প্রভাতী

কার পরশে

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

কার পরশে মন ভুলেছে ক্রন্দন,

কার ডাকে মন ছিঁড়েছে সব বন্ধন৷

কে বাজালো বন্ধ দ্বারে ঘন্টা

উঠলো জেগে ঘুমন্ত মোর মনটা৷

বিশ্বজুড়ে কে মেতেছে কর্মে

কার আহ্বান পেলাম আমি মর্মে৷

কার প্রবচন ঘুচায় মনের জড়ত্ব,

কার আদর্শ জাগায় মনে মহত্ব৷

খুঁজবো তাঁরে পূজব সকাল সন্ধ্যে,

কাটাবো দিন ধর্মে কর্মে আনন্দে৷

মাটির ঈশ্বর বিদ্যাসাগর

লেখক
সুপর্ণা মজুমদার রায়

মেদিনীপুরের সেই যে এক বীরসিংহ গ্রাম,

সেই গাঁয়েরই সিংহ শিশু বিদ্যাসাগর নাম৷

বিদ্যাসাগর কেমন ছিলেন

জানতে কিনা ভাই---?

বীরদর্পে কন্ঠে যার নারীশিক্ষা চাই৷

পড়া নাকি চালিয়ে গেছেন

পথের আলোর বাঁকে,

অংক তিনি শিখেছিলেন সংখ্যা ফলক দেখে৷

বিদ্যাসাগর কেমন ছিলেন জানেন কটা লোক?

গোঁড়ামিকে তুড়ি মেরে বিধবা বিবাহ হোক!!

বলতে পারো বিদ্যাসাগর তবে কেমন ছিলেন?

ঢিলের বদলে পাটকেলটি মারতে যিনি বলেন৷

বিদ্যাসাগর কেমন ছিলেন জানতে ইচ্ছে করে?

জানতে পারো তবে তাঁর বর্ণপরিচয় পড়ে৷

বিদ্যাসাগর দয়ার সাগর যা ছিল তাঁর টাকা,

দীনের তরে বিলিয়ে দিতেন

হোক না পকেট ফাঁকা৷

এমনি এক বিদ্যাসাগর অসামান্য দ্বিজবর,

মায়ের ডাকে দিলেন পাড়ি উত্তাল দামোদর৷

বিদ্যাসাগর জ্ঞানের সাগর ভাষা’র শিক্ষাগুরু,

বঙ্গসাহিত্যের নবজাগরণ

(তাঁর) হাতটি ধরেই শুরু৷

দীপ্ত ভাষী সদা ব্যস্ত মানুষ গড়ার কাজে,

নিন্দুকেরা বলুক তাঁকে মাথামোটা কিংবা বাজে৷

এমনি মোদের বিদ্যাসাগর সমাজ প্রগতি শিখা,

প্রশস্ত ললাটে আঁকা ছিল জ্ঞানের জয়ের টীকা৷

এমনই ছিলেন বিদ্যাসাগর বিশাল উদার চিত্ত,

বীরসিংহের বীরের পায়ে সব বাঙালী ভৃত্য৷

সব পীড়িতের ঈশ্বর যিনি করুণার মিলন সাগর,

শিষ্টের যিনি পালনকারী ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর৷

নাচাতে নাচাতে

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

ঠাকুরের অর্থাৎ শ্বশুরের কন্যা এই অর্থে ঠক্করদুহিতাঞ্ছঠক্ক্ ঞ্ছঠাকুরঝি৷ ননদকে বাংলায় ‘ঠাকুরঝি’ বলে সম্বোধন করা হত ও আজও করা হয়ে থাকে৷

ননদের স্বামী নন্দাইকে (ননন্দাপতিঞ্ছননন্দ্) সম্ৰোধন করা হত ‘ঠাকুর জামাই’ বলে৷ ঠাকুর জামাই মানে ঠাকুরের জামাই অর্থাৎ শ্বশুরের জামাই৷ রাঢ়ের কোনো কোনো অংশের পুরুষেরা পত্নীর ভগিনীকেও ‘ঠাকুরঝি’ বলে সম্বোধন করে৷ ভাষাবৈজ্ঞানিক মতে এ ব্যবহার শুদ্ধ৷

‘ননন্দা’ মানে যে আনন্দিতা নয়৷ ভ্রাতৃজায়া ঘরে আসার সময় সব ননদের না হলেও কোনো কোনো ননদের মনে একটা বিক্ষোভ জন্মায়৷ সে ভাবে, অন্য বাড়ির মেয়ে এসে আমার বাপের বাড়িতে সর্বময়ী কর্ত্রী, একেবারে রাজরাণী হয়ে বসল আর আমি কি না পরের বাড়িতে গিয়ে দু’বেলা হেঁসেল ঠেলছি!

