প্রভাতী

গোবর গণেশ গায়েন

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

 যে সোজা পথে চলে না, মার প্যাঁচ করে দিন কাটে সে কুট্টনী........কুটনী৷ এই কুট্টনীর স্বভাবসংক্রান্ত ব্যাপারকে বলব কৌট্টনী বা কৌট্টনিক৷ কুট্টনীূণ্ঞ্চকৌট্টনী আর কুট্টনীূঠক্ঞ্চকৌট্টন্৷ এই মার প্যাঁচ সংক্রান্ত বিদ্যাকে বলা হয় কুট্টনী বিদ্যা বা কৌট্টনী বিদ্যা৷ যারা গোমরামুখো, যারা ‘‘রাম গরুড়ের ছানা হাসতে তাদের মানা’’ তাদের সম্বন্ধে কথ্য বাংলায় বলা হয় কুট্টনী–মুখ৷

এ প্রসঙ্গে আমার একটি পুরোনো গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে৷

আমার বিশেষ পরিচিত জনৈক রেল–ফিসার ছিলেন–ধরো, তাঁর নাম গোবর গণেশ গায়েন৷ ভদ্রলোক সব সময় মুখ বেঁকিয়েই থাকতেন৷ আমি যখন লোকের আড়ালে বলতুম–‘‘হ্যাঁরে, অমন গোমড়া মুখ করে থাকিস কেন’’ সে বলত–‘‘হাসলে লোকে আমার মাথায় চড়ে বসবে, আমাকে মানবে না৷’’

আমি বলতুম–‘‘আচ্ছা না হয় হাসলি না, কিন্তু কথা বলিস না কেন’’ সে বলত–‘‘কথা বললে সস্তা হয়ে যাব৷’’

আমি বলতুম–‘‘সেজন্যে তুই দূরে থেকে খাস্তা থাকতে চাইছিস’’ সে না হেসে বলত–‘‘হ্যাঁ’’৷

একবার আমাদের একটা ৰড় রকমের পিকনিক হয়েছিল৷ পোলাও–কালিয়া ও ভাল–মন্দ খাবারের এলাহী ব্যাপার৷ কাশী থেকে এসেছিল লাউয়ের আকারের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড শীতের বেগুন৷ রান্নাবান্না হয়ে যাবার পর দেখা গেল পঞ্চাশ/ষাটটা ৰড়ৰড় বেগুন ৰাড়তি হয়েছে৷ সবাই মিলে ঠিক করা গেল এই বেগুনগুলো পুড়িয়ে পোলাও–কালিয়ার মাঝে মাঝে খেয়ে মুখ পালটে নেওয়া যাবে৷ যেমন ভাবা তেমনি কাজ৷ খেতে বসে প্রথমেই পরিবেশন করা হ’ল বেগুন পোড়া৷ সবাইকে উৎসাহ দেবার জন্যে শ্রীমান গোবর গণেশ গায়েনের মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল–‘‘বাঃ, বেগুনপোড়াটা ফার্স্ট–ক্লাস হয়েছে৷’’

আর একজন বললে–‘‘না, ফার্স্ট–ক্লাস নয়, এয়ার–কণ্ডিশণ্ড্ হয়েছে৷’’ গোবর গণেশ আবার কথা বলে ফেললে৷ সে একটু গম্ভীরভাবে বললে–‘‘যাই হোক, খেতে ভালই হয়েছে৷’’ তার কথা লুফে নিয়ে আমার আর একটু ৰেশী পরিচিত শ্রীসমর সেনগুপ্ত সুযোগের তিলমাত্র অপব্যয় না করে গোবর গণেশকে উদ্দেশ্য করে বললে–‘‘বেগুনপোড়া যখন একবার ভাল লেগেছে স্যার তখন দেখবেন ওই পোড়ার মুখে বাকীগুলোও ভাল লাগবে৷’’

