ড্ড পূর্ব প্রকাশিতের পর
এইবার তোমরা বীজমন্ত্র সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বুঝে গেলে৷ সেই রকম একটি বীজমন্ত্র হচ্ছে ‘ত’–যার অর্থ জড়তা, স্থবিরতা৷ তাহলে ‘তন্ত্র’ শব্দের অর্থ দাঁড়াচ্ছে– একটি বিধিসম্মত ও বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে বিস্তার–প্রাপ্তি হচ্ছে ও তার সঙ্গে জড়তা তথা তামসিকতার বন্ধন থেকে মুক্তি ঘটছে৷ সংগ্রামের মাধ্যমে বন্ধন থেকে এই মুক্তিই হ’ল তন্ত্র কথাটার সবচেয়ে বড় তাৎপর্য৷ তোমরা জান, প্রতিটি জৈব সত্তা বন্ধন থেকে মুক্ত হতে চায়৷ বন্ধন থেকে মুক্তির এই অন্তর্নিহিত অভিলাষ থেকেই ধর্মের জন্ম৷ ধর্ম মানেও বিস্তার৷ ধর, কেউ একজন দড়ি বাঁধা অবস্থায় রয়েছে৷ যদি মানুষটির শরীর বিস্তারিত হতে থাকে, ফুলতে থাকে বা আয়তনে ক্রমশঃ বাড়তে থাকে, তাহলে এক সময় দড়িটি ছিঁড়ে যাবে অর্থাৎ বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যাবে৷ তাই ‘তন্ত্র’ শব্দের ব্যাখ্যা হচ্ছে যে প্রক্রিয়া বিস্তার ঘটায় আবার স্থূলতার বন্ধন থেকে মুক্তও করে৷
এখন (পূর্ববর্তী ব্যাখ্যার ভিত্তিতে) অর্থগত ভাবে যোগ ও তন্ত্র কাছাকাছি এসে গেল৷ জীবাত্মা ও পরমাত্মার সংযোগই হচ্ছে যোগ৷ এই সংযুক্তি, এই সম্পূর্ণ একাত্মতা আসবে কী করে? বিস্তারের মাধ্যমেই তথা বন্ধন থেকে মুক্তির মাধ্যমেই তা সম্ভব, যার অর্থ তন্ত্রসাধনার নিরন্তর অনুশীলন করে চলা৷ অধ্যাত্ম সাধনার এই বাস্তবমুখী কাল্ট একমাত্র তন্ত্রেই আছে, অন্য কিছুতে নেই৷ ‘‘প্রার্থনা অর্চনা মাত্রৈব ভ্রমমূলম্’’–প্রার্থনা বা অর্চনা–স্তুতি নয়, আধ্যাত্মিক সাধনাভ্যাসের মাধ্যমেই সফলতা অর্জন করা সম্ভব৷ এই জন্যেই তন্ত্রই সাধনা, সাধনাই তন্ত্র৷*
এখন যোগের মাধ্যমে সাধক কীভাবে সিদ্ধিপ্রাপ্ত হবে? জীবাত্মা পরমাত্মার ভাব নিলে তবেই তো জীবাত্মা তাঁর (পরমাত্মার) সঙ্গে একাত্ম হতে পারবে৷ অণুর পক্ষে ভূমাত্বে পর্যবসিত হওয়া কীভাবে সম্ভব? ভূমাসত্তা তথা পরমপুরুষের একটি অনুপম বৈশিষ্ট্য আছে, আর তা হচ্ছে যেই তার ভাব নেয় সেই পরমপুরুষ হয়ে যায়৷ মনের স্বভাবই হচ্ছে মন যা চিন্তা করে মন তাই হয়ে যায়৷ মন যদি শুধু টাকারই চিন্তা করে তাহলে মানসধাতু ক্রমশঃ জড়ত্বে পরিণত হতে হতে একদিন জড় অর্থেরই রূপ নিয়ে নেবে৷ মৃত্যুর পরে তার হয়তো স্থান হবে একজন সুদখোর মহাজনের লোহার সিন্দুকে৷ এটা কি বাঞ্ছনীয়? –না, নিশ্চয়ই নয়৷
‘‘যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী’’–এক প্রকারের জীব আছে যার খাদ্য তেলাপোকা৷ যখন সেই জীব তেলাপোকার সামনে আসে, তেলাপোকা ভীষণভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে, অত্যধিক ভয়ের ফলে তার স্নায়ুতন্তু কাজ করা বন্ধ করে দেয় আর তার ভয় যখন আরও তীব্র হয়, তেলাপোকার স্নায়ুকোষও কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে৷ তীব্র ভয়ের ফলে তেলাপোকার মনে সেই রাক্ষুসে জীবটির চিত্র তৈরী হয়ে যায়৷ এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে এক সময় তেলাপোকার স্নায়ুকোষ সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যায় (সেই জীবটির রূপ নিয়ে নেয়)৷ সেই রূপান্তরণ যখন স্নায়ুতন্তুতে পৌঁছে যায় তখন শেষ পর্যন্ত সেই খাদক জীবটি দেখে যে তেলাপোকাটি তার সমগোত্রীয়৷ সেই জীবটি যখন বোঝে যে তেলাপোকাটি তারই গোষ্ঠীভূক্ত, তখন তাকে সে খাবে কী করে? ঙ্মএইভাবে তেলাপোকা বেঁচে যায়ক্ষ৷ তেমনি মানুষও যদি পরমপুরুষের ভাবনা নেয় তাহলে সে পরমপুরুষই হয়ে যায়৷