সেকালে ননদ ও ভাজ দু’য়েরই শিক্ষার স্তর খুব উন্নত ছিল না৷ তাই ছোটখাট ব্যাপারে একে অন্যকে ঠেস দিয়ে কথা শোনাত, একে অন্যকে সহ্য করতে পারত না৷ আজকাল কিন্তু চাকা ঘুরে গেছে৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ননদ–ভাজ দুই–ই শিক্ষিত৷ তাই দু’য়ের মধ্যে আজকাল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দারুণ ভাব৷ এ যেন একেবারে–

‘‘ভাবে গদগদ তেলাকুচো

কেঁদে মরে গেল কাল ছুঁচো৷’’

সেকালে কিন্তু সব ক্ষেত্রে না হোক, অনেক ক্ষেত্রেই ননদ–ভাজে দিব্যি রেষারেষি চলত৷ সেই যে গল্প আছে না ঃ

ননদ–ভাজে ঘাটে গেছে চান করতে৷ এমন সময়ে কুমীর এসে ননদকে ধরে নিয়ে গেল৷ ভাজ কিন্তু কথাটি চেপে রাখল৷ মনে মনে তার খুব আনন্দ, কারণ ননদ তাকে জ্বালা দিত৷

          ‘‘ননদিনী রায়বাঘিনী, ননদিনী কুলের কাঁটা,

          উঠতে বসতে দেয় গো খোঁটা৷৷’’

সে বাড়িতে এসে কাউকে কিচ্ছুটি বললে না, একবারও মুখটি খুললে না, কেননা মুখ খুললেই তো বিপদ৷ খাওয়া–দাওয়া শিকেয় উঠবে.......রাঁধা ভাতের হাঁড়ি ফেলে দিতে হবে.......শুক্তো–ঘণ্ট–ডাঁটা–চ গোরু–ছাগলে খাবে৷ ভাজ তাই মুখে কুলুপ এঁটে রইল৷ তারপর পেট ভরে ৰেড়াল ডিঙ্গোতে পারে না এমন পরিমাণ ভাত খেয়ে, লাউডগা–পোস্তবাটা থেকে শুরু করে ঝালের ঝোল, অম্ৰল সব কিছু চেটেপুটে খেয়ে হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল৷ আর মনে মনে বললে, কী জ্বালা হয়েছে, এঁটো পাতা আবার আমাকেই তুলতে হবে!

‘‘ঢ়লাঢ়লা পুঁইয়ের পাতা মলুকচালের ভাত ৷

খেয়ে দেয়ে রইনু বসে কে ফেলাবে পাত৷’’

বউ কোনোক্রমে গেল আঁচাতে৷

কুম্ভীরবর্গীয় সমস্ত জানোয়ারেরাই চলবার সময় একটু লাফাতে লাফাতে যায় (সে বিরাট আকারের কুমীর থেকে শুরু করে টিকটিকি পর্যন্ত সবাই এই রীতিতেই চলে) ও এই একই রীতিতে শিকার ধরে ৷ শিকার ধরে মুখে নিয়ে যাবার সময় তারা নিজেরা লাফাতে লাফাতে যায় বলে দেখে মনে হয় শিকারটাও ৰোধহয় নাচতে নাচতে যাচ্ছে৷ কুমীর যখন ননদকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল তখন কুমীরটা নিশ্চয় ওই ভাবেই যাচ্ছিল৷ বউ দেখলে খ্যাঁটনের পালা তো চুকে গেছে৷ এখন ননদকে কুমীরে নিয়ে গেছে বললেও ক্ষতি নেই৷ হাঁড়ি যদি ফেলে দেওয়াও হয়, হাঁড়িতে এক কণা ভাতও অবশিষ্ট নেই৷ বউ সবই চেটেপুটে খেয়ে নিয়েছে৷ তাই বউ (অর্থাৎ ভাজ) আঁচাতে আঁচাতে ঘাটের আর সবাইকে ডেকে বললে ঃ

          ‘‘ভাল কথা মনে পড়ল আঁচাতে আঁচাতে৷

          ঠাকুরঝিকে নিয়ে গেল নাচাতে নাচাতে৷৷’’

সবাই বললে–তোমার ঠাকুরঝিকে কুমীরে নিয়ে গেছে এই খবরটা এতক্ষণ চেপে রেখেছিলে কেন ভাজ বললে– এতক্ষণ কথাটা মনে ছিল না৷ আঁচাতে আঁচাতে মনে পড়ল৷