গোবর গণেশ ঠাট্টাটা না ৰুঝে আরও গম্ভীরভাবে ভোজনে মনোনিবেশ করলে৷

এই কুটনী স্বভাবের লোকেদের কেউই পছন্দ করে না৷ ওরা যেমন লোককে অবহেলা করে, লোকেও তেমনি সুযোগ ৰুঝে ওদের বিশ কথা শুনিয়ে দিতে ছাড়ে না৷ তোমরা কিছুতেই এই ধরনের কুট্টনী ৰুদ্ধিকে প্রশ্রয় দিও না৷ এতে সমাজেরও ক্ষতি, তোমাদেরও ক্ষতি৷

সাড়ে চার ভাই

বিদুষকের কথা বলতে গিয়ে সেই চার ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল৷ আর চার ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে সাড়ে চার ভাইয়ের কথাও মনের কোণে ভাসছে৷ সেকালে ভারতের কোন একটি তীর্থে আমাদের পারিবারিক পাণ্ডা যাঁরা ছিলেন তাঁদের পারিবারিক পরিচয় ছিল শালগ্রাম ভাণ্ডারী পাণ্ডা সাড়ে চার ভাই৷ আমি তখন ছোট৷ ভাণ্ডারী পাণ্ডাকে অর্থাৎ বড় ভাইটিকে শুধোলুম–আচ্ছা, আপনারা সাড়ে চার ভাই কেন আমি তো দেখছি আপনারা পাঁচ ভাই৷

পাণ্ডাজী একগাল হেসে বললেন–‘‘এই দেখ না খোকাবাবু, আমি একজন ঃ এক আর মেজভাই একজন ঃ দুই আর সেজভাই একজন ঃ তিন আর ন’ভাই একজন ঃ চার আর ছোটভাই আধজন ঃ সাড়ে চার৷’’

আমি পাণ্ডাজীকে শুধোলুম–‘‘আপনার ছোট ভাইকে ‘আধজন’ কেন বলছেন তার উচ্চতা তো আপনার চেয়েও বেশী৷’’

পাণ্ডাজী আবার একগাল হেসে বললেন, ‘‘আমরা চারজন যে বিয়ে করেছি, তাই আমরা একজন বলে হিসেবে আসছি৷ আর ছোটটির তো এখনও বিয়ে হয়নি, তাই সে ‘‘আধ জন’’৷

রাখী-বন্ধনের উৎস

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

শ্রাবণী পূর্ণিমায় রাখী-বন্ধন একটি সর্বভারতীয় উৎসব৷ তবে হিন্দী-ভাষাভাষী অঞ্চলে যেমন নারীপুরুষ নির্বিশেষে একে অপরের হাতে রাখী পরিয়ে দেয় বাংলাদেশে ঠিক এতটা নির্বাধ রাখীবন্ধন হয় না৷ এখানে কেবল বোনেরাই ভাইদের হাতে রাখী বেঁধে দেয়৷

রাখীবন্ধনের উৎস মূলে একটি পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে৷ একবার অসুররা স্বর্গপুরী দখল করে নেয়৷ দেবরাজ ইন্দ্র রাজ্যচ্যুত হন৷ তাঁর স্ত্রী শচী তখন শিবের আরাধনা করে স্বামীর বিঘ্ননাশক একটি কবচ লাভ করেন৷ স্বর্গরাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য ইন্দ্র বৃহস্পতির সঙ্গে আলোচনায় বসলেন৷ তার আগে শচী ঐ রক্ষাকবচ ইন্দ্রের ডান হাতে বেঁধে দেন, যাতে যে কোন কাজে সফল হতে পারেন৷ হিন্দুদের ধারণা, শ্রাবণী পূর্ণিমাতেই শচী ঐ রক্ষাকবচ ইন্দ্রের হাতে পরিয়ে দিয়েছিলেন৷ সেই থেকেই রাখী-বন্ধনের সূত্রপাত৷

এছাড়া রাখী-বন্ধনের উৎস খুঁজতে গিয়ে অনেকে জৈন ধর্মগ্রন্থের সাতশো মুনির বিপদ থেকে উদ্ধার লাভের কাহিনীও উল্লেখ করেন৷ ভারতে জৈনধর্মের প্রভাব খুবই সীমায়িত৷ অতএব সর্বভারতীয় একটি উৎসবের মূলে জৈনধর্মের দান সন্দেহজনক৷