এখন প্রশ্ণ হচ্ছে, মানুষ কীভাবে পরমপুরুষের ভাবনা নেবে? জ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করবেন–‘‘পরমপুরুষ এই রকম, ওই রকম’’ ইত্যাদি৷ কর্মযোগীরা বলবেন–‘‘পরমপুরুষ হচ্ছেন সমস্ত কর্মের প্রভু’’৷ ভক্তের আর জ্ঞানের সঙ্গে কি সম্পর্ক? তাই ভক্ত ভাবে, ‘‘আমি সৎ মানুষ হতে পারি, আমি দরিদ্র হতে পারি, আমি পণ্ডিত বা মূর্খ যাই হই না কেন, হে প্রভু, আমি শুধু তোমারই৷’’ ভক্ত পরমপুরুষকে তার নিকটতম ও প্রিয়তম সত্তা বলেই মনে করে৷ সে মনে করে ‘‘পরমপুরুষ আমার, শুধু আমার’’৷ এই ভাবানুভূতির (ideation) প্রক্রিয়া নিরন্ত্রর চলতে থাকায় তার মনও বিস্তারিত হতে থাকে৷ ভাবসাযুজ্যের এই তীব্রতার জন্যেই সেই মানুষটি পরমপুরুষের সঙ্গে এক সময় একাত্ম হয়ে যায়৷ সেই ভক্তিসম্পদ সমৃদ্ধ মানুষটিকেই বলব ভক্ত৷
এইভাবে আমরা দেখলুম যে জ্ঞানীরা (ideation) তান্ত্রিক, কেননা জ্ঞানার্জনের মধ্য দিয়ে তারা মনের বিস্তার ঘটায়, পরমপুরুষের দিকে এগিয়ে চলে৷ কর্মীরাও ঙ্মকর্মযোগীরাওক্ষ তান্ত্রিক, কেন না কর্মের মাধ্যমে তারা মনের বিস্তার ঘটিয়ে পরমপুরুষের পানে অগ্রসর হতে থাকে৷ ভক্তরাও ঙ্মভক্তযোগীরাওক্ষ অবশ্যই তান্ত্রিক, কেন না পরমপুরুষের প্রতি তাদের ভালবাসা তথা ভক্তি এত তীব্র হয় যে সব সময় তাঁর কথা ভাবতে ভাবতে পরমপুরুষই হয়ে যায়৷ তাই তন্ত্র ও যোগের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোন পার্থক্য নেই৷ (জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি–যোগেরও তিনটি প্রধান শাখা৷)৷
কিন্তু এ ব্যাপারে একটা কথা আছে৷ মানুষের জীবন অত্যন্ত সীমিত৷ কেউ যদি জ্ঞানচর্চায় মেতে থাকতে চায় তাহলে সে যথেষ্ট সময় নাও পেতে পারে৷ যদি কেউ পাঁচ–ছয় বছর বয়স থেকেও জ্ঞানচর্চা শুরু করে তাহলেও তা যথেষ্ট হবে না৷ জ্ঞানের পরিধি অনন্ত কিন্তু জীবন সীমিত৷ কেউ যদি তার সমস্ত শক্তি–সামর্থ্য পরমপুরুষ ছাড়া অন্য কিছু পাবার জন্যে নিয়োজিত করে তাহলে সেই মানুষটির সময়ের সদুপযোগ হয় না, বরং দুরুপযোগই হয়৷
‘‘মথিত্বা চত্বারো বেদান্ সর্বশাস্ত্রাণি চৈব হি৷
সারন্তু যোগীভিঃ পিতং তক্রং পিবন্তি পণ্ডিতাঃ৷৷’’
চারিবেদ ও সমস্ত শাস্ত্র সমুদ্রের মতো বিশাল৷ ঠিক যেমন দধি মন্থন করে আমরা ঘোল থেকে মাখনকে পৃথক করে নিই, ঠিক তেমনই শাস্ত্র–সমুদ্র মন্থন করে মাখন ওপরে উঠে আসে আর বাকী তরল অংশ (তক্র) নীচে থেকে যায়৷ যারা প্রকৃত ভক্ত তারা মাখনটা খেয়ে নেয় আর তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের মধ্যে ঘোলের বণ্ঢন ব্যবস্থা নিয়েই ঝগড়াঝাঁটিতে মত্ত হয়ে থাকে৷ আর শেষ পর্যন্ত দেখা যায় সেই ঘোলও নষ্ট হয়ে গেছে, খাবার যোগ্য আর থাকে না৷ (ক্রমশঃ)
*‘‘তন্ত্রই সাধনা সাধনাই তন্ত্র’’ নামে লেখকের বহুল প্রচারিত একটি পুস্তক আছে৷ এতে প্রকৃত তন্ত্রসাধনা কী, তা যে নিছক মারণ, উচাটন, বশীকরণ, সম্মোহন ইত্যাদির সমাহার মোটেই নয়, এই তন্ত্রই মূল সাধনা–পদ্ধতি তা বিস্তৃতভাবে অন্তর্ভুক্ত আছে৷ পুস্তকখানি দ্রষ্টব্য৷
–সম্পাদক৷