অভিষেক

লেখক
আচার্য গুরুদত্তানন্দ অবধূত

হে বীর, ভারতবর্ষের ভাগ্যাকাশে

তুমি এক উজ্জ্বল ধুমকেতু৷

যুদ্ধক্ষেত্রে নির্ভিক সৈনিক,

আপোষহীন সংগ্রামী তুমি,

ত্যাগ তিতীক্ষার মূর্ত্ত প্রতীক৷

উদার চিত্তে ছিল তব আহ্বান

‘‘আমায় রক্ত দাও,

আমি স্বাধীনতা দোব’’

গড়লে আজাদহিন্দ ফৌজ,

শক্ত হাতে দিলে তাতে নেতৃত্ব,

সৈনিক বেশে তুললে

জাতীয় পতাকা

গড়লে সরকার দেশের মাটিতে৷

জানে নি সে মানুষ পাওনি,

মর্যাদা সেদিন তাই,

সাম্রাজ্যবাদীর কোমড় ভেঙে

হলে তুমি নিরুদ্দেশ,

কিন্তু না, দমেনি মানুষ,

থামেনি যুদ্ধ,

হ’ল বিদ্রোহ ঘোষণা---

সৈন্যদলে স্থানে স্থানে,

পালাবার পথ নেই জেনে

হ’ল হস্তান্তরিত শোষণ শাসনের,

পেলো রাজনৈতিক

স্বাধীনতা ভারতবর্ষ,

নেই তাতে অন্ন বস্ত্র

বাসস্থানের গ্যারান্টি,

পচে গলে মরছে

মানুষ রাস্তার ধারে,

দ্বীপান্তরে শুস্ক বনভূমিতে৷

পরম ধন

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

বহির্মুখী মন মুগ্দ রয়েছে

 বাহিরের চাকচিক্যে,

হৃদ-সাগরে ভাবিনি কখনো

 ভরিয়া মনি-মানিক্যে!

সবার মাঝারে তিনি বিধৃত

 শাশ্বত চির সত্য,

তাঁর সৃষ্টিকে উপেক্ষা করে

 জড়তায় ছিনু মত্ত৷

পার্থিব যা কিছু এ জগত ভরে

 সকলই সীমিত সত্ত্বা,

হৃদয় আলো করে

করুণা ধারায়

 জাগিয়া পরমসত্ত্বা!

তাঁরে চিনিতে পারিনি

 নিকটে ভাবিনি

জানিনা কোথায় আবাস,

অহেতুকি কৃপায় নয় অলকায়

 হৃদয়ে স্থায়ী নিবাস!

অন্তর-ধন পেতে চায় মন

 তাই আত্মসমর্পণ,

পরম পিতা চির সাথী মোর

 কাটাই ক্ষুদ্র এ জীবন৷

দৃঢ়চেতা

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

বেশি দিনের কথা নয়৷ তখন আমাদের দেশ ব্রিটিশ শাসনে শাসিত৷

স্থানটার নাম সুজাম্বুটা৷ সেট্‌লমেন্টের এক বাঙালী অফিসার বদলি হলেন এই জায়গায়৷ নতুন কাজে হাত দিয়েই তাঁর চক্ষু স্থির৷ তিনি দেখলেন, সেট্‌লমেন্টের অন্যান্য অফিসাররা জমির জরীপ সংক্রান্ত ব্যাপারে অন্যায়ভাবে বেশী খাজনা আদায় করছেন৷

ক্ষুব্ধচিত্তে বাঙালী অফিসারটি এই অসৎ কাজের বিরুদ্ধে হাতিয়ার ধরলেন৷ বেআইনীভাবে বেশী খাজনা আদায় করা তিনি আইনের সাহায্যে বন্ধ করে দিলেন৷

ফলে জেলার সাহেব-অফিসাররা তাঁর ওপর গেলেন ভীষণ ক্ষেপে৷ নিরুপায় হবে তাঁরা গিয়ে আপীল করলেন জজের কাছে৷

 জজ বাঙালী অফিসারের বিরুদ্ধে রায় দিলেন৷ আর ছোট লাট স্যার চার্লস ইলিয়ট তাঁকে ডেকে পাঠালেন৷ অপমান করবার জন্য৷ একজন সামান্য বাঙালী অফিসারের স্পর্ধাকে তিনি এক ধম্মকে উড়িয়ে দিতে চাইলেন৷

কিন্তু ছোটলাট তো দূরের কথা বড় লাটকেও ভয় পাবার মতো দুর্বল মানুষ বাঙালী অফিসারটি নন৷ তাই তিনিও মুখের ওপর দৃপ্তস্বরে বলে ফেললেন ‘স্যার আপনি বরাবরই পাঞ্জাবেই ছিলেন,অতএব বাংলাদেশেরজরীপ সংক্রান্ত আইন কানুন আপনার কিছুই জানা নেই৷ সুতরাং যা জানেন না, তা নিয়ে তর্ক করবেন না৷

কী -ছোট লাট জানেন না৷ সামান্য একজন বাঙালীর মুখে এতবড় কথা!

