গীতার ধ্যানে বলা হয়েছে ---
‘‘সর্র্বেপনিষদো গাবো দোগ্দা গোপালনন্দনঃ৷
পার্থো বৎসঃ সুধীর্ভোক্তা দুগ্দং গিতামৃতং মহৎ৷৷’’
অর্থাৎ উপনিষদসমূহ গাভীর ন্যায় শ্রীকৃষ্ণ সেগুলো দোহন করছেন অর্জুন গোবৎস স্বরূপ আর সুধীজন অমৃতস্বরূপ গীতাদুগ্দ পান করছেন৷ আমাদের ধারণা ঠিক তদ্রুপ সমগ্র আনন্দসূত্রমের নির্যাস হচ্ছে প্রগতিশীল উপযোগতত্ত্ব আর শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তার অমৃতরস দহন করে আমাদের দিয়েছেন পান করার জন্য৷
গীতাপাঠের সময় যেমন শুধু, হাতে ফুল-তুলসি নিয়ে বসে শুনলেই গীতামৃত সেবন করা হয় না, সেইসব অমৃতবাণী হৃদয়ঙ্গম করা, অন্যকে অমুধাবন করানো, স্বীয়জীবনে প্রতিফলিত করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে গীতার সার্থকতা৷ তেমনি একই কথা প্রাউট দর্শন প্রসঙ্গে প্রযোজ্য৷ বর্তমান বিশ্বের আর্থসামাজিক যে চিত্র আমাদের সামনে রয়েছে তা দেখে আর যাই হোক এমন কথা ভাবার কোন অবকাশ নেই যে একবিংশ শতিকার এই মানবসভ্যতা যথেষ্ট উন্নত হয়েছে অথবা এই সভ্যতা তার পরম লক্ষ্য অর্থাৎ ব্রহ্ম সম্প্রাপ্তির দিকে এগিয়ে চলেছে৷ সভ্যতার একটা পরম লক্ষ্য রয়েছে একথা শুধু প্রাউট প্রবক্তা ছাড়া অন্যান্য শ্রদ্ধেয় মনীষীগণও বার বার বলেছেন৷ যদিও শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলার সঙ্গে অন্যদের বলার মৌলিক পার্থক্য অবশ্যই রয়েছে৷
কোন স্থপতি যখন আপনার জন্য একটি বাড়ির নক্সা তৈরি করেন তখন তিনি আপনার প্রয়োজন, রুচি আর্থিক সামর্থ্য ইত্যাদির খবর জেনে জমির গুণাগুন ও পরিমাণের উপর ভিত্তি করে একটি নক্সা প্রস্তুত করেন৷ যা দেখে দেখে রাজ মিস্ত্রি ও অন্যান্য কর্মীরা মিলে বাড়িটি গড়ে জমির গুণাগুণ ও পরিমাণের উপর ভিত্তি করে একটি নক্সা প্রস্তুত করেন৷ যা দেখে দেখে রাজ মিস্ত্রি ও অন্যান্য মিস্ত্রি ও অন্যান্য কর্মীরা মিলে বাড়িটি গড়ে তোলেন৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তেমনি সুদক্ষ স্থপতির মত মানূ সমাজের , মানুষের মনস্তত্ব বুঝে, নোতুন দর্শনের প্রবর্তন করেছেন৷ স্থাপত্যবিদের নক্সা ও রাজ মিস্ত্রি, মজুর লোকজন লাগিয়ে একটা বাড়ি নির্মাণ এই দুইয়ের মধ্যে যেমন বিস্তর ফারাক রয়েছে৷ ঠিক তেমনি মানব সমাজের সার্বিক কল্যাণার্থে রচিত একটি দর্শন ও তার বাস্তবায়নের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে৷ স্থপতিকৃত নক্সাটি নিয়ে যখন আপনি নির্দিষ্ট জমিতে পৌঁছুবেন তখন হয়তো দেখলেন সেখানে নারকেল, সুপুরি, আম, জাম,কাটাল ইত্যাদি অনেক রকমের গাছ-পালা রয়েছে সেগুলো পরিস্কার করতে হবে, জমি সমান করতে হবে ইত্যাদি৷ এইসব কিছু সেরে তবেই মূল বাড়ির কাজে হাত দেওয়া যাবে৷ দর্শন বা তত্ত্বের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য৷ বস্তুত একটি আর্থসামাজিক দার্শনিক তত্ত্ব শুনতে যতটা মধুর বলে মনে হয় সেটা বাস্তবের মাটিতে রূপায়ণ করা ততোধিক কঠিন প্রাউট প্রবক্তার মতে মার্ক্সবাদ প্রমাদগ্রস্ত দর্শন যদিও কার্ল মার্ক্সের চিন্তাতে মানব কল্যাণের কথাই ছিল৷ সে কথা স্বীকার করেই শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী কার্ল মার্ক্সের নামের সঙ্গে ‘মহামতি’ বিশেষণটি ব্যবহার করেছেন৷ মার্ক্সবাদের ব্যর্থতার জন্য মার্ক্সের দর্শন যতটা দায়ী তার চেয়েও অনেক বেশি দায়ী তার প্রয়োগ নীতি, কৌশল বা মার্ক্সবাদের প্রায়োগিক ব্যর্থতার বিষয়টি খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর রাশিয়ার চিঠি প্রবন্ধমালায়৷ প্রাউট দর্শন নিয়ে যাঁরা চিন্তভাবনা করেন তাঁদের কাজে লাগতে পারে ভেবে আমরা এ সম্পর্কে কবিগুরুর কিছু কথা এখানে উদ্ধৃত করছি৷ ‘এরমধ্যে (মার্ক্সবাদে) গলদ কিছু ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেকে না--- সজীব মনের সঙ্গে বিদ্যার তত্ত্ব যদি না মেলে তা হলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে, আড়ষ্ট হয়ে, কিংবা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে৷’’ (রবীন্দ্র-রচনাবলী, সুলভ সংস্করণ, দশম খণ্ড পৃঃ ৫৫৬) এটি রুশ বিপ্লবের তের বছর পর ১৯৩০ সনের ৩০শে সেপ্ঢেম্বর লেখা৷ মার্ক্সবাদ যে তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়েছে তার অন্যতম প্রধান কারণ মার্ক্সীয় শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি৷ এসব ভেবেই শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী নব্যমানবতাবাদী শিক্ষাব্যবস্থাকে আনন্দমার্গ দর্শনের অঙ্গীভূত করে রেখেছেন৷ রবীন্দ্রনাথ অন্যত্র বলেছেন’’--- প্রয়োগের দ্বারাই মতের বিচার হতে পারে এখনও পরীক্ষা শেষ হয়নি৷ যে কোন মতবাদ মানুষ সম্বন্ধীয় তার প্রধান অঙ্গ হচ্ছে মানবপ্রকৃতি৷ মানব প্রকৃতির সঙ্গে তার সামঞ্জস্য কী পরিমাণে ঘটাবে তার সিদ্ধান্ত হতে সময় লাগে৷ তত্ত্বটাকে সম্পূর্ণ গ্রহণ করবার পূর্বে অপেক্ষা করতে হবে৷ তবু সে সম্বন্ধে আলোচনা করা চলে, কেবলমাত্র লজিক নিয়ে অঙ্ক কষে নয়---মানবপ্রকৃতিকে সামনে রেখে৷’’ (তদেব, পৃঃ ৬০০) এই যে প্রয়োগের দ্বারা মতের বিচার এই দৃষ্টিকোণ থেকেই প্রাউট তত্ত্বকে ‘‘প্রয়োগভৌমিক’’ তত্ত্ব বলা হয়েছে সমবায় মানে জনসমষ্টি বা সংঘ আবার কমিউন মানেও জনসমষ্টি বা সংঘ৷ কিন্তু প্রাউট প্রবক্তার সমবায়ের জনসমষ্টি ও কমিউনের জনসমষ্টির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে৷ জনসমষ্টির অন্তর্ভুক্ত মানুষগুলির মধ্যে পরস্পর সৌভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক না থাকলে সমবায় বা কমিউন কোনটাই সফল হতে পারবে না৷ কার্ল মার্ক্সের সবচেয়ে বড় ত্রুটি এই যে তিনি মানুষকে কখনোই পূর্ণাঙ্গ মানুষ বলে গণ্য করেননি৷ প্রাউট প্রবক্তা তাঁর দর্শনে মানুষকে পূর্ণ মানুষের মর্যাদা দিয়ে মার্ক্সীয় দর্শনের ত্রুটি থেকে প্রাউট দর্শনকে মুক্ত রেখেছেন৷
মাধ্যমিক শ্রেণীর জন্য উপযুক্ত না হলে যেমন কোন ছাত্রছাত্রাকে মাধ্যমিকের পরীক্ষায় বসতে দেওয়া উচিত নয় তেমনি যে মানব সমাজের জন্য প্রাউট দর্শন সেই সমাজের মানুষকে প্রাউট তত্ত্ব গ্রহণের উপযুক্ত করে গড়ে না তুলেই প্রাউট ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার প্রবর্তনের চেষ্টা ঘোড়ার আগে গাড়ী জুড়ে দেবার মত কাজ৷
