যথার্থ উন্নয়নের চাবিকাঠি

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

সংসদে শ্রম দপ্তরের তথ্যে প্রকাশ দেশে বেকারত্বের জ্বালায় আত্মহত্যার প্রবণতা বেশী৷ বছর দুয়েক আগে কেন্দ্রীয় সরকারের ন্যাশন্যাল সাম্পেল সার্ভের রিপোর্ট থেকে জানা যায় গত ৪৫ বছরের মধ্যে দেশে গত ২০১৭-১৮ সালে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশী৷ আর তা হলো ৬.১ শতাংশ৷ ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে ১৫ থেকে ২৯ বৎসর বয়সীদের মধ্যে বেকার সমস্যা ভয়ঙ্কর৷ মোদিজীর ক্ষমতায় আসার আগে ২০১১-১২ আর্থিক বছরে বেকারত্বের হার ছিল যুবক যুবতীদের মধ্যে যথাক্রমে ৫ শতাংশ ও ৪.৮ শতাংশ৷ আর ২০১৭-১৮ আর্থিক বছরে গ্রামীণ যুবক যুবতীদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১৭.৪ শতাংশ ও ১৩.৬ শতাংশ৷ আর শহরের যুবক যুবতীদের মধ্যে বেকাত্বের হার হয়েছে ওই সময়ের মধ্যে যুবকদের ক্ষেত্রে ৮.১ শতাংশ (২০১১-১২) থেকে ১৮.৭ শতাংশ (২০১৭-১৮) আর যুবতীদের মধ্যে ১৩.১ শতাংশ থেকে ২৭.২ শতাংশ৷

সরকার বলছেন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন দ্রুত হচ্ছে, জিডিপির হারও বেড়ে চলেছে৷ তাই যদি হয় তাহলে বেকার সমস্যা বেড়ে চলেছে কেন? তার মানে বোঝাচ্ছে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি না হলেও দেশের বিত্তবানদের আর্থিক উন্নতির হার এত বৃদ্ধি পাচ্ছে যে গড় হারও বেড়ে চলেছে৷ অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিচারে এটা দেশের পক্ষে সুখবর মোটেই নয়, বরং এটা অশনি সংকেত৷ দেশের মধ্যে বিরাট বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পূর্বাভাস৷ করোনার আগে থেকেই বিভিন্ন আর্থিক সংস্থার প্রতিবেদনে ধন-বৈষম্যের করুন চিত্র প্রকাশ পেয়েছে৷ ১ শতাংশ ধনী মানুষের হাতে আছে, দেশের ৫৮ শতাংশ সম্পদ৷ আর এ দেশের মাত্র ৫৭ জন কোটিপতির হাতে আছে ২১৬ বিলিয়ন ডলার৷ যা দেশের ৭০ শতাংশ মানুষের সম্পত্তির পরিমানের সমান৷