তাই আবার মামলা শুরু হলো৷ এবার কিন্তু জজসাহেব বাঙালী অফিসারের পক্ষেই রায় দিলেন৷ তাঁর মতকেই জজ ,সাহেব সমর্থন করলেন৷ ফলে বাঙালী অফিসারের চাকরিটা রক্ষা পেল, জমির খাজনা বেশী আদায় করাও বন্ধ হয়ে গেল৷ কিন্তু তাঁর চাকরিতে আর পদোন্নতি হলো না৷ যাঁরা সত্যবাদী তাঁরা বৃহৎ স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে সর্বদাই প্রস্তুত৷

বলতে পারো এই দৃঢ় চেতা বাঙালী অফিসারটি কে? ইনি হচ্ছেন আমাদের প্রিয় কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়৷

বেঁচে থাকো ট্রাম

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

টিকি বাঁধা গাড়ি করে

 ফিরতাম বাড়ি,

সরকারি বদান্যতায়

তারা গুটায় পাততাড়ি!

দূষণ বিহীন গাড়ি

 চলে ধীরে ধীরে,

তার পথ অবরুদ্ধ

 যানজট ভীড়ে৷

নাগরিক জনপদ বলে

 বেঁচে থাকো ট্রাম,

ট্রামের অস্তিত্ব রক্ষায়

 শুরু হোক সংগাম৷

বয়সে বৃদ্ধ অপাপবিদ্ধ যান

 মুখে ধোঁয়া নাই তার

রাখে ভদ্রলোকের মান!

20

প্রীতিমোহনা

আচার্য গুরুদত্তানন্দ অবধূত

অপার সুখের মাধুর্যেতে

পূর্ণ জগতখানি,

কোথায় ছিলুম কেন এলুম

কেবা আনল টানি?

অরুণালোক জাগায় প্রাণে

 বিহগ গায় গীতি,

প্রজাপতি ওই দল বেঁধে যায়

সেইতো মানি রীতি৷

আকাশ সাগর মিশছে যেথা

মোহন মাধুরী রূপ,

বিশালতা এসে ভরায় বুকে

রূপে সে অরূপ৷

প্রীতির ধারা বাহিয়া চিতে

কত কী করে যাই,

কেবা নাচায় জীবন মনে

কোথা তাঁরে পাই?

হাসির ঝলক পলকেতেই

অন্তর্মুখী হয়,

একাগ্রতা নীতি নিষ্ঠায়

পাই তাঁর বরাভয়৷

অন্তর্বাহির ঘেরি যেজন

মাধুরী ছড়ায়,

ধরিতে তাহায় এসেছি হেথা

প্রীতি এ মোহনায়!

 

গোবিন্দবাবুর ঝকমারি

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

গণ অন্ন = গণান্ন৷ ভাবারূঢ়ার্থে ‘গণান্ন’ বলতে বোঝায় যে অন্ন বা খাদ্য অনেকের জন্যে পাক করা হয়েছে৷ যোগারূঢ়ার্থে গণান্ন বলতে বোঝায়–বিশেষ ধরনের গণ–নবান্ন উৎসব৷

সুপ্রাচীনকালে শস্য কর্ত্তনের পর কর্ষকেরা সবাই শিশু–বৃদ্ধ নির্বিশেষে সমস্ত গ্রামবাসী একসঙ্গে অন্ন ভাগ করে ভোজন করতেন চাষের জমিতে বসে৷ এই যে একটি বিশেষ ধরনের নবান্ন উৎসব সেকালের মানুষেরা পালন করতেন তার সঙ্গে তাঁরা খেতেন ছাঁচি কুমড়োর বড়ি, মাষ–কলাইয়ের (বিরি কলাইয়ের) ডাল৷ বৌদ্ধ যুগ পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে বাঙলায় এই গণনবান্ন উৎসব চলত৷ পরে এই গণনবান্ন উৎসব ধীরে ধীরে উঠে যায়৷ নবান্ন হয়ে দাঁড়ায় পারিবারিক উৎসব৷ তার সঙ্গে ‘গণ’–সংযুক্তি থাকে না৷ তবে প্রাচীনকালের গণনবান্নের জের হিসাবে এখনও নবান্নের দিন শত্রুমিত্র নির্বিশেষে একে অপরকে ডেকে খাওয়ায়–পশুপক্ষীকেও খাওয়ায়–অনেকে নূতন বস্ত্র পরিধান করে৷ অনেকে ছাঁচি–কুমড়ো কুরে নিয়ে বড়ি তৈরী করে৷ অনেকে নূতন মাষকলাইয়ের (বিরিকলাই) ডাল খায় (বিরিকলাই বোনা হয় আষাঢ় মাসে আর তোলা হয় আশ্বিন মাসে)৷ নবান্নের সময় তাজা বিরিকলাইয়ের ডাল পাওয়া যায়৷

