আলো ও অন্ধকার

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

কলকাতা মহানগরীতে যেমন একদিকে আলোকসজ্জা, তেমনি আবার তার পাশেই ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ মহোল্লাসের পাশাপাশি ফুটপাতে ক্ষুধার্ত শিশুদের কান্না৷ রঙীন পোষাকের জৌলুসের পাশাপাশি মলিন ছিন্ন বস্ত্র পরিহিত শিশু ও মহিলার করুণ চাহনি৷ মহানগরীর এই বিপুল উৎসবের কোলাহলে চাপা পড়ে যায় মহানগরীর এই আর এক চিত্র৷ কোনচিত্র ? এই মহানগরীতেই বাস করে ৭০ হাজার গৃহহীন মানুষ৷ যাদের মাথা গুঁজবার মত কোনো গৃহকোণ নেই৷ ওরা বাস করেন ফুটপাথে, কোথাও বা উড়ালপুলের নীচে বা এমনিভাবে কোথায় একটুকু জায়গা পেলে অস্থায়ী ঝুপড়ি বেঁধে৷ সবাইকে নিয়ে আনন্দের মধ্যেই তো উৎসবের সার্থকতা৷ তাহলে এই উৎসবের সার্থকতা কোথায়? চারদিনের এই দুর্র্গেৎসবে বিপুল আড়ম্বরে মোট ব্যয়-হচ্ছে প্রায় ১২৩ কোটি টাকার ওপর৷ এমন কিছু কিছু পূজা আছে যেখানে ভারতের বিখ্যাত বিখ্যাত মন্দিরে অনুরূপে গড়ে তোলা প্যান্ডেল, তার সঙ্গে ঠাকুর ইত্যাদি তৈরীর খরচ মিলে প্রায় ১ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে৷ অধিকাংশ পূজা প্যান্ডেল একেবারে ঘরোয়া ভাবেও যাঁরা পূজা করছেন সেখানেও অন্ততঃ পক্ষে দেড়লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে৷ এমনি করে এই কয়েকদিনেই এই ১২৩ কোটি টাকা হাউইয়ের মত জ্বলে ছাই হয়ে যাবে৷ কলকাতায় যেমন দুর্র্গপূজা৷ মুম্বাইতে গণেশপূজা৷ কোথাও হনুমান পূজা এমনিভাবে ভারতে বিভিন্নস্থানে পূজার আড়ম্বর ও বিপুল অর্থের অপচয়৷ এই হ’ল আমাদের পরিচিত চিত্র৷ আর তারই পাশেরই আর এক পরিচিত চিত্র হ’ল গৃহহীন, দারিদ্র্য সীমারেখার নীচে থাকা, কর্মহীন, সহায় সম্বলহীন মানুষের করুণ চিত্র৷ সম্পদের এই চরম অসম বন্টন যে কোনো সংবেদনশীল মানুষকেই ব্যথিত করে৷ নীতিগতভাবে এটা মেনে নিতেই হবে, এই বিশ্বের কোনো সম্পদ কারুরই ব্যষ্টিগত সম্পদ নয়৷ সমস্ত সম্পদের প্রকৃত মালিক তিনি, যিনি এক স্রষ্টা অর্র্থৎ পরমপিতা ব্রহ্ম৷ সমস্ত মানুষ তো তাঁরই সন্তান৷ তাই, প্রাউট-প্রবক্তা প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন,‘‘এই বিশ্বজগৎ আমাদের সকলকার পৈত্রিক সম্পত্তি৷ আমরা সকলে এক বিশ্বভিত্তিক যৌথ পরিবারের সদস্য৷ পরমপুরুষ আমাদের পিতা৷ যৌথ পরিবারের সদস্যদের মতই আমাদের উচিত ‘নিজে বাঁচ ও অপরকে বাঁচাও’ নীতি নিয়ে চলা, বিশ্বে ব্যবহৃত সমস্ত সম্পদ কোনো বিশেষ ব্যষ্টি, রাষ্ট্র বা জাতির সম্পত্তি নয়৷ সকলের কেবল এই সম্পদ ভোগ করার অধিকার আছে মাত্র৷ এই ‘ভূমা উত্তরাধিকার’ মেনে নিয়ে যাবতীয় লোকায়ত ও লোকোত্তর সম্পদের সদব্যবহার আমাদের করতে হবে৷ এটাই আমাদের সামাজিক ধর্ম৷ কেবলমাত্র সামাজিক বিবেচনার দিক থেকেই নয়, যুক্তি ও ন্যায়বিচারের দিক থেকেও এটাই একমাত্র পথ৷’’ এই সত্যকে কেউ অস্বীকার করতে পারেন না৷ তবুও আমাদের সেই সমাজ সচেতনতা কই? আমরা লক্ষ লক্ষ টাকা উড়িয়ে কয়েকদিনের আনন্দোল্লাসে মেতে ওঠার সময় একবার কি ওঁদের কথা ভাবি, যাঁরা অন্নাভাবে ক্ষুধায় কাতর হয়ে শুকিয়ে মরছেন! ‘সমাজ’ কথাটির অর্থই তো সবাইকে নিয়ে এগিয়ে চলা৷ তাহলে শারদোৎসবের মহোল্লাসে মেতে উঠে লক্ষ লক্ষ টাকা জলের মতো ব্যয় করার সময় কেন ওঁদের কথা আমরা ভাবি না---যাঁদের অন্ন,বস্ত্র, চিকিৎসাদি বাঁচার নূ্যনতম ব্যবস্থা নেই৷ আমরা যে লক্ষ লক্ষ টাকা বা কোটি কোটি টাকা এভাবে নষ্ট করছি, যদি এর অর্দ্ধেক টাকা ওই সব ক্ষুধার্ত, গৃহহীন বস্ত্রহীন মানুষদের দুঃখ দূর করার জন্যে ব্যয় করি তাহলে তো আমাদের মনের বিস্তার ঘটবে, আমাদের আনন্দ আরও বর্দ্ধিত হবে৷ সমাজে এই যথার্থ ‘সম-সমাজ’ বোধের ব্যাপক জাগরণ দরকার৷ তবেই তো আমরা বলতে পারবো, আমরা যথার্থ সভ্য, যথার্থ উন্নত৷ মানবিকতাকে পদদলিত করে যে সভ্যতার চাকচিক্য প্রদর্শণ তা তো প্রকৃত সভ্যতার পরিচয় হতে পারে না৷ তা তো প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিতের লক্ষণ হতে পারে না৷ তাতো সমাজ সচেতনতার প্রকৃত প্রতিফলন হতে পারে না৷ মানুষ সামাজিক জীব৷ সবাইকে সাথে নিয়ে মনুষ্যত্বের পূর্ণতা অর্জনের পথে এগিয়ে চলাই তো জীবন৷ আর এই মানসিকতার বিস্তারকেই প্রকৃতপক্ষে সভ্যতার উন্নতি বলা যেতে পারে৷ অনেকে বলতে পারেন, আমরা তো আমাদের পূজা কর্মসূচীর শেষে নারায়ণ সেবার ব্যবস্থা করি, বা কিছু গরীব মানুষকে বস্ত্র বিতরণ করি৷ কিন্তু একদিনের জন্যে বা কয়েকদিনের জন্যে কিছু মানুষকে খিচুড়ি খাওয়ালেন, কিন্তু পূজোর কয়েকদিন পরে তাদের যে অনাহারে অর্র্দ্ধহারে দিন কাটাতে হবে, তার কী হবে? দুর্র্গপূজার যৌক্তিকতা বা যথার্থতা নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ না করেও বলব, এই মহাড়ম্বরপূর্ণ পূজায় যে কোটি কোটি টাকার অপচয় হচ্ছে এর অর্র্দ্ধংশও যদি জনগণের স্থায়ী কল্যাণের জন্যে ব্যায়িত হয়, তাতেও জনগণের অনেক কল্যাণ সাধিত হবে৷ এইভাবে যদি সমস্ত পূজা কমিটিগুলিও তাদের বাজেটের অন্ততঃ অর্দ্ধেক অর্থ দিয়ে স্থায়ীভাবে জনসাধারণের কল্যাণের জন্যে কোনো প্রকল্পে ব্যয় করেন, তাতেও সমাজের যেমন অনেকখানি কল্যাণ হবে, সঙ্গে সঙ্গে পূজার আনন্দও বৃদ্ধি পাবে৷