বাঙালী জাতির অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

লেখক
প্রফুল্ল কুমার মাহাত

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৭৫ বছর ধরে বাঙালী জাতি যেভাবে শোষিত, বঞ্চিত অবহেলিত, প্রতারিত ও অবদমিত হচ্ছে, সে বিষয়ে গভীর সমীক্ষা করে বাঙালী জাতিকে সচেতন হতে হবে ও এর বিরুদ্ধে সরব হয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে৷ অন্যথায় বাঙলার সভ্যতা-সংস্কৃতি-কৃষ্টি-ঐতিহ্য-গৌরব এমনকি অস্তিত্ব বিপন্ন ও বিলুপ্ত হতে পারে অচিরেই৷ তাই আর দেরি নয়, এই মুহূর্ত থেকে সকল বাঙালীকে এব্যাপারে সজাগ ও সচেতন হয়ে এ হেন শোষণ বঞ্চনা অবদমনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে৷ এই  চলার পথে সব বাঙালীর আবহসঙ্গীত হোক একটাই ‘‘তমসা কাটিছে, বিহগ ডাকিছে, পূর্ব তোরণে খুলিছে দ্বার৷ জাগো ভাই বোন তরুণ সুজন, ভাঙ্গো আজিকার এ কারাগার৷’’ বাঙলার তরুণ সমাজ আজ সত্যি জেগেছে ও সকল বাঙালীকে ডাক দিয়ে বলছে---‘‘এগিয়ে চলো বন্ধুরা সব সময় হয়েছে আজ, পাপশক্তির হবে পরাভব সরিবে দুর্নীতিরাজ৷’’ যাইহোক এখন আমাদের সমীক্ষা ও পর্যালোচনা করে দেখতে হবে, শোষণ বঞ্চনা প্রতারণার  জাল পাপশক্তি বাঙালী নিধনের জন্য কিভাবে ছড়িয়েছে! প্রথমে দেখা যাক স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বাঙলা ভাঙার মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে দুর্বল করার জন্য ব্রিটিশের মতো ডিভাইড এণ্ড রুল পলিশি গ্রহণ করেছে৷ তাই ভাষাভিত্তিক রাজ্য ঘটনের নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রেও প্রতারণা করা হয়েছে৷ অখণ্ড বাঙলাকে বিভক্ত করে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গ এই দুটি ভাগে ভাগ করে একই বাংলা ভাষা-ভাষী বাঙালীদের দ্বিধাবিভক্ত করা হয়৷ পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে বাঙালী অধ্যুষিত বিস্তৃত অঞ্চলকে তৎকালীন বিহার রাজ্যের সঙ্গে, উড়িষ্যা রাজ্য ও স্বাধীনতার পূর্বেই অসম প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করার হীন চক্রান্ত গ্রহণ করে৷ বর্তমানে উত্তরবঙ্গের দার্জিলিঙ ও তৎকালীন তৎসংলগ্ণ অঞ্চলকে নিয়ে পৃথক রাজ্য ঘটনের গোপন চক্রান্ত করে জি.টি.এ আইন চালু করে বহিরাগত গোর্র্খদের গোর্র্খল্যাণ্ড রাজ্যঘটনের গোপন  উস্কানি দেয় হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্রীয় শাসক ও শোষকেরা৷ এটা তারা করছেন শুধু সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থসিদ্ধিকে চরিতার্থ করার জন্যে৷ কিন্তু এ হেন দুরভিসন্ধিমূলক চক্রান্ত শুধু বাঙলার অখণ্ডতার ক্ষেত্রে নয়, সমগ্র স্বাধীন ভারতের সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে কত বেশি ক্ষতিকারক ও ভয়ঙ্কর তা বুঝে ওঠার মতো শুভবুদ্ধি সূচক মানসিকতা পর্যন্ত তাদের নেই৷ তারা বুঝতে পারছেন না বা বুঝেও বুঝতে চান না সম্পূর্ণ দলীয় স্বার্থের লোভে বা ক্ষমতা দখলের লোভে দার্জিলিং পৃথক রাজ্য গোর্র্খল্যাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত হলে তা হবে ভারতের চির শত্রু চীনের প্রবেশপথ ও ভারতকে আক্রমণের তোরণদ্বার৷ এদিকে বর্তমান ঝাড়খণ্ডের অন্তর্গত শিল্পাঞ্চল ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চল বোকারো, ধানবাদ, চান্ডিল জামশেদপুরের বাংলা ভাষাভাষী বাঙালীদের সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়ে পরিণত করে তাদের মাতৃভাষা সুমধুর বাংলা ভাষাকে তাদের মুখ থেকে মন থেকে অন্তর থেকে মুছে দেওয়ার জন্য সেখানে বাংলা ভাষার পঠন পাঠন ও শিক্ষাদান  বন্ধ ও নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এটা অত্যন্ত দুঃখ লজ্জা ও পরিতাপের বিষয়৷ ওদিকে আবার অসমে বাঙালীদের অনাগরিক তকমা দিয়ে বিতাড়িত করার চক্রান্ত হচ্ছে, অথবা ডি.