এই গণনবান্ন উৎসব মগধ দেশে অন্য ভাবে পালিত হত৷ তাঁরা এইদিন সূর্যের প্রতি কৃতজ্ঞতাবশতঃ সূর্যের পূজা করত৷ সূর্যের কৃপাতেই মেঘ তৈরী হয়, মেঘ থেকে বর্ষণ হয়–এই ভেবেই তারা সূর্যের পূজা করত৷ পূজা করত ভাদই ফসল বা আউশ ফসল উঠবার পরে কার্ত্তিক মাসে৷ বৈদিক বিধি অনুযায়ী সূর্য পুরুষ–দেবতা, চন্দ্র স্ত্রী–দেবতা৷ কিন্তু অষ্ট্রিক বিধি অনুযায়ী চন্দ্র পুরুষ–দেবতা ও সূর্য স্ত্রী–দেবতা৷ তাই প্রাচীন মগধের মানুষেরা সূর্যকে ছট্ঠি মাঈ অর্থাৎ ষষ্ঠীমাতা নামে সম্বোধন করত৷ পূজা দিত ওই ষষ্ঠী মাতাকে৷ যেহেতু এটি অষ্ট্রিক বিধান তাই এতে ব্রাহ্মণ–পুরোহিতের কোন স্থান নেই৷ অষ্ট্রিক সমাজের স্বাভাবিক বিধি অনুযায়ী ষষ্ঠী মাতার পূজা অর্থাৎ ছট্ পূজা নারীরাই করত৷ অষ্ট্রিক পূজার উপাদান হিসেবে চালের গুঁড়ো, কলা প্রভৃতি উপকরণ থাকত৷ রবি ফসল কাটার পরে–চৈত্র মাসেও মগধের মানুষ কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আরও একবার সূর্যের পূজা করত৷ আজও মগধে এই দুই ছট পূজাই (কার্ত্তিকা ছট ও চৈতী ছট) চলে৷ জিনিসটা কতকটা অসাম্প্রদায়িক৷ ছোটবেলায় দেখেছি, জাতি–ধর্ম নির্বিশেষে সবাই এই পূজা করছেন–মুসলমানেরাও৷ প্রাচীন মগধে ষষ্ঠীমায়ের প্রসাদ ঙ্মঠেকুয়াৰ গ্রামবাসীরা গ্রামের উত্তর–পূর্ব কোণে ঙ্মঈশান কোণৰ বসে একত্রে ভোজন করত৷ এটাকেও বলতে পার এক ধরণের গণনবান্ন৷ অবশ্য পৃথক ভাবে নবান্ন উৎসবও মগধে ছিল বা আছে৷ বৌদ্ধ যুগের পর জাতিভেদ বাঙলার সমাজে জীবনে শিকড় গেড়ে বসার সঙ্গে সঙ্গে এই একত্র–ভোজন বা গণনবান্ন বা নবান্ন–বিধি প্রায় উঠেই যায়৷ তবে একটু আগেই বললুম, নবান্নের অসাম্প্রদায়িকত্ব বা ব্যাপকত্ব আজও রয়েছে৷ কোন উৎসব উপলক্ষ্যে গ্রামের মানুষেরা যদি একসঙ্গে বসে পঙ্ক্তি ভোজন করেন ও রান্নাগুলো যদি এক সঙ্গে হয় তবে এই বিরাট পঙ্ক্তিভোজন বা সাধারণ ভুরিভোজনকেও গণান্ন বলা হয়৷ এ ধরনের গণান্ন পৃথিবীর অনেক দেশেই রয়েছে... ভারতেও রয়েছে৷ যদি কিছু–সংখ্যক মানুষ কোন অপরিচিত স্থানে যায় বা থাকে সেক্ষেত্রে তাকে বা তাদের যদি কোন গজ্জায় (হোটেলে) থাকতে হয় সেক্ষেত্রে দীর্ঘকাল গজ্জায় থাকতে থাকতে তাকে বা তাদের নানান ধরনের অসুবিধা ভোগ করতে হয়৷ কখনো কখনো সে তার পছন্দমত রান্নাবান্না পায় না, কখনো কখনো গজ্জার মালিক কম তেল–ঘি দিয়ে বেশী ঝাল প্রয়োগ করে আহারকারীর তেল–ঘিয়ের অভাব বোধকে ভিন্ন পথে চালিয়ে দেয়৷ ঝালের ঠ্যালাতেই সে আ–হা–হা....উ–হু–হু করতে থাকে৷ কখনো কখনো আবার কোন কোন স্থানে অল্প পরিমাণ বাসি জিনিস বেশী পরিমাণ তাজা জিনিসের সঙ্গে মিশিয়ে বাজারে পার করে দেয়৷ আমি বলছি না সমস্ত গজ্জা–মালিকই এমন করেন৷ তবে কেউ কেউ এমনটা করেন–এই খরবটা আমি পেয়েছিলুম আমার কম বয়সের বন্ধু বাবু গোবিন্দপ্রসাদ সিংয়ের কাছ থেকে৷ বাবু গোবিন্দপ্রসাদ ছিলেন বিহারের মুঙ্গের জেলার মানুষ৷ আমার এই জেলার মানুষেরা বুদ্ধিমান হলেও খুব সোজা বুদ্ধিতে চলে৷ বাবু গোবিন্দপ্রসাদকে একবার জিজ্ঞেস করা হ’ল–আপনি কি সরকারী কার্যব্যপদেশে দু চারদিনের জন্যেও কলকাতায় যাবেন তিনি সঙ্গে সঙ্গে হাত–মুখ নেড়ে প্রবল ভাবে আপত্তি জানিয়ে বললেন–না, না, কিছুতেই নয়, কিছুতেই নয়৷

