মর্যালিষ্ট হওয়া সাধকের জীবনে এমন কোনো একটা অবস্থা নয় যা অন্য কারুর চরম আদর্শ হতে পারে৷ সাধনামার্গে যাত্রা শুরু করবার ঠিক প্রথম ক্ষণটিতেই সাধকের যে মানসিক সামঞ্জস্যের প্রয়োজন সেটারই নাম নৈতিকতা বা মর্যালিটি৷...
নৈতিক আদর্শগুলো এমন ধারা হওয়া উচিত যাতে করে মানুষ সাধনমার্গে চলবার সামর্থ্যও পায়, প্রেরণাও পায়৷ নীতিবাদ জিনিসটা যখন দেশ–কাল–পাত্রের সামঞ্জস্য বিধানের প্রচেষ্টার ওপর নির্ভরশীল তখন আপাতঃদৃষ্টিতে তাতে দৈশিক, কালিক ও পাত্রিক বিভিন্নতা থাকা হয়তো সম্ভব, কিন্তু নীতিবাদের যেটা চরম কথা হ’ল ব্রহ্মসম্প্রাপ্তি, আর তাই তাতে আপেক্ষিকতার দোষ থাকা কোনক্রমেই সম্ভব নয়৷...
আনন্দমার্গের সাধনাতে এই ৰ্রাহ্মী আদর্শকেই সামনে রেখে প্রথমে নীতিশিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে, কারণ নীতিশিক্ষা ব্যতিরেকে সাধনা অসম্ভব৷ নীতিবর্জিত সাধনা মানুষকে বার বার ভোগের দিকে ঠেলে ফেলে দিতে চাইবে ও যে–কোনো মুহূর্তে তার কষ্টার্জিত মানসশক্তি ক্ষুদ্র ভোগসিদ্ধির জন্যে ধ্বংসাত্মক কার্যে লিপ্ত হতে পারে৷ যোগভ্রষ্ট বা তন্ত্রভ্রষ্ট অজস্র ব্যষ্টির জীবন এইরকম ধারা কলঙ্কেই মসীলিপ্ত হয়ে রয়েছে৷ জোর–জবরদস্তি করে প্রবৃত্তি দমন করে তারা যা যৎসামান্য সম্পদ অর্জন করেছিল, ভোগের তাড়নায় এক মুহূর্তের ভুলেই তারা তার সবটুকুই খুইয়ে বসেছে৷ তাই বলি, সাধনা আরম্ভ করার ঠিক পূর্ব মুহূর্তটিতে সৎনীতি গ্রহণ করতে হবে৷ যে নীতি গ্রহণে পরাঙমুখ সে যেন সাধনামার্গে এসে নিজের ও দেশের অকল্যাণ ডেকে না আনে৷...
নীতিবাদের প্রথম শিক্ষা হ’ল যম–সাধনা৷ যমের অঙ্গ পাঁচটি–অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহ৷ এই পাঁচটি অঙ্গই বিভিন্ন ভাবে সাধককে সংযম শিক্ষা দেয়৷ সংযম শব্দের অর্থ হ’ল নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার৷ সংযম মানে কিছুকে (বৃত্তিকে) হত্যা বা নষ্ট করা নয়৷...
ব্রহ্মচর্য শব্দের প্রকৃত অর্থ ৰ্রহ্মে রত থাকা৷ ‘‘ব্রহ্মণি বিচরণং ব্রহ্মচর্যম্৷’’... ব্রহ্মচর্য সাধনার প্রকৃত তাৎপর্য হ’ল প্রতিটি বস্তু যাকে নিয়ে কাজ করছি বা চিন্তা করছি তাকে জড়বস্তু হিসেবে না দেখে ৰ্রহ্মেরই বিশেষ বিকাশ হিসেবে দেখা৷... এর ফলে প্রেয়সাধনা শ্রেয়সাধনাতে রূপান্তরিত হয়ে যায়, কাম প্রেমে পর্যবসিত হয়৷ অনেকেই শুক্রধারণকেই ব্রহ্মচর্য বলে মনে করে থাকেন৷ তাঁদের মনে রাখা উচিত ‘ব্রহ্ম’ ও ‘চর্য’ এই দু’টি শব্দের কোনটিরই সঙ্গে ‘শুক্র’ শব্দের কোন ভাবগত বা অর্থগত সঙ্গতি নেই৷... অবশ্য একথা খুবই ঠিক যে... মানুষের জীবনে সংযমের প্রয়োজন অত্যন্ত অধিক কিন্তু সংযমের অর্থ প্রাকৃত ধর্মের বিরোধিতা নয়৷ সংযমের অর্থ প্রাকৃত ধর্মেরই যথাযথ অনুশীলন৷... উপবাসের দ্বারা শুক্রের উদ্বৃত্ততা রোধ করার নীতিকে সাধারণতঃ লৌকিক ব্রহ্মচর্য আখ্যা দেওয়া হয়৷ অবিবাহিতের পক্ষে এ লৌকিক ব্রহ্মচর্যের (প্রকৃতপক্ষে এটা কিন্তু ব্রহ্মচর্য নয়) কিছুটা মূল্য আছে৷...