মধ্যযুগের একটি ঐতিহাসিক কাহিনীও রাখী-বন্ধনের উৎসরূপে বিবেচিত হতে পারে৷ কর্ণবতী ছিলেন রাণা সংগ্রাম সিংহের রাজকার্য-নিপুণা বুদ্ধিমতী স্ত্রী৷ তিনি দ্বিতীয় মোগল সম্রাট হুমায়ুনকে ‘ভাই’ হিসেবে সম্বোধন করেছিলেন৷ তাতে হুমায়ুন অভিভূত হয়ে কর্ণবর্তীকে ভগ্ণীরূপে বরণ করে উভয়ে ভাই-বোন সম্পর্ক পাতিয়ে বসেন৷ গুজ- রাটের রাজা বাহাদুর শাহ মালব আক্রমণ করলে সংগ্রাম সিংহ তাঁকে বাধা দেন৷ সেই ক্রোধে তিনি সংগ্রাম সিংহের মৃত্যুর পর চিতোর অবরোধ করেন৷ কর্ণবতী তখন হুমায়ুনের কাছে সুন্দর একটি রাখি পাঠিয়ে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেন৷ সেই রাখীর মর্যাদা রক্ষার্থে হুমায়ুন বাহাদুর শাহকে যুদ্ধে পরাস্ত করে তাড়িয়ে দেন৷

বাইলেন

লেখক
শঙ্কর

(ছোট বেলায় আমাদের দলপতি ছিল সজল৷ আর বিশ্বকর্মা ছিল শ্যামল৷ আমরা ওকে শ্যামলা বলে ডাকতাম৷ যে কোনো কাজ এক নিমেষে করে ফেলতে পারতো৷ উপস্থিত বুদ্ধিদাতা ছিল বিপুবা৷ প্রশান্ত, অসিত, শশধর আর আমি ছিলাম সহযোগী৷ বড়দের মত আচরণ করতো স্বপন আর প্রবীর৷ প্রত্যেক বন্ধুকে আজ এই লেখাটা উৎস্বর্গ করা!)

একটা সময় ছিল-যখন আমাদের বাড়ী

সাইডিং তার পাশেই ছিল, চলতো মালগাড়ী৷

খেলতে খেলতে চলে যেতাম বহুদুরের মাঠে

লাবতীর জঙ্গলেতে করমচা-র ঘাটে৷

ওইখানেতে খেজুর ফলে অনেক জামরুল

সেইখানেতেই বাস তাদের বোলতা-ভীমরুল৷

ভেলায় চেপে বৃষ্টি হলে খলসে মাছ ধরা

কাঁচের জারে সাজিয়ে তারে খুনসুটি খেলা সারা৷

চলতো কত হরেক রকম

এলাডিং বেলাডিং সৈ লো-মেলা

লুকোচুরি, কানামাছি গাদি আর খো খো খেলা৷

বনফুলেরই জঙ্গলেতে বানিয়ে একটা ছোট্ট ঘর

সেই ঘরেতে আমরা ক’জন কে আপন কে বা পর৷

ছোট্ট বেলার স্বপ্ণ ছিল অল্প কিছু চাওয়া

ঘুড়ি, গুলি, লাটু পেলে স্বপ্ণ পুরন পাওয়া৷

ক্ষুদিরাম স্মরণে

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

কে শেখালো তোমায় এত দেশপ্রেম

জাতীয়তাবাদের উন্মেষ,

ভারতমাতার সোনার ছেলে

গর্বিত সারা দেশ৷

চরমপন্থার আদর্শে ব্রতী

আক্রমণ স্বভাবসিদ্ধ,

শহীদের মালা কন্ঠে ধরিয়া

স্মরণীয়, অপাপবিদ্ধ!