আমি শুধোলুম–কেন?

আজন্ম নিরামিষাশী বাবু গোবিন্দপ্রসাদ বললেন–ওখানকার হোটেলে কী বলে কী খাইয়ে দেবে তার কোন ঠিক–ঠিকানা নেই, আমি যাব না৷

বাবু গোবিন্দপ্রসাদের অন্যান্য বন্ধুরা বললেন–যখন কলকাতায় যাবে, তখন প্রথমেই বলবে আমি নিরামিষ খাই–ভাত, ডাল, ঝালের ঝোল আর পটোলের তরকারী৷ বাবু গোবিন্দপ্রসাদ কলকাতা গেলেন–যথাসময়ে ফিরেও এলেন৷ একদিন আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন–দেখি তাঁর মুখমণ্ডলে কালো মেঘ নেবে এসেছে৷ জিজ্ঞেস করলুম–কী হয়েছে কী হয়েছে কলকাতা কেমন লাগল

উনি বললেন–এই কাণ মলছি, নাক মলছি, প্রাণ থাকতে দ্বিতীয়বার কলকাতায় যাচ্ছি না৷

আমি বললুম–কী হয়েছে

তিনি বললেন–বন্ধুদের পরামর্শমত গিয়েই বললুম আমি খাই ভাত–ডাল–ঝালের ঝোল–পটোলের তরকারী৷

হোটেল মালিক সাগ্রহে বললে–প্রত্যেকটি জিনিস এখানে পাবেন–খেয়ে মেজাজ তররর হয়ে যাবে৷

আমি একটু খুশি মনে ভোজনের টেবিলে বসলুম৷ প্রথমেই দেখলুম রয়েছে জলের মত পাতলা মুসুরির ডাল৷ আমি সাঁতরে অনেকবার মুঙ্গেরের গঙ্গা পার হয়েছি৷ ভাবলুম ওই ডালের বাটিতে নেবে সাঁতার কাটতে শুরু করে দিই৷ তাতে রয়েছে শীরফ জল৷ বাটির তলায় আড় চোখে তাকিয়ে রয়েছে কেবল দু–চারটে মুসুরির ডাল৷ পটোলের তরকারীতে তেল বা ঘি কিছুই নেই৷ তবে মীর্চ (লংকা) ঢ়ালা হয়েছে প্রচুর৷ লংকার জ্বালায় যখন চোখ–নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছে তখন আমি তরকারীতে যে তেল–ঘি নেই তা অনুভব করার শক্তি হারিয়ে ফেললুম৷ সবচেয়ে ফ্যাসাদ হ’ল ঝোলের বাটি টানতে টানতে৷ বাটি টানার সঙ্গে সঙ্গে মনে হ’ল কেমন যেন একটা মাছের বাজারের গন্ধ৷ রামজীর নাম নিয়ে কিছুটা ঝোল–ভাত মাখালুম৷ এক গ্রাস মুখে

