অরণ্য বিস্তারের নামে চলছে  জমি দখল, মোদির বানানো জাতীয় অরণ্যনীতি ধবংস করবে অরণ্য

লেখক
মহির কুমার দত্ত

(১) সম্প্রতি  পশ্চিমবঙ্গ সরকার  বক্সা সংরক্ষিত অরণ্য গড়ে  তোলার অজুহাতে অরণ্যের  মধ্যে  থাকা গ্রামগুলোকে  উচ্ছেদ করতে  শুরু করেছে৷

(২) ইতোমধ্যে  অসমের  বিজেপি সরকার সেখানকার  অভয়ারণ্য বৃদ্ধি করার নামে  বহু গ্রামের গ্রামবাসীদের  গ্রাম ছাড়া করে দিয়েছে৷

(৩) ঝাড়খন্ডের  যদুটোলা গ্রামের  বাসিন্দারা অরণ্য উচ্ছেদের  বিরুদ্ধে  প্রতিবাদ  জানালে  পুলিশ  সেই গ্রামের  সকল মানুষদের  বিরুদ্ধে  আইন শৃঙ্খলা ভাঙ্গার  অভিযোগে  মামলা দায়ের  করে গত ১৩ অক্টোবর , ২০১৭ সালে৷

নতুন অরণ্য সৃষ্টি করার অজুহাতে  মানুষ জমিহারা  হবে একথা  কেউ আগে জানতেন না৷ কিন্তু ওপরের তিনটি  ঘটনা  থেকে জানতে  পারা  যাচ্ছে যে এরকম উপায়  অবলম্বন  করেও মানুষকে ভিটে মাটি ছাড়া  করা যায়৷ বিশ্বাস করা কষ্ট হলেও এটা একেবারে  বাস্তব৷

ভারতীয় আইন অনুযায়ী কোনও অরণ্যকে কেটে  ফেলা হলে  তার বদলে  সমপরিমাণ জমিধিগ্রহণ করে  চারাগাছ লাগাতে  হবে৷ যদি  তেমন  জমি না পাওয়া যায় তবে অন্য জায়গায় দ্বিগুণ জমি নিয়ে  গাছ লাগাতে  হবে৷ এই নিয়ম অনুসারে  গ্রামসভার  অনুমতির কোনও দরকার পড়ে না৷ এমন ঘটলে পরিবেশ  আন্দোলনকারীরাও সরকারের দিকে আঙ্গুল তুলতে পারবে না৷ অন্যদিকে  আন্তর্জাতিক  ক্ষেত্রেও দেখানো  যাবে যে ভারতে অরণ্য ক্রমশই বেড়ে চলেছে৷ এক্ষেত্রে ২০০৬ সালে ঘোষিত অরণ্য অধিকার আইনকেও মানার দরকার পড়ছে না৷

নরেন্দ্রমোদীর সরকার অরণ্য অধিকার আইনকে অনেক আগেই  বাতিল করে দিয়েছে৷ এখন অরণ্যের ক্ষেত্রে গ্রামসভার  অধিকারও খর্ব করার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ সরকারের আনা নতুন প্রস্তাবে গ্রামসভার কাজ  কি হবে তাও নির্দিষ্ট করে বলা নেই৷ অথচ আগের আইনে অরণ্য সংক্রান্ত যে কোনও কাজে গ্রামসভাকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করার নিয়ম ছিল৷

অরণ্য রক্ষার কাজে যে রাজ্যগুলোতে গ্রামসভাকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করা হয়েছে সেই রাজ্যে অরণ্য ও  প্রাণীদের উন্নতি ঘটেছে৷

১৯৮৮ সালে ঘোষিত অরণ্যনীতি যেখানে পরিবেশ  বান্ধব হওয়ার দিকে গুরুত্ব দিয়েছিল সেখানে ১৪ই মার্চ প্রস্তাবিত অরণ্যনীতি শুধুমাত্র কাঠের  দামের ওপর নির্ভর করে তৈরী করা হয়েছে৷ ১৯৮৮ সালের অরণ্যনীতিতে  অরণ্যবাসী মানুষেেদর জন্যে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু নতুন নীতিতে শুধুমাত্র কাঁচামালের  ভান্ডার হিসাবে  অরণ্যকে ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে৷ অনেকে বলছেন এই নতুন আইনে CAMPA) অরণ্য শব্দটিকেই বদলে দেওয়া হচ্ছে৷ অরণ্য বলতে শুধু কিছু গাছকে বোঝানো হয়৷ কিন্তু প্রাচীনকাল থেকে অরণ্য ও বাস্তুতন্ত্র অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত বলেই মনে করা হ’ত ৷ অরণ্য ধবংস করে কিছু চারাগাছ লাগানো হলে অরণ্যের বাস্তুতন্ত্র ফেরত আসে না৷  খবর পাওয়া গেছে এই চারাগাছ শুধুমাত্র বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে লাগানো হচ্ছে৷ কিছু কোম্পানিকে লিজ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ আবার কিছুক্ষেত্রে  অধিকৃত জমির কোনও খবরই অরণ্য বিভাগে e-green watch)-এর কাছে নেই অর্থাৎ জমি  অধিগ্রহণ  করাই হয়েছে অসাধু উদ্দেশ্যে, চারাগাছের  কোনও চিহ্ণই সেখানে পাওয়া  যায়নি৷