দেশের মুষ্টিমেয় ধনী মানুষের রোজগার বিপুল পরিমানে বেড়ে চলেছে৷ তাদের হাতে দেশের অধিকাংশ সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে, আর বাকী জনগণ নানাভাবে অভাবের তাড়নায় ভুগছে, শুধু তাই নয়, ধনিক শ্রেণী তাদের হাতে জমে ওঠা পাহাড় প্রমাণ সম্পদের অপব্যবহার করে দেশের সামাজিক , রাজনৈতিক, সাংসৃকতিক ক্ষেত্রকে কলুষিত করছে ও শোষণ বঞ্চনার ডিপোতে পরিণত করছে৷ পুঁজিপতিরা জনগণের পরিশ্রম লব্ধ সম্পদ শোষণ করে৷ তারা অর্থশক্তি ও তার দ্বারা আবার এক শ্রেণীর সমাজ বিরোধীর পেশীশক্তিকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতির ক্ষেত্রে অযোগ্য প্রার্থীদের জিতিয়ে এনে তাদের হাতে শাসন ক্ষমতা তুলে দিচ্ছে৷ বলাবাহুল্য এরপর ঐ বশংবদ শাসকদের দিয়ে তারা তাদের শোষণপ্রক্রিয়াকে অবাধ ও নিরঙ্কুশ করে তুলছে৷ সামাজিক সাংসৃকতিক সর্বক্ষেত্রেই এইভাবে তারা তাদের শোষণ প্রক্রিয়াকে চালু রেখেছে৷ তাই এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, এই সব পুঁজিপতিদের হাতে ক্রমবর্ধমান হারে দেশের সম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়াটা মোটেই কাম্য নয়৷ দেশের পক্ষে এটা ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক৷ এই কারণেই প্রাউট-প্রবক্তা মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তার প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বের প্রধান পাঁচটি উপযোগ নীতির প্রথমটিতেই বলেছেন,সমাজের স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত জাগতিক সম্পদের অবাধ সঞ্চয় চলবে না৷ গ্রামাঞ্চলে চাষীর জমির ক্ষেত্রে সিলিং রয়েছে, তাহলে অন্যান্য সম্পদ সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে কেন সিলিং থাকবে না? বিশ্বের জাগতিক সম্পদের পরিমাণ সীমিত৷ এই সীমিত পরিমাণ সম্পদ একস্থানে যদি বিপুল পরিমাণে সঞ্চিত হয়, অন্যক্ষেত্রে সম্পদের অভাব দেখা দেবেই৷ তাই সামাজিক কর্তৃপক্ষের সুষ্পষ্ট অনুমতি বা অনুমোদন ব্যতিরেকে কাউকে ভৌতিক সম্পদ সঞ্চয় করতে দেওয়া উচিত নয়৷ ওই সামাজিক কর্তৃপক্ষ (অবশ্যই তাদের কঠোর নীতিবাদী হতে হবে) সঙ্গত প্রয়োজন অনুসারে কাউকে সীমিতভাবে সম্পদ সঞ্চয় করার বিশেষ অনুমতি দিতে পারে৷ তা কেবল ওই বিশেষ প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে৷

তবে জাগতিক সম্পদ বা অর্থ সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে কড়া নিয়ন্ত্রণ থাকলেও মানসিক সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত নয়৷ কারণ মানসিক সম্পদ অর্র্থৎ জ্ঞান সম্পদ একজন বেশী সঞ্চয় করলে অন্যের অভাব পড়বে না৷ তেমনি আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেও মানুষের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করা চলবে না৷

মাকর্সবাদ সর্বক্ষেত্রে ব্যষ্টি-স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে’ মানুষকে ক্রীতদাসে পরিণত করতে চেয়েছিল৷ তাই মাকর্সবাদকে হঠে যেতে হ’ল৷

প্রাউটের এখানেই বৈশিষ্ট্য৷ প্রাউট জাগতিক সম্পদ সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলেও মানসিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে মানুষের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করতে চায় না৷

প্রাউট চায় জাগতিক সম্পদের সর্বাধিক উপযোগ ও যুক্তি সংযত বন্টন৷ সমাজের প্রতিটি মানুষ এর দ্বারা উপকৃত হোক৷ এর মাধ্যমে প্রতিটি মানুষ যুগানুসারে তার জীবনের ন্যূনতম চাহিদা মেটাক৷ তার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন মানুষের শারীরিক ও মানসিক ক্ষেত্রে শ্রমের মর্যাদাও প্রাউট দিতে চায়৷ আবার তার সঙ্গে সঙ্গে এও বলছে, ন্যূনতম প্রয়োজনের মানের বৃদ্ধি ঘটানোর প্রক্রিয়াকে গুরুত্ব দিতে হবে৷ সর্বসাধারনকে বিভিন্নক্ষেত্রে সর্র্বধিক সুযোগ ও সুবিধাদানেরও ব্যবস্থা করতে হবে৷ দেখতে হবে যোগ্যতা অনুসারে মানুষের মধ্যে বন্টনের পার্থক্য কিছুটা থাকলেও এই পার্থক্য বেশী হওয়া বাঞ্জনীয় নয়৷

মোট কথা,দেশের যথার্থ আর্থিক উন্নয়ন মানে  জিডিপি-র হার বৃদ্ধি নয় বা গড় মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির নামে ধনিক শ্রেণীর বিপুল পরিমাণ আয়বৃদ্ধিকে দেশের উন্নয়ন বলা যাবে না৷ দেশের সর্বসাধারণের কর্মসংস্থান ও তাদের রোজগার বৃদ্ধি তথা জীবনধারণের মানবৃদ্ধির মধ্যেই রয়েছে দেশের যথার্থ উন্নয়নের চাবিকাঠি৷