মাতৃভূমির দামাল ছেলে

শূণ্য মাতৃঙ্ক,

শত শহীদদের পথের দিশারী

অনুসৃত তব পদাঙ্ক৷

 

উপধর্ম

লেখক
সুকুমার রায়

ধর্ম হয় সত্যবলি যারে

উপধর্মের রকম কত সংসারে,

ভবে গুরু কত মার্র্কধারী

নবাবী বেশে করছে দখলদারী৷

ধর্মমূলে নেইত মহড়া

বাহ্যিক তামাসায় গড়া

বাক্যবাণের বিদ্বেষ লড়াই৷

বিচার বুদ্ধির কথা নাই---

গুরুজীর হাতে বাঁধা পুতুল

অন্ধমনে আবোল তাবোল

বিদ্যাবুদ্ধি যশ থাকুক যত

অলৌকিকতার ফাঁদে নত

মানবে মিলন কোন মতে

শুভবুদ্ধি আর হয় না তাতে৷৷

 

অথ খারো কাহিনী

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

কোনো নূতন শাড়ি–বাড়ি–গাড়ি আনলে অথবা হাঁড়িতে কোনো নূতন রান্না চাপালে লোকে চায় সে সম্বন্ধে অন্যে কিছু বলুক৷ কারণ নূতন অর্থে ‘কোরা’ মানেই যা ধ্বনিকে উৎসাহ দেয়৷ নূতন শাড়ি পরলে মন চাইবে প্রতিবেশিনী জিজ্ঞাসা করুন, ‘‘হ্যাঁ দিদি, শাড়িটা কবে কিনলে কত পড়ল’’ নূতন বাড়ি করলে ইচ্ছে জাগে, ৰন্ধু–ৰান্ধবরা বলুক, বাড়িটা ৰেশ হয়েছে৷ নূতন গাড়ি কিনলে ৰন্ধুর মুখ থেকে শুনতে চাইবে, ‘‘এটা কোন্ বৎসরের মডেল’’ হাঁড়িতে রান্না চাপালে প্রশ্ণ অপেক্ষিতই থাকবে, ‘‘রান্না কোথায় শিখলি রে’’

নতুনের সম্বন্ধে জানার আগ্রহ ও প্রশ্ণ পাওয়ার আগ্রহের কথা বলতে গিয়ে আমার সেই ইতিহাসপ্রসিদ্ধ খারো গ্রামের ততোহধিক প্রসিদ্ধ ঘটনাটির কথা মনে পড়ল৷ খারো একটি বিরাট সুশিক্ষিত গ্রাম৷ কিন্তু দুষ্টুলোকে বলে থাকে, বিদ্বান হলে কী হবে, গ্রামের ৰৌদ্ধিক মান বৈদুষ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোতে পারেনি৷ যেদিন গ্রামেরপঞ্চাশৎতম ছেলেটি এম. এ. পাস করলে সেদিন গ্রামবাসীরা সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল যে এই উপলক্ষ্যে তারা একটি বিরাট উৎসবের আয়োজন করবে৷ পটনা থেকে লাটসাহেৰকে আমন্ত্রণ জানানো হবে (তখন ইংরেজ আমল৷ রাজ্য ও রাজ্যপাল শব্দের প্রচলন হয়নি৷ বলা হত প্রদেশ ও প্রদেশের গভর্ণর বা ছোট লাটৰহাদুর)৷ যেমনটি ভাবা, তেমনটি কাজ ৷ খারো গ্রাম উৎসবমুখর হয়ে উঠল৷ মিষ্টি হেসে লাটসাহেৰ সভাপতিত্ব করে গেলেন......উচ্ছ্বসিত ভাষায় খারো গ্রামের মানুষদের ঐতিহ্যের, তাঁদের বৈদুষ্যের উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করে গেলেন .....নিমন্ত্রিত হয়ে যেমনটি করতে হয়৷ লাটসাহেৰ বলে গেলেন, খারো গ্রাম সম্বন্ধে এদিক ওদিক দু’চারটে উল্টোপাল্টা কথা আমার কানে ভেসে আসত৷ অবশ্য সে সব কথায় আমি কখনই আমল দিইনি৷ আজ চাক্ষুষ দেখে গেলুম খারো গ্রাম সাংস্কৃতিক দিক থেকে কত উন্নত৷ এখানকার মানুষের ৰৌদ্ধিক স্তর কত গগনচুম্বী৷ আমি রাজধানীতে ফিরেই এ সম্বন্ধে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দোব যাতে সমস্ত কটু সমালোচনার শেষ নির্যাসটুকুও শূন্যে মিলিয়ে যায়৷