....যমসাধনার যেমন বাকী চারটে অঙ্গের চাইতে ব্রহ্মচর্যের শ্রেষ্ঠতা অধিক, নিয়ম–সাধনায় তেমনি সব চাইতে বেশী মাহাত্ম ঈশ্বর–প্রণিধানের৷ বস্তুতঃ যম–নিয়মের দশটি অঙ্গের মধ্যে আটটি অঙ্গ, বাকী দুইটি অর্থাৎ ব্রহ্মচর্য ও ঈশ্বর–প্রণিধানেরই সাধনাঙ্গ৷ বৈশিষ্ট্যগত বিচারে যম–সাধনা হচ্ছে মূলতঃ লৌকিক ও মানসিক জগতের সাধনা আর নিয়ম–সাধনা লৌকিক ও মানসিক ও আধ্যাত্মিক তিন জগতেই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ৷ নিয়ম সাধনার পাঁচটি অঙ্গ হচ্ছে শৌচ, সন্তোষ, তপঃ, স্বাধ্যায়, ও ঈশ্বর প্রণিধান৷...*
যে সাধক যম–নিয়মের দিকে নজর রেখে চলে ও তৎসহ ব্রহ্মসাধনা করে, বশীকারসিদ্ধি কেবল তার দ্বারাই সম্ভব৷ যারা তা করে না তারা যোগসাধনার দ্বারা ইন্দ্রিয়সমূহের ওপর কিছুটা প্রভাব বিস্তার করার ফলে ক্ষিপ্ত, মূঢ় অথবা বিক্ষিপ্ত–ভৌমিক সমাধির বলে নিজের তথা জগতের ব্যাপকভাবে ক্ষতি করে থাকে৷ সংযম–সাধনা না থাকায় সাধনালব্ধ মানসশক্তিকে তারা নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের প্রয়োজনে নিয়োগ করে৷ অল্পদিন যোগ বা তন্ত্র–সাধনা করার পরে এইসব অসংযমী ব্যষ্টি নিজের ক্ষুদ্রসত্তার প্রতিষ্ঠার খাতিরে বিভিন্ন প্রকার ক্ষতিকর কার্যে লিপ্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেদিকে জড়ত্বের অন্ধকারের পথেই নিয়ে যায়৷ তাই বলা হচ্ছে–ঠিক পথে পরিচালিত হয়ো৷ সংযমের অভ্যাস থাকলে যে যোগ ব্যষ্টি তথা সমষ্টির পক্ষে পরম কল্যাণপ্রদ হয়ে থাকে, বিপথে পরিচালিত হলে বা সংযমের অভাব থাকলে সেই যোগই ব্যষ্টি বা সমষ্টির জীবনে একটি বিপজ্জনক জিনিস হয়ে দাঁড়ায়৷ তাই প্রতিটি মানুষেরই উচিত যম–নিয়মের দিকে কঠোর দৃষ্টি রেখে চলা৷
‘‘নৈব বাচা ন মনসা প্রাপ্তুং শক্যো ন চক্ষুষা৷
অস্তীতি ব্রুবতোন্যত্র কথং তদুপলভ্যতে৷৷’’
সংযমে যার প্রতিষ্ঠা নেই সে ব্রহ্মকে পায়না, তার ব্রহ্ম পুঁথিতে আর বড় বড় বচনেই সীমিত থাকে, অর্থাৎ ব্রহ্মতত্ত্ব বোঝবার মত মানসিক ব্যাপকতা অসংযমী কিছুতেই লাভ করতে পারে না৷