১৯শে স্মরণে শিলংএ আলোচনা চক্র আমার ভাষা আমার পরিচয়

লেখক
সাধন পুরকায়স্থ

৯শে মে,২০২৩ শুক্রবার মেঘালয়ের রাজধানী শৈল শহর শিলংয়ে ‘রিলবং হিন্দু ধর্মসভা মিলনায়তনে সকাল ১১টা থেকে উত্তর-পূর্ব ভারত  বাংলা সাহিত্যসভার দ্বারা আয়োজিত ও মেঘালয় বাঙালী সমাজ-এর সহযোগিতায় এক অধিবেশনের আয়োজন করা হয়েছিল৷ অধিবেশনের মূল বিষয় ছিল, ‘‘আমার ভাষা, আমার  পরিচয় ১৯শে স্মরণ৷’’ ....

অধিবেশন চার ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল! প্রারম্ভিক অধিবেশনে, রিলবং স্পোর্টস এণ্ড কালচারাল ক্লাবের Women's Wing -এর অধ্যক্ষা শ্রীমতী রীতা ঘোষ এই অভূতপূর্ব মহতী সম্মেলনের প্রশংসা করে আজকের অনুষ্ঠানের সভাপতি পদ্মশ্রী মানস চৌধুরীকে আসন গ্রহণ করে স্বাগত ভাষণ দিতে অনুরোধ জানালেন৷ সভাপতি অত্যন্ত সাবলীলতায় উত্তর-পূর্ব ভারতের বাংলা সাহিত্যসভার সভাধ্যক্ষ শ্রী কমল দত্ত মহাশয় অসমের বিধায়ক শ্রীকমলাক্ষ দে পুরকায়স্থ সহ আরো কজন গণ্য মান্য ব্যক্তিকে উল্লেখ করে, সভাকক্ষে উপস্থিত সকলকে সবিশেষ আন্তরিকতার সঙ্গে স্বাগত জানালেন৷

এবার উপস্থিত সভাবৃন্দের দ্বারা ভাব পরিবেশে সম্পন্ন হলো শহীদ তর্পন! আত্মবলিদানকারী অমর শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে পালন করা হলো এক মিনিটের নীরবতা৷ উত্তর-পূর্ব বাংলা সাহিত্যসভার প্রয়াত প্রাক্তন কার্যকরী সভাপতি স্বর্গত শ্যামল রায়-এর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনায় পালন করা হয় মৌনব্রত৷

সভাপতি তাঁর বক্তব্যে বিস্তারিতভাবে উত্তরপূর্ব তথা শিলংয়ের বাঙালীদের দুর্দশার কারণ হিসেবে দেখালেন, বিভিন্ন প্রদেশের বাংলাভাষীদের সাথে ভাবগত দুরত্ব! সকল সমস্যাই হয়ে উঠেছে স্থানীয় সমস্যা! এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন যে একই দুর্দশার শিকার বিভিন্ন স্থানের বাঙালীদের আলিঙ্গন করে, জোটবদ্ধ হয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে হবে৷ তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, ১৯৬০ এর ২রা জুলাই অবিভক্ত অসমের পার্বত্য নেতারা সেই আন্দোলনে বাঙালিদের সাথে যোগদান করেছিল৷ কিন্তু আজ ৬২ বছর পর আমরা ওদের উন্নতি লক্ষ করি আর নিজেদের অবনতির জন্যে অসহায়তা অনুভব করি৷ প্রায় প্রত্যেক উপজাতি, জনজাতি পেয়েছে তাদের রাজ্য, কিন্তু আমরা কি পেলাম...এই বক্তব্য দিয়ে ইতি টানেন৷

এরপর অসমের টংলাস্থিত যোগানন্দ সংগীত-নৃত্য মহাবিদ্যালয়-এর ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বারা পরিবেশিত হলো মনোগ্রাহী দেশাত্মবোধক গান ও নাচ৷