ক্যাটাগরি (ডাউটফুল) নাগরিকত্ব দিয়ে লাঞ্ছনা ও অবমাননা করা হচ্ছে৷ যে বাঙালী জাতি জীবন দিয়ে ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা নিয়ে এল, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে সেই বাঙালীদের এই কী করুণ মর্মন্তুদ পরিণতি৷ এটা আজ অদৃষ্টের নিষ্ঠুর পরিহাস৷ কিন্তু একথা অস্বীকার করা চলে না যে এই চলমান গতিশীল জগতে সবকিছুই সংকোচন বিকাশের পথ ধরে, উহ-অবোহ ধারায় চলে চলেছে৷ তাই বলি বাঙলা ও বাঙালীর এ দুর্দিন অচিরেই শেষ হয়ে যাবে৷ ‘‘তমসা কাটিছে, বিহগ ডাকিছে, পূর্ব তোরণে খুলিছে দ্বার৷ বাঙালীস্তান এবার জাগিছে, তন্দ্রার ঘোরে থেকো না আর৷’’ কেটে গেছে মেঘ, গেছে দুর্র্যেগ, আলোকের এই যাত্রাপথে তাই এখন সব বাঙালীর জেগে ওঠার সময় হয়েছে৷ এরপরেও জেগে না উঠলে দুর্বৃত্তরা আমাদের আরও বেশি করে তন্দ্রাচ্ছন্ন করে, আর বেশি করে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে চিরনিদ্রায় নিদ্রিত করে নিশ্চিহ্ণ করে দেবে৷ তাই বলি হে বাঙালী প্রভাত কি রাতের অবসানে? যখনই চিত্ত জেগেছে শুনেছো বাণী তখনই হয়েছে প্রভাত৷ উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য, বরান্নিবোধত৷ এরপরে দেখা যাক, অর্থনৈতিক দিক থেকে বাঙলা ও বাঙালীকে কীভাবে শোষণ বঞ্চনা ও প্রতারণা করা হচ্ছে৷ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ভারতীয় সংবিধানের সুস্পষ্ট নীতি হলো কেন্দ্রীয় সরকার সমমনোভাবাপন্ন দৃষ্টি নিয়ে প্রতিটি অঙ্গরাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রতি সুবিবেচনা প্রসূত প্রয়োজন ভিত্তিক কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে, তা যেকোনো দলীয় সরকার বা জোট সরকারই ক্ষমতায় আসীন হোক না কেন! ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর তাকে দল বা জোটের ঊধের্ব উঠে ন্যায়-নীতির পথ ধরে শাসনকার্য পরিচালনা করতে হবে সুষ্ঠুভাবে৷ এটাই হলো গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনের মূল বৈশিষ্ট্য৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় বিশ্বের প্রায় সব গণতন্ত্রেই দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারগুলিও স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করছে৷ এরফলে জনগণ হচ্ছে শোষিত বঞ্চিত ও প্রতারিত৷ ভারতীয় গণতন্ত্র এই সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত নয়৷ তাই তো কেন্দ্র সরকারের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় পক্ষপাতমূলক আচরণ ও বিরোধী দলের দ্বারা ঘটিত রাজ্যগুলির প্রতি বিমাতৃসুলভ বঞ্চনা৷ কেন্দ্রের সংগৃহীত রাজস্বের প্রাপ্যও অর্থ থেকে বিরোধী দল শাসিত রাজ্যগুলি অনেক ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছে৷ তাছাড়া উন্নয়নমূলক প্রকল্প যথা শিল্পস্থাপন, কৃষি উন্নয়ন,সমাজকল্যাণ, কর্মসূচীতে বিরোধী দল শাসিত রাজ্যগুলি হচ্ছে বঞ্চিত অথবা সঙ্কুচিত৷ বাঙালীজাতি অধ্যুষিত বাঙলা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ৷ এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়-কৃষি, শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি কয়েকটি বিষয় সংবিধানে যৌথ তালিকার অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও সবরাজ্যের সহমতের ভিত্তিতে নীতি নির্র্ধরণের সময় কেন্দ্রীয় সরকার অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিছুটা স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে নীতি নির্ধারণ করে চলেছে৷ বহু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বহু জাতিক সংস্থা  কর্র্পেরেট সোসাইটির স্বার্থেই নীতি নির্ধারিত হচ্ছে৷ এরফলে বহু রাজ্যের স্বার্থে চরম আঘাত পড়ছে৷ শুধু এক দুটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্য করার চেষ্টা করছি৷ যেমন বাঙলার মাটি পোস্ত চাষের ক্ষেত্রে খুবই উপযোগী৷ তাছাড়া শুষ্ক আবহাওয়া জনিত পরিবেশে পোস্ত এখানকার মানুষের শরীরের পক্ষে উপকারী ও পেটের অসুখে এটা ঔষধের মতো কাজ করে৷ কিন্তু এখানে পোস্ত চাষের অনুমতি দেওয়া হয় না৷ কেউ চাষ করলে তা পুড়িয়ে নষ্ট করে দেওয়া হয়৷ তাই এখানে পোস্ত একটি মহার্ঘ্য দুর্মূল্য বস্তু৷ তাই এখন চারশত টাকা কেজি দরের পোস্ত ২০০০টাকা কেজি দরে কিনতে হচ্ছে বাঙালীদের৷ এ কথা অনস্বীকার্য যে পোস্ত একটি নিয়ন্ত্রিত চাষের বস্তু কারণ পোস্ত গাছের থেকে আফিম্‌ নামক মাদকদ্রব্য তৈরী করা যায় যা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক৷ কিন্তু এখানে প্রশ্ণ হচ্ছে---এই পোস্ত ভারতের কোনো না কোন রাজ্যে সরকারের পরিদর্শনাধীনে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে চাষ হচ্ছে৷ আর তা বাঙলা ও অন্যান্য রাজ্যে রপ্তানি করে ধন কুবের হয়ে যাচ্ছে কিছু মুনাফালোভী ব্যষ্টিবর্গ৷ বাঙলায় এধরণের নিয়ন্ত্রিত পোস্ত চাষের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না৷ অথচ বাঙলা ও বাঙালীর স্বার্থের ধারক ও বাহক ‘আমরা বাঙালী’ দলের পক্ষে বহুবার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে৷ এই হল ভারতীয় গণতন্ত্রের দ্বিচারিতার নগ্ণ প্রতিচ্ছবি৷ অপর একটি দৃষ্টান্ত হল, দরিদ্র জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত পুরুলিয়া জেলা শহরের মধ্যে অবস্থিত একটি দাতব্য হোমিওপ্যাথি কলেজ ও চিকিৎসালয় দীর্ঘদিন যাবৎ গরীব মানুষের সেবার কাজ করে এসেছে৷ কিন্তু বেশ কিছুদিন হল এই হোমিওপ্যাথি কলেজটি বন্ধ হয়ে রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারী সংস্থা আয়ূষের প্রয়োজনীয় অনুকম্পা ও অনুমোদনের অভাবে৷ এব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার ও সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বহুবার রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা৷ প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা প্রয়োজন- কয়েকজন জনদরদী ও সমাজসেবী চিকিৎসক এখনো এখানে সাধ্যমতো দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসায় আত্মনিয়োগ করে রয়েছেন৷ এই কলেজ থেকে ইতোপূর্বে বহু ছাত্র-ছাত্রা পাশ করে ডিগ্রি নিয়ে পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষদের সুস্থ নীরোগ করার কাজে নিয়োজিত৷ দুঃখের বিষয়-এখন এখান থেকে আর কোন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার তৈরী হচ্ছে না৷ অথচ সেই পুরনো পরিকাঠামো এখনও বিদ্যমান৷ উপযুক্ত সংস্কার, পরিচর্যার অভাবে তা এখন মুহ্যমান, জঙ্গলাকীর্ণ৷ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও ভারতের জনগণের প্রতি এ হেন বঞ্চনা, প্রতারণা মনে হয় পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ শাসন কালেও দেখা যায় নি৷ এই পুরুলিয়া তথা ভারতের কাঙ্খিত স্বাধীনতা আনবার জন্যে এখানকার স্বাধীনতা সংগ্রামী চুনারাম,গোবিন্দ, সিধু, কানু ও বিরসা মুণ্ডা শহীদ হয়েছেন৷ তাঁদের স্বাধীনতার স্বপ্ণ কি এরকম বঞ্চনাতেই শেষ হয়ে যাবে?