লাটসাহেৰ ফিরছেন৷ তিনি গাড়িতে উঠে বসলেন৷ চারিপাশে অনেক শিক্ষিত তরুণদের ভিড়৷ লাটসাহেৰকে সঙ্গে নিয়ে রাজধানী পর্যন্ত পৌঁছে দেবার দায়িত্ব যে তরুণটি নিলেন তিনি আবার ত্ত.ট্ট.–তে তেরস্পর্শ (ত্র্যহস্পর্শ)৷

তাঁর সহযোগী হিসেবে ছিলেন আরও দু’টি তরুণ৷ বৈদুষ্যে তারা এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায় দ্যাখ৷

চারিপাশে দিগন্তবিস্তৃত কৃষিক্ষেত্র.....ফসলে মাঠ লালে লাল৷ লাটসাহেৰ শুধোলেন–ওই লাল লাল ফলগুলি কী সকলেই উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠলেন–মরচাই......মরচাই (লঙ্কা,......লঙ্কা৷ হিন্দীতে ‘মীর্চ্’)৷

লাটসাহেৰ বললেন–বা! ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে তো! তরুণেরা সমস্বরে ড্রাইভারকে বললেন–একটু থেমে যান ড্রাইভার সাহেৰ৷

তাঁরা সবাই মাঠের দিকে ছুটলেন৷ যিনি যতটা পারলেন লঙ্কা তুলে এনে বস্তাবন্দী করে লাটসাহেৰের পাশে রেখে দিলেন৷ বললেন–আমাদের অঞ্চলের লঙ্কা বিশ্ববিখ্যাত৷ ভারতের ও বহির্ভারতের নানান জায়গায় এই লঙ্কা গিয়ে থাকে৷ আপনি যে দয়া করে আমাদের গ্রামে এলেন ও দয়া করে লঙ্কাগুলোকে দেখলেন এতে এদের ‘লঙ্কা’ নাম সার্থক হ’ল৷ রাজধানী কিছুটা দূরের পথ৷ পথে কিছুটা একঘেয়েমি লাগতে পারে৷ এই টুকটুকে লাল লঙ্কাগুলো সঙ্গে দিলুম৷ যখনই মন চাইবে টুকটাক করে মুখে ফেলতে ফেলতে যাবেন৷ পথের ক্লান্তি এতে দূর হবে৷

লাটসাহেৰ বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে রইলেন৷

 এই সেই ইতিহাসপ্রসিদ্ধ খারো গ্রাম৷ সেই গ্রামের নূতনের পরিচিতি সম্বন্ধে একটা গল্প মনে এল৷

গ্রামের ৰর্দ্ধিষ্ণু কর্ষক ও সুশিক্ষিত মার্জিতরুচি তরুণ শ্রীভূতনারায়ণ সিং মহাশয় তাঁর ৰন্ধু শ্রীভূতনন্দন সিং–এর সঙ্গে আলোচনা করে স্থির করলেন–তাঁদের গ্রাম এত উন্নত, কিন্তু গ্রামে কারো ঘড়ি নেই ৷ একটা ঘড়ি না কিনলে গ্রামের মর্যাদাই থাকে না৷ যেমন ভাবা তেমনি কাজ৷ সিংজী কিছুটা জমি বেচে ৫০০০ টাকা নিয়ে কলকাতায় এলেন৷ ঘড়িওয়ালাকে বললেন–এই ৫০০০ টাকা দিচ্ছি৷ তোমার দোকানের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘড়িটি আমি কিনতে চাই৷

দোকানদার খদ্দেরের নাড়ীর গতি ভালভাবে ৰুঝে নিলেন৷ তিনি দোকানের সর্বশ্রেষ্ঠ একটা ছোট আকারের ঘড়ি সিংজীর হাতে তুলে দিলেন৷