সঞ্চালিকা এবারে আহ্বান জানালেন কার্যকরী সভাপতি শ্রীকমল দত্ত মহাশয়কে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উত্তরীয় পরিয়ে সম্বর্ধনা দেবার জন্য৷

অতিথি পরিচিতির পর শ্রী সঞ্জয় সাহা (সাধারণ সম্পাদক, সাহিত্য সভা) সভার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বললেন, অসমে হয় বাংলা মাধ্যমের বিদ্যালয় সমূহ একেবারেই নিশ্চিহ্ণ করে দেওয়া হচ্ছে অথবা রূপান্তরিত করা হচ্ছে অসমিয়া মাধ্যমের বিদ্যালয়ে৷

এই সংস্থার মাধ্যমে উত্তরোত্তর স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীদের, বাঙালীদের ভাষাগত, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধে দেবার জন্য, কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছুই ফলপ্রসূ হলো না তিনি আর্তি জানিয়ে বললেন যেনো এ ব্যাপারে জোরদার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷

ত্রিপুরার ধর্মনগর থেকে আগত শিক্ষক ও লেখক শ্রী জ্যোতির্ময় রায় বলেন---১৯৬০ এর বরাক উপত্যকার ইতিহাস আমাদের মনে আলোড়ন  জাগায়, তাই এতো বছর পরেও আমরা প্রদীপ প্রজ্বলন করে, নৃত্য-গীতে সমৃদ্ধ অনুষ্ঠানের আয়োজন করি কিন্তু আমরা যারা নিজেদের সুনাগরিক বলি আমাদের আজ আত্ম-জিজ্ঞাসার দিন, আত্মবিশ্লেষণের দিন৷ নিজেদের ভাষা-সংসৃকতি রক্ষায় সকল জনজাতি নিজেদের আখের গোছালো আর আমরা কিছুই করে উঠতে পারলাম না! উদাহরণ দিয়ে বললেন, গোয়ালপাড়ায় ৩০৬টি বাংলা স্কুল ছিল, বর্তমানে টিকে আছে মাত্র ৩টি!

তিনি বললেন যে আমরা নিজের মাতৃভাষাকে ভালবাসবো ও অন্যভাষাকেও শ্রদ্ধা করবো৷

শিলচর থেকে আগত শ্রী মিহির নন্দী বলেন-১৯শে ও ২১শে এখনো যারা সঠিকভাবে জানেন না, তাদের জেনে নিতে হবে৷ আমাদের অঙ্গীকার হউক আগ্রাসনের রাজনীতি থেকে আমাদের মাতৃভাষাকে বাঁচানো৷ তিনি পদ্মশ্রী মানস চৌধুরীর এই সংস্থা ঘটন করার উদ্যোগকে প্রশংসা করে প্রস্তাব রাখেন যেনো প্রতি বছরই ১৯শে স্মরণে সকল উঃ-পূ রাজ্যের বাংলাভাষীদের একত্রিত করে সকলের সমস্যা এক জায়গাতে করে সমাধান করা হয়৷

শ্রীমতী মালবিকা বিশারদ বাঙালীর অস্তিত্ব সংকটের কথা বললেন ও শিলংয়ে যে পরবর্তী প্রজন্ম কেউ থাকবে না, সেই আশঙ্কা ব্যক্ত করলেন৷ গুয়াহাটি থেকে আগত শ্রী সুভ্রাংশু দেব বলেন আমাদের অধিকারের কথা, মর্যাদার কথা আমাদের সংবিধানকে ভিত্তি করেই অধিকার লাভের কথায় তিনি জোর দেন৷

