গত ১০ই সেপ্ঢেম্বর বিশ্বের সর্বত্র আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস পালিত হ’ল৷ জানা গেছে প্রতি বছর প্রায় ৮ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করে’ তাদের মূল্যবান জীবনের অবসান ঘটায়৷
আত্মহত্যার মূল কারণ গুলো কী? প্রথমত: অর্থনৈতিক সমস্যা৷ বেকারত্বের জ্বালা সইতে না পেরে হতাশ হয়ে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়৷ কখনও কখনও কোনো কারখানা বা শিল্পে মালিক পক্ষ হঠাৎ তাদের কারখানা বা শিল্প বন্ধ করে দেয়৷ যেমন পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ করে হাওড়া ও হুগলিতে গঙ্গার তীরের বহু কারখানা মালিকপক্ষ বন্ধ করে দিয়েছে৷ তারা সমস্ত পুঁজি এখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে অন্যত্র সেই পুঁজি খাটিয়ে ব্যবসা পেতেছে ৷ এক্ষেত্রে যেখানে কারখানা বন্ধ হ’ল, বন্ধ কারখানার শ্রমিকরা হঠাৎ বেকার হয়ে পড়ে ও বছরের পর বছর কারখানা খোলার আশায় থেকে থেকে অনেকে অনাহারে অর্র্দ্ধহারে দিন কাটায়৷ তারপর আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়৷ উত্তর বঙ্গের চা বাগানের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে৷ বন্ধ চা-বাগানের শ্রমিকরা চরম দারিদ্র্য ও অভাবের মধ্যে অনেকেই হতাশ হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ও এখনও নিচ্ছে৷ বহু ছাত্র-ছাত্রা পরীক্ষায় মনের মত রেজাল্ট না হওয়ায় আত্মহত্যা করে৷ সুকল কলেজের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভালবাসার সম্পর্কের টানাপোড়েনেও আজকাল অনেক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে৷ জীবন সম্পর্কে হতাশা বোধও আত্মহত্যার অন্যতম কারণ৷
মানুষের জীবনে কোনো উচ্চ আদর্শ না থাকলে প্রাত্যহিক জীবনের নানান সমস্যা, দুশ্চিন্তা, ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষের মন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভেঙ্গে পড়ে৷ সে ভাবে, বেঁচে থেকে আর কী হবে! এর চেয়ে মৃত্যুই ভাল৷ সে তখন মানসিক অবসাদের শিকার হয় ও আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়৷ বিষয়-সম্পত্তির লোভে সন্তানেরা বাবা-মায়ের ওপর অত্যাচার করতে থাকায় অনেক সময় বাবা-মাও মনের দুঃখে আত্মহত্যা করে--- এমন ঘটনাও ঘটে৷
শ্বশুর বাড়ীতে পণের জন্যে স্বামী, শ্বশুর -শ্বাশুড়ীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরেও অনেক মহিলা আত্মহত্যা করে৷ আবার পুত্র না হয়ে কন্যার জন্ম হওয়ায় গৃহবধূর ওপর বহুক্ষেত্রে অকথ্য অত্যাচার চলে, তার ফলেও অনেক মহিলা আত্মহত্যা করে’ প্রাত্যহিক নির্র্যতন থেকে মুক্তি পেতে চায়৷
মানুষের বিভিন্ন আকাঙ্ক্ষা পূরণ না হলে হতাশাবোধ থেকে মানুষ নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সংকল্প নেয়৷
এই সবকিছুর পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়, সমাজে আত্মহত্যার প্রবণতা দূর করতে গেলে প্রথমে যা প্রয়োজন তা হ’ল যে পরিস্থিতি বা সমস্যাতে জর্জরিত হয়ে মানুষ আত্মহত্যা করছে ওই সমস্যার সমাধান করা৷ অনেক সমস্যা রয়েছে যার স্থায়ী সমাধানের জন্যে আজকের সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে৷ দেশের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব ও দারিদ্র্য সমস্যার সমাধানের ব্যবস্থা অবশ্যই করা উচিত৷ কিন্তু এটা সর্বৈব সত্য এই ধনতান্ত্রিক কাঠামোতে সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়৷ একমাত্র সমবায় ভিত্তিক প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের মাধ্যমেই এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব৷
পণপ্রথা, বধূনির্র্যতন প্রভৃতি সামাজিক সমস্যার সমাধানের জন্যে ব্যাপকভাবে সমাজ সচেতনতা চাই৷