সিংজী তাতে সন্তুষ্ট হবেন কেন! তিনি দেখলেন, দোকানে ওই ঘড়িটির চেয়ে অনেক ৰড় ৰড় ঘড়ি রয়েছে৷ তিনি বললেন–৫০০০ হাজার টাকা দিয়ে এত ছোট আকারের ঘড়ি নিতে যাব কেন সবচেয়ে ৰড় ঘড়িটি আমার পাওয়া উচিত৷ দোকানদার সেই সময়কার বাজারের সবচেয়ে সস্তা দামের হাতঘড়ি সিংজীর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, এই ঘড়িটি থেকে আপনি দুই ধরনের কাজ পাবেন৷ প্রথমতঃ এতে সময় দেখতে পারবেন দ্বিতীয়তঃ প্রয়োজনবোধে ঘড়িটিকে ঢ়িলের মত ব্যবহার করে আঁৰ পাড়তে পারবেন৷ সিংজী তো মহা খুশী৷

সিংজী যথাসময়ে খারো গ্রামে ফিরে এলেন৷ দিবারাত্র........অষ্টপ্রহর.......চব্বিশ ঘণ্টা ঘড়ি পরে ঘুরে ৰেড়ান৷ যেখানেই দু’চার জনকে দেখেন পাঞ্জাবীর হাত গুটিয়ে সেইখানে গিয়ে পৌঁছেন৷ কিন্তু সিংজীর মন্দ ভাগ্য! কেউ কখনও জিজ্ঞেস করে না–হ্যাঁ সিংজী, ঘড়িটা কবে কিনলেন

একদিন শেষ রাতে সিংজী নিজের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিলেন৷ আগুন দেখে পাড়া প্রতিবেশীরা তো এলেনই, এমনকি ভিন্ গাঁয়ের মানুষও ছুটে এল আগুন নেবাতে৷ বাড়ির চারি পাশে মানুষের ভীড়৷ ও ধরনের জায়গায় দমকলের কোনো ব্যবস্থা ছিল না৷ তাই তখন শুধু শোনা যাচ্ছিল কতকগুলি ধবনি ঃ–আগুন–ওদিকে–এদিকে–বালতি–জল–আয়–যা ইত্যাদি, ইত্যাদি৷

সিংজী যেখানেই দেখছেন ৪৷৫ জন লোক জড়ো হয়েছেন তিনি দৌড়ে সেখানে গিয়ে পৌঁছোচ্ছেন৷ নিজের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলছেন–আগ লগীথী পাঁচ বাজকে পঁচপন মিনিট মে৷ ইয়হ্ ঘড়ি টাইম্ বী দেতী হৈ, ইস্সে আম ভী তোড়ে জা শকতে হৈ৷ সেখানে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে তিনি আবার আর একটা জটলার দিকে ছুটে যাচ্ছেন আর ওই কথাই বলছেন৷ এদিকে আগুন যে নিবে এল! শেষ প্রয়াস হিসেবে সিংজী দৌড়োতে দৌড়োতে আর একটা জটলার দিকে পৌঁছোলেন আর চীৎকার করে বলতে লাগলেন–আপনারা শুনেছেন আগুন লেগেছিল ৫টা বেজে ৫৫মিনিটে৷ এই ঘড়ি কত সুন্দর সময় দেয় কী বলব! এ দিয়ে আবার আঁৰও পাড়া যায়......আগ লগী থী ৫ বাজকে ৫৫ মিনিট মে৷ ইয়হ্ ঘড়ি টাইম বী দেতী হৈ, আম ভী তোড়ে জা শকতে হৈ৷ হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে থেকে কে একজন বলে উঠল–আরে ঘড়ি কবে কিনলি.....আর একজন বললে–কোত্থেকে কিনলি.....আর একজন বললে–কত দাম পড়ল......আর একজন বললে–ভারী সুন্দর তো!

