যুব সমাজ, শালীনতাবোধ ও অতি আধুনিকতা

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

প্রায় দশ লক্ষ বছর পূর্বে পৃথিবীর বুকে প্রথম মানব জাতির আবির্ভাব৷ সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষেরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বানর, শিম্পাঞ্জী, কুকুর, ছাগলের মতই নগ্ণাবস্থাতেই ঘুরে বেড়াতেন৷ পরবর্তীকালে সময়ের বিবর্তনে মানুষের রুচিবোধ ও চিন্তা-ভাবনায় এসেছে পরিবর্তন---দেহকে আবৃত করার সচেতনতা৷ গাছের পাতা, বাকল, মৃত পশুর চামড়ার পথ ধরে বিজ্ঞানের অগ্রগতি বর্তমানে এনেছে বহুবিধ অঙ্গাবরণ৷ পৃথিবীর নানা দেশের ভৌগোলিক পরিবেশ, জলবায়ুর বিভিন্নতা, জীবনযাত্রা, রুচিশীলতা, আচার-ব্যবহার, কৃষ্টি-সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে ব্যবহৃত হয় বিবিধ পোশাক-পরিচ্ছদ৷ বর্তমানে পোশাক শুধুমাত্র অঙ্গাবরণই নয়-রুচিবোধ, শালীনতা ও সৌন্দর্যের প্রতীকও বটে৷ বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিচায়ক হিসেবে নিজস্ব পোশাক ও পরিধান-বিধি নির্দিষ্ট রয়েছে৷ ফলে পোশাক-পরিচ্ছদের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের ও জনগোষ্ঠীর মানুষজনকে অনায়াসেই আমরা চিনে ফেলতে পারি৷

মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে পোশাক-পরিচ্ছদ সম্পর্কিত মতামত ও বিতর্ক পরিলক্ষিত হয়৷ অনেকেই পরিধেয় সম্পর্কে ব্যষ্টি-স্বাধীনতার পক্ষপাতী---আবার অনেকে ভিন্নমতও প্রকাশ করেন৷ ব্যষ্টি পরিসরে অবশ্যই ব্যষ্টি-স্বাধীনতার গুরুত্ব রয়েছে যদি না তা স্বেচ্ছাচারের পর্যায়ে পড়ে৷ শুধু তাই নয়, পোশাক অনেক ক্ষেত্রেই মনের আয়না স্বরূপ৷ মনের ভাবনা, রুচিবোধ, সংযম ও শালীনতা পোশাকের মাধ্যমে পরিস্ফূট হয়৷ পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের ক্ষেত্রে পোশাক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে৷ একজন মানুষের কথাবার্তা ও শব্দ প্রক্ষেপন অপরাপর মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে৷ নম্র, মধুর ও সংযত বাক্যালাপ সেই সম্পর্ককে মধুর ও স্থায়ী করতে সক্ষম হয়---অপরদিকে রূঢ়, দাম্ভিকতাপূর্ণ, কদর্য ভাষা মানবিক সম্পর্ককে কলুষিত ও বিষাক্ত করে তোলে, এমনকি এর ফলে চরমতম বিপর্যয়ও সংঘটিত হতে পারে৷ একইভাবে মার্জিত, রুচিশীল, শালীনতাযুক্ত পোশাক-পরিচ্ছদ অপরাপর মানুষজনের মনে সম্ভ্রম, শ্রদ্ধা ও শুভ ভাবনার উদ্রেক করে, সাত্ত্বিক আকর্ষণজনিত সম্পর্ক স্থাপনে সহায়ক হয়---অপরপক্ষে উগ্র, উত্তেজক পোশাক-পরিচ্ছদ অন্যান্য মানুষের মনে কু-প্রবৃত্তি ও তামসিক আকর্ষণ জাগ্রত করে যার ফল অকল্যাণকর হতে বাধ্য৷ প্রতিটি মানুষকে একথা অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে যে পোশাক শুধুমাত্র অঙ্গাবরণই নয়, অঙ্গাভরণও বটে যা মানুষকে সম্মান, আত্মমর্যাদা ও স্বকীয়তার বৈশিষ্ট্য প্রদান করে৷ সেই কারণে স্বাধীনতার নামে শালীনতাবর্জিত স্বেচ্ছাচারকে প্রশ্রয় না দিয়ে সমাজের পক্ষে যা মঙ্গলদায়ক, সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য ও কল্যাণমুখী---তাকেই  প্রোৎসাহিত করা প্রয়োজন৷