ফেলতেই দেখি নির্ঘাত মাছের গন্ধ৷ (হিন্দী ভাষায় যেমন ‘বু’, মারাঠীতে তেমনি ‘মহক’ ও গুজরাতীতে ‘গন্ধ’)৷ এই মাছের মহক (ঝোলের) তার চেয়ে উগ্রতর৷ হোটেল–মালিককে শুধোলুম, ঝালের ঝোলে মাছের গন্ধ কেন উত্তরের জন্যে তিনি তৈরীই ছিলেন৷ কাল বিলম্ব না করেই বললেন–জানেন তো, বঙ্গাল মে ধানের জমির পাশে মাছকা পুকুর হ্যায়৷ তাই ধানের জমিতে মাছের গন্ধ ভেসে আসতা হ্যায়৷ সেই জন্যে আপনি ঝোলেতে মাছের গন্ধ পাতা হ্যায়৷ ও কিছু নয়, ওনিয়ে আপনার ভাববার দরকার নেহী হেঁ৷ দু–চার গ্রাস ওটাই গলাধঃকরণ করলুম৷ চরম ফ্যাসাদ বাধল আর একটু পরে৷ এক গ্রাস ঝোল–ভাত মুখে ফেলতে যাচ্ছি এমন সময়ে আঙ্গুলে আটকা পড়ল মাছের একটা লম্বা হড্ডী (মাছের লম্বা কাঁটা)৷ আমি তখন হোটেল মালিককে বললুম–এ কেমন হ’ল ভাতে না হয় মাছের গন্ধ এল কারণ ধানক্ষেতের পাশেই পুকুরে মাছ কিন্তু মাছের কাঁটা কী করে এল

হোটেল–মালিক বললে–জেলেরা পুকুর থেকে মাছ ধরে এই ধানক্ষেতের মাছগুলো ফেলে কি না ধান কাটার সময় দু–চারটে মাছের কাঁটাও উঠে আসে৷ এতে রাঁধবার সময় কয়েকটা কাঁটাও সেই ভাতে থেকে যায়৷

তাহলে বুঝুন, কী ফ্যাসাদ হয়েছিল৷ আমরা খাই ড়হেরী কা ডাল৷

যাই হোক্, পরের দিকে কেবল মুসুরের ডাল আর পটোলের তরকারী খেয়ে দিন কাটিয়েছি৷ আর ভুলেও কলকাতার পথ মাড়াচ্ছি না৷ এখন থেকে কাণ মলছি, নাকে খৎ দিচ্ছি আর ভুলেও কলকাতার পথ মাড়াচ্ছি না৷                         (শব্দ চয়নিকা, ১৬/১৯৮)

লীলাভাষ

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

যা’’ কিছু দৃশ্যমান অথবা অদৃশ্য

 সবইতো তোমার সৃষ্টি,

মন্দ-ভালো, সাদা-কালো

 খরা থেকে অতি বৃষ্টি,

মনের ভাব যোগায় ভাষা,

 আনে সংস্কৃতি কৃষ্টি৷

তোমার লীলায় এত বৈচিত্র

 সবেতেই সম দৃষ্টি!

জানা-অজানার যত অনুভূতি

ভাবের গভীরে চরম আকুতি

না বলা কথার গোপনীয়তায়

তোমার গোচরে সবই মুরছায়,

অতি সাধারণ, প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ

 সুস্থ-সবল, দুরারোগ্য,

 ধনী-দুস্থ, উদয়-অস্ত

লীলার ছন্দে নৃত্যে ব্যস্ত!

স্থাবর-অস্থাবর যত সম্পদ

 সমস্যার সমাধান,

বিপদ-আপদ-সঙ্কট মাঝে

 করেছ প্রতিবিধান৷

প্রতিকার হয়ে মর্মে বিরাজো

 কঠিন জটিলতায়,

রয়েছো আমার ক্লেশে উল্লাসে,

 উদার মানবতায়৷

অনুতে অনুতে তনুতে তনুতে

 দূর নীলিমায়, রামধনুতে

 রয়েগেছো ভালোবেসে৷

পাখির কুজনে রবির কিরণে

 ষড় ঋতুর নবীন বরণে

 চির অমলিন অক্লেশে৷

আছো ব্যর্থতা-সাফল্যে সমভাবে,

আছো জনসেবার পবিত্র মনোভাবে,

আছো মল্লিকা মালতীর সৌরভে

আছো প্রকৃতির অকৃপণ বৈভবে৷

আছো মানব মনীষার উত্তুঙ্গ গৌরবে৷

মনুষ নহীঁ, দেওতা হ্যায়

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

তোমরা এমন কিছু কিছু মানুষ নিশ্চয় দেখেছ যাদের শরীরে মায়ামমতা অত্যন্ত বেশী৷ বিপদে আপদে সবাই তাঁদের দ্বারস্থ হয়, তাঁরাও বিপন্ন মানুষকে বাঁচাবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকেন৷ নিজেকে বিপদে ফেলেও অন্যকে বাঁচাবার চেষ্টা করেন৷ একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল৷