ঘোড়ার আগে গাড়ী জুড়ার চেষ্টা হচ্ছে বলেই অনেকেই সস্তায় নেতা হয়ে বাজি মাত করতে চাইছেন৷ প্রাউট দর্শন থেকে স্বতন্ত্র এই জন্যই যে, এই দর্শনের স্রষ্টা সর্বজ্ঞ৷ শুধু তাই নয় যারা সস্তায় বাজি মাত করতে চান তাদের উপর রয়েছে তাঁর তীক্ষ্ন দৃষ্টি৷ সময় এসেছে প্রাউটকে যাঁরা ভালবাসেন তাঁরা সমবেতভাবে বসে প্রাউটের প্রয়োগকৌশল সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণের জন্য উদার মনে আলোচনা করে পথ বের করুন৷ প্রচলিত রাজনৈতিক দলসমূহের মত মানুষের ভাল করার ভূয়ো প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতা দখল করার রাজনীতির সঙ্গে প্রাউট বাস্তবায়নের কোন সম্পর্ক নেই৷ প্রাউট অর্থনীতির প্রায় সমস্ত কিছুই সমবায় পরিচালিত৷ রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তনের পর সমবায় আন্দোলন সম্ভব হলেও সফল হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ৷ কিন্তু সমবায় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে যুক্ত করে রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন হলে তা বিফল হওয়ার কোন সম্ভাবনাই থাকবে না৷
প্রথমটি অর্থাৎ ধর্ম, ভাষা, জাত-পাত ইত্যাদির ভিত্তিতে আবেগ সৃষ্টি করে মানুষ ক্ষেপিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার অত্যন্ত সহজ বিষয়, যা আমরা আকছাড় প্রত্যক্ষ করছি৷ কিন্তু মানুষের কল্যাণ করতে করতে, মানুষকে আপন করে তাদের সঙ্গে নিয়ে তাদের সহযোগিতা নিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন কঠিন কিন্তু সেটা চিরস্থায়ী৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী কাছ থেকে আমরা কোনটা প্রত্যাশা করি--- সহজ রাস্তা না কঠিন?
এই আলোচনায় প্রাউটের প্রাসঙ্গিক প্রশ্ণ এই যে, প্রাউটের সঙ্গে মার্ক্সবাদের তুলনা কেন? আমাদের মনে হয় বাড়ির আয়তন, উচ্চতা,সৌন্দর্যায়ন এসব বিচার করে তার নক্সা ভিন্ন ভিন্ন হতেই পারে৷ কিন্তু নির্মাণশৈলী মোটামুটি একই ধরণের হবে এটাই স্বাভাবিক৷ পৃথিবীর যেখানেই মার্ক্সবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছে সেখানেই একই ভুল মার্ক্সবাদীরা করেছিলেন৷ ক্ষমতা আগে দর্শনের বাস্তবায়ন পরে৷ প্রাউট তত্ত্বের বাস্তবায়ন নিঃসন্দেহে একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া৷ প্রাউট প্রবক্তার মতে---‘‘যে সিদ্ধান্ত প্রয়োগভূমি থেকে আত্মপ্রকাশ করে তাকে স্বল্পায়াসেই বাস্তবে রূপায়ণ করা যায়৷ সে সিদ্ধান্ত অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে৷ কেবল প্রচেষ্টা ও কেমনভাবে হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করবে কতটা সময়ে তা বাস্তবায়িত হবে৷ (কণিকায় প্রাউট, পঞ্চম---অষ্টম খণ্ড পৃঃ ১৪১) প্রবক্তা একই প্রবচনে বিষয়টিকে আরও প্রাঞ্জলভাবে ব্যক্ত করেছেন---‘যেখানে সিদ্ধান্ত প্রয়োগভূমিকে অনুসরণ করে৷ প্রথমে প্র্যাকটিক্যাল বা রূপায়ণের দিক---তারপর সিদ্ধান্ত বা থিওরী (তদেব পৃঃ ১৪৪) তিনি আপেল পতনের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে দৃৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছেন---‘‘আপেল মাটিতে পড়ার পর সিদ্ধান্ত তৈরী হল---সিদ্ধান্ত তৈরী হবার পর আপেল মাটিতে পড়ে নি৷’’ এখানেও সেই বাস্তবায়নেইরই প্রশ্ণ৷
- Log in to post comments