পোশাক-পরিচ্ছদ সভ্যতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্যের ধারক ও বাহক৷ এই জন্যেই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জনকল্যাণমূলক সংঘটন, আধ্যাত্মিক সংস্থার নির্দিষ্ট পোশাক বিধি রয়েছে---আর এই পোশাক বিধি তাদের আচার-ব্যবহার, মননশীলতা, সংবেদনশীলতা ও ঐতিহ্যের পরিচিতি বহন করে৷ এছাড়া বিভিন্ন দেশে জনগণের নিজস্ব সংস্কৃতি ও বৈশিষ্ট্য অনুসারে পোশাক-রীতি প্রচলিত রয়েছে৷ আমাদের দেশ ভারতবর্ষ সুপ্রাচীনকাল থেকেই আধ্যাত্মিকতার ঐতিহ্যমণ্ডিত ও মুনীঋষি মনীষীগণের দেশ হিসেবে সমগ্র বিশ্বে স্বীকৃত৷ তাই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যুগে যুগে বহু মানুষ শান্তিময় জীবন লাভের আশায় এই দেশে এসেছেন---পাশ্চাত্যের বিলাস-ব্যসন পরিত্যাগ করে ভারতের সুমহান ঐতিহ্যের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সরল জীবনযাপনকে বরণ করে নিয়েছেন৷ অতি সাম্প্রতিককালের একটি ঘটনা---গত ১০ই ডিসেম্বর ২০১৯ সুইডেনের স্টকহলমে নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বাঙালী অর্থনীতিবিদ শ্রীযুক্ত অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় (কর্মসূত্রে পাশ্চাত্য প্রবাসী) ও তাঁর সুযোগ্যা পত্নী অর্থনীতিবিদ শ্রীমতী এস্থার ডুফলো (বিদেশী নাগরিক) বাঙালী পোশাক ধুতি ও শাড়ীতে সজ্জিত হয়েই যোগদান করে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন৷ বাঙালী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও জন্মসূত্রে পাশ্চাত্য রমনী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর পত্নী একজন ‘‘বাঙালী বধূ’’ হিসেবে বাঙালী পোশাককে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মঞ্চে স্ব-মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন যা প্রতিটি বাঙালীর অনুকরণ ও অনুসরণযোগ্য৷ অনুকরণ যদি করতেই হয় তবে উগ্র, উত্তেজক পাশ্চাত্য পোশাকের ব্যবহার না করে বাঙালী বন্দ্যোপাধ্যায় দম্পতির অনুকরণ করাই শ্রেয় ও সম্মানার্হ৷

ভারতবর্ষের এত উন্নত সাংসৃকতিক ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় সমাজে কেন এত অবক্ষয়, যুব সমাজ কেন বিভ্রান্ত, আন্দোলন বিমুখ? বর্তমান পৃথিবীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চালচিত্রের প্রতি দৃক্পাত করলেই হয়তো এই প্রশ্ণের উত্তর পাওয়া সম্ভব হবে৷ আজকের পৃথিবীতে চলেছে বিভিন্ন ছদ্মনামে ধনতান্ত্রিক শোষণ ও শাসন৷ এ পর্য্যন্ত পৃথিবীতে পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদ এই দুই ধরণের অর্থনীতি প্রচলিত থাকলেও তথাকথিত সাম্যবাদ বা কমিউনিজম্ ক্রমশঃ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে চলেছে৷ আর যে কয়টি দেশ নিজেদের কমিউনিষ্ট রাষ্ট্র বলে মনে করে তারাও রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদে পর্যবসিত৷ ফলে সমগ্র বিশ্বই আজ পুঁজিবাদের করায়ত্ত আর ধনতান্ত্রিক শোষণ চালিয়ে যাওয়ার জন্যে ছলে-বলে-কৌশলে বিভিন্ন দেশের শাসন যন্ত্রকে পুঁজিপতিরা অর্থশক্তির প্রাবল্যে নিজেদের কুক্ষিগত করে রেখেছে৷ সমস্ত ন্যায়-নীতিকে বিসর্জন দিয়ে পুঁজিবাদীর দল শুধুমাত্র মুনাফার জন্যে যে কোন রকম দুর্নীতির আশ্রয় নিতেও কুণ্ঠিত নয়৷ পুঁজিবাদী বহুজাতিক সংস্থাগুলি অর্থের জোরে যুবসমাজ ও ছাত্রসমাজকে অসংস্কৃতি ও অনৈতিকতার দিকে এগিয়ে যেতে প্ররোচিত করে চলেছে৷ কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিভিন্ন ধরণের হুজুগে মাতিয়ে যুবশক্তিকে ধবংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে৷ যুব সমাজ যাতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সচেতনতা প্রয়োগ করে পুঁজিবাদীদের অসৎ উদ্দেশ্য সাধনে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সমাজের প্রকৃত কল্যাণে শোষকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন না করে---সেই কারণে বহুবিধ প্রলোভন ও অসংস্কৃতির পথে তাদের পরিচালিত করছে৷ এই সবের ফলে আজকের সমাজে যুব সম্প্রদায় ও ছাত্র-ছাত্রাদের বিভিন্ন ভাবে ব্যস্ত ও প্রলুব্ধ রাখার ফন্দি-ফিকির উদ্ভাবন করার জন্যে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে৷ সিনেমা, টেলিভিশন-সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকাদের বহুবিধ উগ্র ও অর্ধনগ্ণ পোশাক-পরিচ্ছদ, কেশরঞ্জন, কেশবিন্যাস ইত্যাদির দ্বারা কিশোর মনকে প্রভাবিত করে সেই নেশাতেই বুঁদ রাখার মতলবে পুঁজিপতিরা অর্থের যোগান দিচ্ছে৷ পুঁজিপতিদেরই অর্থে আজ ক্রিকেট, কাল ফুটবল, বাকি সময় অন্যান্য উত্তেজক বিনোদনের মাল-মশলা ছড়িয়ে সংবাদ মাধ্যম ও ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা ও বিজ্ঞাপনী প্রচার তুঙ্গে তুলে যুবমানসকে আবদ্ধ করে রাখা হচ্ছে৷ এর সঙ্গে ফেসবুক, ইউ-টিউব ও অন্যান্য সমাজ মাধ্যমে বিভিন্ন কুরুচিকর নগ্ণ ও স্বল্পবসন পরিহিত নরনারীর কদর্য কার্যকলাপ প্রভৃতির দ্বারা ছাত্র-যুবদের গৃহবন্দী ও মোবাইল বন্দী করে রাখার ব্যবস্থাপনা চলেছে৷ এককথায় প্রচণ্ড শক্তিশালী যুব চেতনাকে বিকশিত হওয়ার কোন সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না৷ এই উদ্দেশ্য সাধনে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, প্রশাসনযন্ত্র ও বিভিন্ন সংস্থাকেও কাজে লাগাানো হচ্ছে৷ কখনও উগ্র জাতীয়তাবাদ, কখনও ধর্মের নামে মন্দির-মসজিদ্ সংক্রান্ত সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি, রাজনৈতিক দলাদলির আড়ালে খুন-জখম, অশালীন অপকর্মে জড়িয়ে দিয়ে এক পঙ্কিল আবর্তে নিমজ্জিত করে ছাত্র ও যুব সমাজকে ব্যতিব্যস্ত রাখা হচ্ছে---তাদের কোন উন্নত আদর্শের পথে চলার গতিকে বিভিন্ন ভাবে ব্যাহত করা হয়েছে৷ যদি কখনও কোন শুভ শক্তি সমাজের মঙ্গলের জন্যে যুব শক্তিকে জাগ্রত করতে এগিয়ে আসে তবে প্রশাসনিক ক্ষমতা, পেশীশক্তি ও অর্থশক্তির দ্বারা সেই প্রচেষ্টা সমূলে উৎপাটিত করার চক্রান্ত রচনা করা হয়৷পুঁজিবাদী আগ্রাসনের চাপে মানুষের সুস্থ সংস্কৃতি, মননশীলতা, রুচিবোধ ও শুভচিন্তা পদে পদে অবদমিত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত হয়ে চলেছে৷