ৰাবু ভূতনারায়ণ সিং নিজ শিরে করাঘাত করে বললে–ইয়হ্ ৰাত অগর পহ্লে ৰোলতে তো কোন ৰুদ্ধু আগ লগানে জাতা৷ এই সেই ইতিহাসপ্রসিদ্ধ খারো গ্রাম৷

ক্ষুদিরাম স্মরণে

লেখক
পথিক বরl

‘‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি,

হাসি হাসি পরব ফাঁসী দেখবে ভারতবাসী৷’’

এই গানটি আজও অনেক বাঙালীর রক্তে আগুন ধরায়৷ ১৯০৫ সাল৷ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ বাঙলাকে দুর্বল করতে ভাগ করে দু’টি আলাদা রাজ্য ঘটন করে৷ প্রতিবাদে গর্জে ওঠে সারা বাঙলা৷ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে পথে নাবেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও৷ আন্দোলনকে দমন করতে সাম্রাজ্যবাদী বিদেশী শাসকও দমন-পীড়ন ও অত্যাচারের আশ্রয় নেয়৷ এরই মাঝে বাঙলার একদল দামাল তরুণ ত্যাগের মন্ত্রে দীক্ষা নেয় অত্যাচারী শাসককে তারই ভাষায় জবাব দিতে৷ সেদিনের সেই অত্যাচারী শাসকদের একজন ছিলেন ম্যাজিষ্ট্রেট কুখ্যাত কিংসফোর্ড৷ এই কিংসফোর্ডকে উপযুক্ত জবাব দিতে তৈরী হলেন বিপ্লবী তরুণ দল৷ কিংসফোর্ড তখন মজফরপুরে৷ কিশোর ক্ষুদিরাম বসু আর এক কিশোর প্রফুল্ল চাকীকে সঙ্গে নিয়ে মজফরপুরে পৌঁছলেন অত্যাচারী শাসককে মুখের মত জবাব দিতে৷ জবাব তারা দিয়েছিলেন৷ কিন্তু ভুলবশতঃ কিংসফোর্ড বেঁচে যায়৷ মারা যান দুই ইংরেজ মহিলা৷ প্রফুল্ল চাকী ধরা পড়ার আগেই নিজের হাতের রিভলবার দিয়েই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন৷ ধরা পড়েন ক্ষুদিরাম৷

যথারীতি অত্যাচারী শাসকের বিচারের প্রহসনে ফাঁসীর আদেশ হয় ক্ষুদিরামের৷ ১৯০৮ সালের ১১ই আগষ্ট সেই আদেশ কার্যকর হয়৷ প্রত্যক্ষদর্শী ক্ষুদিরামে উকিলের বর্ণনা থেকেই জানা যায় ফাঁসীর মঞ্চে ওঠার আগে ক্ষুদিরাম এতটুকু বিচলিত ছিলেন না৷ বরং হাসতে হাসতে তিনি ফাঁসীর মঞ্চে ওঠেন৷ দেশের জন্য আত্মত্যাগের, বলিদানের পথ দেখিয়ে গেলেন ক্ষুদিরাম৷ পরবর্তীকালে সেই পথ ধরেই দেশের জন্য জীবন বলিদান দিয়ে যায় আরও শত-সহস্র তরুণ৷ তাঁদের আত্মত্যাগ ও বলিদানেই দেশ স্বাধীন হয়৷ কিন্তু আজ একদল ক্ষমতালোভী, ধূর্ত, কপট নেতারা সেই ত্যাগ ও বলিদানকে ব্যঙ্গ করে দেশের কর্ণধার হয়ে বসেছে৷ তাই আসুন ক্ষুদিরামের বলিদানে দেশবাসীর প্রার্থনা হোক---আর এক বার ফিরে আসুক ক্ষুদিরাম, আর একবার জেগে উঠুক জালাবাদ, বুড়িবালাম৷ নোতুন করে উদয় হোক চট্টগ্রামের সূর্য৷ আর একবার দুর্নীতিপরায়ণ ধূর্ত শাসকের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিক মহাকরণের অলিন্দ৷ বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ করতে জীবন দিয়েছিলেন ক্ষুদিরাম৷ সেদিন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিল৷ কিন্তু ক্ষুদিরাম ও শত শহীদের আত্মত্যাগ ব্যর্থ করে ক্ষমতা লোলুপ নেতারা বাঙলাকে ভাগ করেই ব্রিটিশের হাত থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল৷ আজ আবার খণ্ডিত বাঙলার বুকে আবাজ উঠছে বঙ্গভঙ্গের৷ বাঙালী কি সত্যই চেতনাহীন জড়ে পরিণত হয়েছে! ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগের দিন বাঙলার ছাত্রযুব সমাজ নূতন করে শপথ নিক ঐকবদ্ধ বাঙলা গঠনের৷