সেটি ১৯৪৬–৪৭ সালের কথা৷ ভারতে নানান স্থানে তখন সাম্প্রদায়িকতার কৃশাণু জ্বলছে৷ এই আগুন জ্বালাতেন  বা জ্বালিয়েছিলেন রাজনৈতিক নেতারা৷ আমি তাঁদের জন্যে ঘৃণা সূচক পলিটিক্যাল পিগ (হ্মপ্সপ্তন্ব্ধন্ন্তুত্র হ্মন্ন্ধ) শব্দটি ব্যবহার করেছিলুম৷ তাদের কাছে মানুষের জীবনের দাম ছিল না৷ তাদের উদ্দেশ্য ছিল যে কোন পন্থায় তাদের রাজনৈতিক মতলব হাসিল করা৷ এজন্যে মানুষ মরে মরুক....শান্তির নীড় গ্রামগুলি ওই আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলে জ্বলুক, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধি ছিল তাদের কাছে সবচেয়ে বড় কথা৷ আমরা যে পাড়াটিতে থাকতুম সেটি ছিল সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু দুই সম্প্রদায়েরই বাসভূমির সীমান্তরেখা৷ আমাদের বাড়ীটি ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পাড়ার শেষ হবার কয়েক পা মাত্র দূরে৷

স্থানটি বিহারের একটি ছোট্ট শহর৷ তখন সন্ধ্যেবেলা৷ একজন বাংলাভাষী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক সিল্কের লুঙ্গি বেচতে আমাদের পাড়ায় প্রায় ঢুকে পড়েছিল৷ আমরা তাকে তাড়াতাড়ি আমাদের পাড়া ছেড়ে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত পাড়ায় চলে যেতে বললুম৷ আমাদের বাড়ী থেকে প্রায় একশ’ হাত দূরে৷ লোকটি ছিল ময়মনসিং জেলার৷ একে বিহারে সে কখনও আসেনি, তার ওপর এখানকার ভাষাও সে ভাল জানত না৷ সে বললে–‘‘কি করে যাব কর্ত্তা, সেখানে তো আমার জানা–চেনা কেউ নেই৷’

আমার এক অতি নিকট আত্মীয় ওই সময় আমাদের বাড়ীতে ছিলেন৷ তিনি তার হাত ধরে টেনে আমাদের বাড়ীতে ঢুকিয়ে নিলেন৷ লোকটি তখন ভয়ে কাঁপছে৷ চারিদিকে দাঙ্গা–কাজিয়া তখন চরম অবস্থায় পৌঁছেছে৷ সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের লোকেরা আমাদের বাড়ীতে এসে বললে–সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকটিকে তোমাদের বাড়ীতে ঢুকতে দেখেছি, তোমরা ওকে আমাদের হস্তে সমর্পণ করো৷

আমাদের সেই আত্মীয়টি তখন বাড়ী থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এলেন৷ তিনি সংখ্যাগুরু ওই বিরাট রণোন্মত্ত বাহিনীকে বললেন–লোকটিকে আমিই বাড়ীতে ঢুকিয়ে রেখেছি৷ লোকটি বিপন্ন৷ তোমরা যদি লোকটিকে চাও আমি তাকে তোমাদের হস্তে সমর্পণ করতে রাজী আছি–একটি সর্ত্তে৷ তোমরা আমাকে এখনই মেরে ফেল....তারপর আমার মৃতদেহের ওপর দিয়ে চলে যাও ওই বাড়ীতে....লোকটিকে বাড়ী থেকে বার করে আনো৷ যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি ততক্ষণ আমি তোমাদের ওই লোকটির কাছে যেতে দোবনা–তা সে সংখ্যায় তোমরা হাজারই হও, লাখই হও৷ আক্রমণকারীরা বলতে বলতে গেল, ‘‘দেওতা হ্যায়৷’   (শব্দ–চয়নিকা, ১৩শ খণ্ড)