জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ী, ২২শে শ্রাবণ ১৩৪৮৷ সূর্য তখন মধ্য গগণে, ধরণীর কোলে তার তেজোদীপ্ত মহিমা ছড়িয়ে বিরাজ করছে৷ কিন্তু জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ীতে তখন বাংলার গৌরব রবি অস্তমিত৷ শোকে বিষাদমগ্ণ ঠাকুরবাড়ী, বিষাদমগ্ণ মহানগরী কোলকাতা৷ সেই বিষাদের ছায়া ক্রমে গ্রাস করল বাংলা, ভারত তথা গোটা বিশ্বকে৷ বিশ্বকবি আর এ বিশ্বে নেই৷
সত্যই কি কবি আর নেই! আর তিনি আসবেন না ফিরে! জগতে কত কিছুই তো যায়, আবার আসেও৷ এই যে বাইশে শ্রাবণ আজ রাতের শেষে বিদায় নেবে সেও তো আবার আসবে ফিরে৷ মাথার ওপর যে সূর্য আর কয়েক ঘণ্টা পরে অস্ত যাবে, এই সূর্যই আবার কাল সকালে উদয় হবে৷ কিন্তু বাঙালীর হৃদয় আকাশ থেকে ভালবাসার যে রবি আজ দ্বিপ্রহরে অস্ত গেল সে তো আর আসবে না ফিরে৷ আর উদয় হবে না৷ পড়ে রইল তাঁর জোড়াসাঁকো, তাঁর ভালবাসার সোনার বাংলা, তাঁর নিজ হাতে গড়া শান্তিনিকেতন৷ মাত্র দু’সপ্তাহ আগেই ছেড়ে এসেছেন তিনি তাঁর প্রিয় ছাতিমতলা, বকুলবিথী, শালবিথী, বেনুকুঞ্জ......৷ সব ছেড়েই তিনি গেলেন৷
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো শুধু একটা রক্তমাংসের শরীর নয়, যে সেটা ত্যাগ করলেই তাঁর যাওয়া হবে৷ তাঁর ভাষাতেই বলি---‘মোর নহে শুধুমাত্র প্রাণ, সর্ববিত্ত রিক্ত করি যার হয় যাত্রা অবসান৷’রবীন্দ্রনাথের মত মহামানবের দেহত্যাগ করলেই যাওয়া হয় না৷ তার কারণ তাঁর পরিচয় শুধু তাঁর রক্ত-মাংসের শরীর দিয়ে নয়৷ তাঁর রক্ত-মাংসের শরীর দিয়ে তাঁকে পরিমাপও করা যাবে না৷ রবীন্দ্রনাথের পরিচয় পেতে হলে, তাঁর পরিমাপ করতে হলে তাঁর সৃষ্টির মধ্যেই পেতে হবে৷ কবির কথাতেই বলি---‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি’ --- তাঁর সৃষ্টির পথেই তিনি রেখে গেছেন তাঁর পরিচয়৷
আমাদের জীবনের পরতে পরতে রবীন্দ্রনাথ৷ শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি যে কোনও বিষয়ে চিন্তার বাইরে রবীন্দ্রনাথ নেই৷ তাঁকে বাদ দিয়ে চিন্তা করাও যায় না৷ জীবনের প্রতিটি স্তরে যখন চরম অবক্ষয় তখন তো রবীন্দ্রনাথকেই বেশী মনে পড়ে৷
বর্তমান সমাজের সর্বস্তরে অবক্ষয়ের যুগে জীবনানন্দ দাশের একটা কথা একটু পরিবর্তন করে বলা যায়---‘বাংলায় গভীর আঁধার এখন’৷ এই আঁধারেও রবীন্দ্রনাথই আলো৷ বিশ্বকবি হয়েও তিনি নিজেকে বাঙালী কবি বলে পরিচয় দিতে দ্বিধা করেননি৷ যেমনটা আজকের একশ্রেণীর তথাকথিত বাঙালী বুদ্ধিজীবীরা করে থাকেন৷ রাজনীতির এক চরম সংকটে জাতীয় কংগ্রেসের হিন্দী লবির চক্রান্তে সুভাষচন্দ্র যখন সভাপতির পদ ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন---সেদিন অসুস্থ কবি সুভাষচন্দ্রের পাশে দাঁড়ালেন৷ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি সুভাষচন্দ্রকে লিখলেন---‘সুভাষচন্দ্র, বাঙালী কবি আমি বাংলাদেশের হয়ে তোমাকে দেশনায়কের পদে বরণ করি৷’ সেই পত্রে তিনি বাংলার বর্তমান দুরবস্থার ভবিষ্যৎবাণীও করে গিয়েছিলেন৷ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা কবির সেদিনের ভবিষ্যৎবাণী আজ নিষ্ঠুর বাস্তবে পরিণত হয়েছে৷ কিন্তু বাঙালীর দুর্ভাগ্য পরবর্তীকালে সুভাষচন্দ্র নেতাজী হয়েছেন, কিন্তু বাংলাদেশের দেশনায়ক হতে পারেন নি৷ তাই হয়ত আজ রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা আঁধারে আচ্ছন্ন৷ তবু এই আঁধারেও আশার আলো রবীন্দ্রনাথ, সেকথাও তিনি লিখেছিলেন সুভাষচন্দ্রকে---‘হিংস্র দুঃসময়ের পীঠের ওপর চড়ে বাঙালীকে বিভীষিকার পথ উত্তীর্ণ হতে হবে৷ অদৃষ্ট কর্তৃক অপমানিত হয়ে বাঙালী মরবে না৷ প্রচণ্ড মার খেয়েও মারের ওপর মাথা তুলে দাঁড়াবে বাঙালী৷’ বাইশে শ্রাবণ হোক বাঙালীর আলোয় ফেরার দিন৷ বিদায় বেলায় যে আলোর কণিকা তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন, সেই আলোতেই পথ চিনে নিতে হবে বাঙালীকে৷ কবির কথায় শেষ করি---
‘স্বপ্ণ আমার জোনাকি
দীপ্ত প্রাণের মণিকা’
স্তব্ধ আঁধার নিশীথে
উড়িছে আলোর কণিকা৷৷’
- Log in to post comments