নতুন নীতিতে অরণ্য পরিচালনা করার জন্যে উদ্যোগ তৈরী ও  শিল্পের  জন্য অরণ্য  গড়ে তোলা, পরিচালনা করা ও ব্যবহারের নির্দেশ  দেওয়া হয়েছে৷ নয়া প্রস্তাবে পপলার ও ইউক্যালিপটাস গাছ  লাগাবার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে৷ কারণ এই গাছ তাড়াতাড়ি বড়ো  হয়  ও  এ কাঠ  বাজারে  বিক্রি করা যায়৷

নীতি নির্র্ধরণ কমিটির সদস্যরা খুব ভালো করেই জানেন যে, এই গাছেরা পরিবেশের  পক্ষে  কতোটা ক্ষতিকর৷ ২০১৫ সালের সংসদীয় কমিটির রিপোর্টে এই বিষয়ের  উল্লেখ করা হয়েছিল৷ তাতে বলা হয়েছে ইউক্যালিপ্টাস ভূগর্ভস্থ জলস্তরকে প্রয়োজনের  অতিরিক্ত খরচ করে ফেলে৷ এই গাছেদের শরীরে এমন এক রাসায়নিক থাকে যার কারণে  তাদের  আশে পাশের  অন্যগাছ বড়ো হতে পারে না৷ ব্যাঙ্গালুরুতে জলস্তর কমে  যাওয়ার কারণ  হিসাবে ইউক্যালিপটাসকেই দায়ী করা হয়েছিল৷ এভাবেই নতুননীতিতে অরণ্য ধবংসের পরিকল্পনা করা হচ্ছে৷

ভারতের প্রথম  এইভাবে অরণ্য ধবংস করতে শুরু করে ইংরেজরা৷ যখন তারা ঘোষণা করে দেশের সকল অরণ্য বন  দফতরের অধীন৷ এভাবেই ভারতের  প্রাকৃতিক সম্পদকে শোষণ করেই  নিজের দেশে শিল্পবিপ্লব করে ইংরেজরা৷

ভারতের বনাঞ্চলের মধ্যে এবং আশেপাশে  প্রায় ১.৩৭ লক্ষ গ্রাম আছে৷ দেশের সারে ৩কোটি থেকে ৪ কোটি মানুষ  এই অরণ্য অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে বসবাস করেন ও এই মানুষেরাই অরণ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছেন৷ এই মানুষদের মোট রোজগারের ৪০ শতাংশ আসে অরণ্য থেকে৷ নয়াপ্রস্তাবে এদের জন্যে পর্যটন, অরণ্যভিত্তিক কুটির শিল্প ও  অরণ্য সম্পদ সংগ্রহ করার জন্য  শ্রমিক হিসাবে কাজ করে যাওয়াই  নির্দিষ্ট করেছে৷ এভাবেই সরকার  অরণ্যে বসবাসকারী মানুষদের  অধিকার ছিনিয়ে নিচ্ছে৷

যদিও আমরা জানি সে, প্রাকৃতিক সম্পদ সম্পর্কে ভারতীয়দের ধারণা ধর্মের মোড়কে তাকে রক্ষা করা৷ বৈদিক সাহিত্য বলা হয়েছে৷ অরণ্য হল পৃথিবী গ্রহের অলঙ্কার, আমাদের  পূর্বজরা এই প্রাকৃতিক সম্পদগুলি ধবংসের বিষয়ে সচেতন ছিলেন বলেই  তাঁদের দেবী শক্তি সম্পন্ন বলে ঘোষণা করেছিলেন৷ আজও আদিবাসীরা ও বনবাসীরা অরণ্যকে দেবজ্ঞানে পূজা করে ও রক্ষা করে৷

সূত্র  Pollnet.org  / Draft National Forest Policy, 2018