বর্তমান জড়বাদী তথা ভোগবাদী জীবনধারারও আমূল পরিবর্তন জরুরী৷ মানুষের চার ধরণের জীবনদর্শন রয়েছে৷ প্রথমটা হল আত্মস্বার্থ কেন্দ্রিক,২য় হ’ল জড়কেন্দ্রিক, ৩য় হলো ডগমাকেন্দ্রিক, আর ৪থ ঈশ্বর কেন্দ্রিক৷ আত্ম স্বার্থকেন্দ্রিক জীবনদর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গি হ’ল--- যার কেন্দ্রে রয়েছে কেবল আপন স্বার্থপূর্তি৷ নিজের স্বার্থকে বড় করে দেখা, অন্যের স্বার্থ সেখানে নিতান্তই গৌণ৷ যেমন, বর্তমান ধনতান্ত্রিক সমাজদর্শন এই স্বার্থকেন্দ্রিক দর্শনের এক্তিয়ারে পড়ছে৷
তাই ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা মানুষে মানুষে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ বাধিয়ে দেয়৷ স্বার্থ নিয়ে সংঘর্ষ৷ ভাইয়ে-ভাইয়ে, মা-ছেলের পবিত্র সম্পর্কের মধ্যে সংঘর্ষ ঢুকিয়ে দেয়৷ অর্থ সম্পদ নিজের কুক্ষিগত করার উন্মাদনা সমাজের শান্তিকে বিঘ্নিত করে৷ এই উন্মত্ত প্রতিযোগিতায় যে হারে তাকে চরম মানসিক অবসাদ গ্রাস করে৷ আর এই মানসিক অবসাদ থেকে আসে আত্মহত্যার সংকল্প৷
আর জড়বাদীরা, জড়কেই যারা চরম মনে করে, তারাও শেষ পর্যন্ত আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক হয়ে যায়৷ কারণ, মানুষের মনের চাহিদার শেষ নেই৷ মানুষ যদি তার অনন্ত চাহিদাকে কেবল সীমিত জড়বস্তুর পেছনে ছুটিয়ে দেয়, তাহলে এই প্রতিযোগিতার কারণে স্বার্থের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে৷ এই প্রতিযোগিতায় যারা হেরে যায় তাদের সুস্থভাবে বাঁচার পথ বন্ধ হয়ে যায়৷
ডগমাকেন্দ্রিক যে সমস্ত দর্শন, যেমন অন্ধবিশ্বাসভিত্তিক তথাকথিত ধর্মমত, সেখানেও নিজের স্বার্থসিদ্ধিটাই বড় কথা৷ তাই স্বার্থের সংঘর্ষ ও তার পরিণাম আগের দুটিরর মতই৷
বাকি রইল, ঈশ্বরকেন্দ্রিক জীবনদর্শন৷ বলা বাহুল্য, এখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ভিত্তিক রিলিজিয়ানের কথা বলা হচ্ছে না৷ সার্বভৌম মানবধর্মের কথা বলা হচ্ছে৷ এখানে মানুষের অনন্ত ক্ষুধাকে কেবলমাত্র সীমিত জাগতিক ভোগ্যবস্তুর দিকে পরিচালিত না করে অসীম ভূমাসত্তার দিকে পরিচালিত করতে বলা হচ্ছে ও ‘যত্র জীব,তত্র শিব’ এই ভাবনা নিয়ে সমস্ত মানুষ, পশুপক্ষী, তরুলতাকে আপন করে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে৷ এখানে ভাবনা হবে, ‘সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে৷’ কেননা, সবার মধ্যেই তো সেই পরমেশ্বর বিরাজমান৷ আত্মোন্নতি ও জগতের কল্যাণ-এই আদর্শবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ যদি চলে তাহলে তাতে তার নিজেরও যেমন পরম কল্যাণ সাধিত হবে, তাতে সমগ্র সমাজেরও কল্যাণ৷ এখানে Strugle for existence’ বা অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে পরস্পর লড়াই করা নয়, বরং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলতে হবে৷ এই দৃষ্টিভঙ্গিই মানুষকে মানসিক অবসাদ থেকে স্থায়ীভাবে বাঁচাবে ও এই পারস্পরিক সহযোগিতাবোধই সর্বাঙ্গ সুন্দর আনন্দময় সমাজ তৈরীর যথার্থ আধারশিলা৷ মানুষের তখন হতাশ হওয়ার কোনো কারণ থাকবে না৷ এটাই প্রকৃত অধ্যাত্মচেতনা৷ এটাই মানুষের যথার্থ আদর্শ হওয়া উচিত৷ তবেই আত্মহত্যার অভিশাপ থেকে মানুষ মুক্তি পাবে৷
শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে, শুধু তাই নয়, তারও আগে থেকে, শিশুমনে এই আদর্শের বীজবপন করতে হবে৷ তাই শিশুকাল থেকেই মানুষ জানবে, আমরা কেউ অসহায় নয়, কেউ একা নয়, পারস্পরিক সহায়তার মাধ্যমে আমরা সবাই আমাদের জীবনকে চরিতার্থতার পথে এগিয়ে চলব৷ এই আদর্শবোধের জাগরণ ঘটাতে হবে৷ তবেই জীবন আনন্দময় হবে৷ তখন মানুষের জীবনের হতাশা বা আত্মহত্যার প্রশ্ণই আসবে না৷
- Log in to post comments