বাঙালী মারের ওপর মাথা তুলে দাঁড়াবেই

লেখক
মনোজ দেব

গত ১৬ই নভেম্বর কলকাতা রাণী রাসমণি রোডে আমরা বাঙালীর এক সমাবেশে দলের অসম রাজ্য সচিব সাধন পুরকায়স্থ বলেন---এন আর সি বাঙালী হত্যার রাজনৈতিক খেলা৷ খেলা তো বটেই! শুধু এন আর সি নয়, বাহাত্তর বছর ধরে পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে নানা অছিলায় বাঙালী হত্যার খেলা চলছে৷ কিন্তু এই খেলার শেষ কোথায়? বাঙালী কবে চিনবে এই বাঙালী বধের খলনায়কদেব!

অসমে বাঙালী বধের খেলা শুরু ১৯৪৮ সালে৷ অসমের তৎকালীন কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদৌলী দর্পের সঙ্গে বলেছিলেন---অসম ফর অসমিয়া৷ তাঁর এই উস্কানীতে অসমে বাঙালী বিতাড়ন আন্দোলন শুরু হয়৷ স্বাধীনতার জন্মলগ্ণেই অসমে বাঙালী বিদ্বেষের আগুন জ্বালে সেই রাজ্যের কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রী, যাতে পরোক্ষে মদত ছিল প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর৷ মোহনদাস গান্ধী তখনও জীবিত ছিলেন৷ তিনি রসিকতা করে বলেছিলেন অসম যদি অসমীয়ার, বিহার যদি বিহারীর, ভারত তবে কার? রসিকতা কথাটা বললাম এই কারণে গান্ধী কথাটা বলেছিলেন ঠিকই, কিন্তু অসমীয়াদের বাঙালী বিদ্বেষী আচরণ বন্ধের তিনি কোনও উদ্যোগ নেননি৷ সেদিন পশ্চিম বাঙলার মুখ্যমন্ত্রী ও কংগ্রেসী নেতারাও অজ্ঞাত কারণে নীরব ছিলেন৷ নতুবা সেদিন পশ্চিমবাঙলার মুখ্যমন্ত্রীও যদি গলা ফুলিয়ে বলতে পারতেন---পশ্চিমবঙ্গ ফর বাঙালী, তাহলে আজ হয়তো বাঙালীকে এই হত্যার খেলার শিকার হতে হ’ত না৷ নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য প্রশাসনের কর্তাদের দ্বারে দ্বারে ধরণা দিতে হতো না৷ বাঙলার মুখ্যমন্ত্রীকে এন আর সি-র বিরুদ্ধে চিৎকার করে করে গলা ফাটাতে হ’ত না৷ বাঙালী বধের খেলা সেদিনই শেষ হয়ে যেত৷

খ্যাতনামা বৈজ্ঞানিক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় স্বাধীনতার অনেক আগেই বাঙালীকে সাবধান করে লিখেছিলেন---বিহার বিহারীর, ওড়িষ্যা ওড়িয়ার, পঞ্জাব পঞ্জাবীর, অসম অসমীয়ার......কিন্তু বাঙলা সকলের, বাঙলার দ্বার সকলের জন্যে খোলা৷

সুভাষচন্দ্র যখন গান্ধী, পটেল, গোপালাচারীদের ঘৃণ্য রাজনীতির শিকার হয়ে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির পদ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন---সেদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক ঐতিহাসিক পত্রে সুভাষচন্দ্রকে লিখেছিলেন---‘বাঙালী কবি আমি, বাঙলাদেশের হয়ে তোমাকে দেশনায়কের পদে বরণ করি৷.......আত্মীয়-পরের হাতে বাঙালীকে অশেষ লাঞ্ছনা ভোগ করতে হবে৷’ দুই বিশ্বখ্যাত বাঙালী মনীষীর সতর্কবার্তায় সেদিন কর্ণপাত করেননি বাঙলার মেরুদণ্ডহীন নেতারা৷

সুভাষচন্দ্রের দেশত্যাগের পর শিরদাঁড়া সোজা করে রাজনীতি করার মত কোন নেতা আর বাঙলায় জন্মায় নি৷ তাই বিশ্বকবি যে লাঞ্ছনার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তা আজ মৃত্যু যন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে৷  বাঙলা আজ সকলের, শুধু বাঙালীর নয়৷ বাঙালী আজ স্বভূমিতেই পরবাসী৷ তবু বাঙালীর চেতনা ফিরছে কই! ৭২ বছর ধরে দিল্লীর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উত্তরসূরী বাদামী শোষকরা বাঙলার ভাষা-সংস্কৃতির ওপর আঘাত হেনেছে, অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে, ভৌগোলিক সীমানা নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে৷ আর আজ তো বিহার, ঝাড়খণ্ড, অসম, ত্রিপুরা ও বিজেপি শাসিত কর্ণাটকে  সর্বত্র বাঙালীর ওপর চলছে চরম নির্যাতন৷ এরপর বাঙালীকে বিদেশী আখ্যা দিয়ে দেশ থেকে তাড়াবার আয়োজনও পাকা করে রেখেছে৷

স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গের কোন নেতামন্ত্রী আজ পর্যন্ত অসম, বিহারে বাঙালী নির্যাতন নিয়ে কখনও সরব হয়নি৷ বাঙালীই আজ নিজেকে বাঙালী বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পায়৷ আসলে ক্ষমতার গদীতে আসীন হতে দিল্লীর দাসত্ব করতে করতে আত্মমর্যাদা বোধটুকুও খুইয়ে বসেছে বাঙলার নেতামন্ত্রীরা৷ তাই আজ কলকাতার বুকে বসেও উচ্চ আদালতের নিষেধ অমান্য করে রবীন্দ্র সরোবরের গেটের তালা ভেঙ্গে ঢুকতে সাহস পায় এক শ্রেণীর উগ্র হিন্দীভাষীরা৷ পাশ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে বাঙালী নিধন হলেও পশ্চিমবঙ্গের নেতা মন্ত্রীদের কোনও হেলদোল থাকে না৷ অথচ কয়েকবছর আগে অসমে কয়েকজন বিহারীর গায়ে হাত পড়তেই দেশ জুড়ে হৈ-চৈ শুরু হয়ে গিয়েছিল৷

এত কিছু দেখেও বাঙলার নেতা-মন্ত্রীদের চেতনা ফেরেনি৷ তারা আজও সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে আত্মকলহে মগ্ণ৷ কিন্তু বাঙালী আর কতদিন মুখ বুজে এই অত্যাচার সহ্য করবে! তার সহ্যের সীমা অতিক্রম করলে যে পরিণতির সৃষ্টি হবে তাকে রোখার ক্ষমতা কোনও নেতা-মন্ত্রী তো দূরের কথা কোনও রাষ্ট্রশক্তির পক্ষে সম্ভব হবে না৷ বিশ্বকবি সুভাষচন্দ্রকে লেখা  তাঁর সেই ঐতিহাসিক পত্রেই  লিখেছেন---‘অদৃষ্ট কর্তৃক অপমানিত হয়ে বাঙালী মরবে ন....প্রচণ্ড মার খেয়েও বাঙালী মারের ওপর মাথা তুলে দাঁড়াবে৷’ হ্যাঁ, বাঙালী মারের ওপর মাথা তুলে দাঁড়াবেই৷ সেদিন আর বেশী দূরে নয়৷