আত্মত্যাগে মহান, দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ হে মহান ক্ষুদিরাম লহ প্রণাম৷

‘মোহন বাঁশী’

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

তোমার বাঁশীর সুরে

বুঝি তুমি নাইকো দূরে,

কাছে থেকেও নাই নজরে

 হারাই সৃষ্টির ভীড়ে!

 

আকুল হয়ে এত ডাকি

তবু কেন দাও যে ফাঁকি,

রাতুল চরণে মনটা রাখি

 থাকো হৃদয়-নীড়ে৷

 

সমুখ পথে চেয়ে থাকি

 তোমায় দেখার ছলে,

তোমার বাঁশীর সুর

কেবল তোমার কথাই বলে৷

 

তোমার লীলার ছন্দে নাচি

 ‘যা’ খুশি তাই কর,

অজ্ঞ বিজ্ঞ প্রাজ্ঞ সাজাও

 রাজা-ফকির গড়৷

 

তোমার হাতের খেলনা আমি

 নয়কো আদৌ ফেলনা,

মোহন বাঁশীর তালে দোলে

 বিশ্ব-দোলার দোলনা!

 

বাঁশীর সুরে তালে নাচে

 সাগরে ঊর্মি মালা,

 তটিনীর ধারা রবি শশী তারা

 স্বর্গীয় সুরে উতলা!

 

যে বাঁশীর আবেগ অশ্রু ঝরায়

সে’ বাঁশীর প্রভাব হাসিতে ভরায়,

 আশা-হতাশা, বেগ-উদ্বেগ

বাঁশীর সুরে কোথা সরে যায়!

 

দখিনা হাওয়ায় ঝর্ণাধারায়

বিহগ রহেনা আপন কুলায়,

সুরের ধারায় আত্মহারায়

মর্ম মাঝে কে বংশী বাজায়!

 

আমার অনেক বলার ছিল

 রাতুল চরণ তলে,

সুর হয়ে ‘তা’ মিশে গেছে

 ভক্তি অশ্রু-জলে!

 

কেউ কি জানে তুমি কোথায়

 বাঁশীর সুরে সুরে,

হৃদয় মাঝে হৃদয় জুড়ায়

 হৃদয় অন্তঃপুরে! 

ইছামতীর দেশে

লেখক
শঙ্কর মণ্ডল

সেদিন ছিল সকাল বেলা অন্য একটা সকাল

পরিপাটি হাসি-খুশি চলবে অবধি বিকাল

তপ্ত দহণ তপ্তগহণ জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে

তৃষ্ণায় প্রাণ ওষ্ঠাগত ইচ্ছামতীর দেশে

আকুল মনের ব্যাকুল প্রাণ ঘূর্ণিচাপের মন

কতক আশায় কতক নেশায় চলল সর্বোক্ষণ

হাতের মধ্যে হাতটি রাখা মনের মধ্যে মন

ইছামতীর সুখের স্মৃতি অস্থায়ী যতন

ইচ্ছে করেই ঘাটের ধারে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ

সুখের স্মৃতি রাঙা হল মনের বিসর্জন৷

 

তুমি যে দয়াল

লেখক
সুকুমার রায়

তুমি যে দয়াল আমার প্রাণাধন

অনন্তে মিশে আছ পতিত পাবন

দীপনি জ্বলিছে সদা তোমারি আশে

ধরা দাও হে মোর শুন্য হৃদয় মাঝে

হাসি-কান্না ভরা ব্যথিত হৃদয়ে

নিশিদিন বসে তোমারি পথচেয়ে৷