নাগাল্যাণ্ড থেকে আগত শ্রীবিষ্ণু ভট্টাচার্য অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে তাঁর বক্তব্য রেখে বললেন যে তিনি রবাহুত এসেছেন জানাতে যে ২০শে মে থেকে নাগাল্যাণ্ডে জারি হচ্ছে..! প্রায় ৭০,০০০ বাংলাভাষী এবার হবে ঘরছাড়া! আমরা উত্তর-পূর্বের বাঙালীরা সভার কাছে তাঁর প্রশ্ণ আমরা কেন জনগণ গাই, কেন নাগাল্যাণ্ড থেকে একজনও ডাক্তারী পড়তে যায় না৷... এসকল বিষয়ে চিন্তার খোরাক দিয়ে তিনি বক্তব্যের ইতি টানেন৷

শ্রীকেশব দাস,(অসম) বললেন উনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে চলবেন৷ তিনি হতাশ হয়ে বলেন, মুখ্যমন্ত্রী,স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন কি প্রধানমন্ত্রীকেও বহুবার আমাদের অবস্থার  অবগতির জন্যে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি৷ অসমের সংসদে ১০জন বাঙালীদের প্রতিনিধি আছেন, একজনও  আমাদের হয়ে কোনো উচ্চ-বাচ্য করেন না৷

শ্রীবিকাশ পাল চৌধুরীর জিজ্ঞাস্য আমাদের খামতি কোথায় ও আমরা সামগ্রিকভাবে কি করতে পারি, এই বিষয়ে যেন আলোকপাত হয়৷

নাগাল্যাণ্ড থেকে আগত বাংলার শিক্ষক শ্রীদিলীপ দাস বলেন বাংলাভাষার এই পরিণতির জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী৷ সকলের ছেলে-মেয়েরাই ইংরেজী মাধ্যমে পড়েছে বা পড়ছে৷ ওরা বাংলা জানে না৷ তিনি বলেন, উত্তরনের পথ একটিই আমাদের পণ নিতে হবে যে...ছেলে-মেয়েরা ‘‘ইংরেজী পড়বে...সংগে বাংলাও পড়বে৷

শিলংয়ের শ্রী জয়ন্ত লাল দাস এর বক্তব্যের সারাংশ হলো, আমাদের জোটবদ্ধ হয়ে এগোতে হবে,সংঘটনকে শক্তিশালী করতে হবে ও এই সংস্থার একটি সংবিধান তৈরী  করতে হবে৷

শিলং এর ডঃ সমরকান্তি চট্টোপাধ্যায় আশ্বাস দিয়ে বলেন ভাষা ও সংসৃকতির মাধ্যমেই আমাদের শিকড় শক্ত হবে ও সমাধানের সকল আলোচনার মাধ্যমে বের হয়ে আসবে৷

শ্রী নীহার কুমার দেবনাথ, অত্যন্ত রাগে দুঃখে তাঁর হতাশার প্রকাশ করে বলেন যে বহুদূর থেকে আসা প্রত্যেককেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিস্তারিতভাবে অভিযোগগুলি বলার সুযোগ দেওয়া উচিত৷

প্রত্যুত্তরে সভার অধ্যক্ষ ‘পদ্মশ্রী মানস চৌধুরী’ তাঁর উষ্মা প্রশমিত করতে বলেন সময়াভাবের কারণেই সম্মানীয় প্রতিনিধিদের নিজস্ব স্থানে থেকে মাইকে বক্তব্য রাখতে অনুরোধ করা হয়েছে ও এই সিদ্ধান্ত বার বার মঞ্চে ওঠা-নামার সময় বাঁচানোর জন্যেই নেয়া হয়েছে৷এরপর বাংলাদেশের শেখ রেজাউদ্দিন বললেন যে বাংলাদেশ ভাষাকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতা লাভ করেছে৷ ৭ শতাংশ লোক, ৫৬ শতাংশ লোকের উপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করাতেই প্রথমে বিক্ষোভ দিয়ে শুরুহয় যুদ্ধ দিয়ে শেষ হলো৷ শেষ কথা তাঁর ‘বাংলা সবার মুখে থাকুক৷’’                   ---শ্রীমতী সুদিপ্তা ভট্টাচার্যের লেখনী থেকে সংগৃহীত