এমতাবস্থায় আজ সমাজের সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে একত্রিত হয়ে যুব সমাজ তথা সমগ্র সমাজকে সার্বিক অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসতেই হবে ও আধ্যাত্মিকতাভিত্তিক মহৎ আদর্শের পথে চলার শপথ গ্রহণ করতে হবে৷ মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার প্রবর্ত্তিত ‘প্রাউট’ PROUT—Progressive Utilization Theory) বা ‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’ বর্তমান পৃথিবীর এই সমস্যা ও আগামী প্রজন্মের সকল সমস্যার সমাধানের পথ নির্দেশনা নিয়ে মানুষের সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে৷ এই দর্শনের মূল কথা হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা, বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও নীতিবাদী আপোষহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব৷ প্রাউটের বৈশিষ্ট্য হ’ল---‘আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বৈকতাবাদের প্রতিষ্ঠা’, যার প্রথম ধাপ ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘটন’-এর মাধ্যমে বিকেন্দ্রিত অর্থনীতি প্রবর্ত্তন৷ এর ফলে একশত শতাংশ স্থানীয় কর্মসংস্থান ও সুনিশ্চিত ক্রয়ক্ষমতার দ্বারা মানুষের নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্ত্তির নিশ্চিততা প্রদান সম্ভব হবে ও তথাকথিত পুঁজিবাদের মূলে কুঠারাঘাত করে ধবংস করা যাবে৷ সমবায় ব্যবস্থার মাধ্যমে সমগ্র অর্থনীতিকে পরিচালিত করবার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব থাকবে নীতিবাদীদের হাতে যাদের বলা হয় সদ্বিপ্র৷ বর্তমান সমাজের অবক্ষয় ও অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে হলে সমস্ত কল্যাণকামী মানুষকে সদ্বিপ্রের নেতৃত্বে ‘প্রাউট’-এর প্রতিষ্ঠায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে---একমাত্র তখনই যুব সমাজের সামনে মহৎ আদর্শকে তুলে ধরা সম্ভব হবে ও আধ্যাত্মিকতাভিত্তিক সুস্থ সংস্কৃতিযুক্ত মানব সমাজ রচনা সম্ভব হবে৷