বাঙালীর জাতিসত্ত্বা ভাষা, লিপি ও কৃষ্টি কি হারিয়ে যেতে বসেছে

লেখক
জে.ডি. মণ্ডল

(পূর্ব প্রকাশিতের পর )

বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের বিশালত্ব ঃ-

গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-দামোদর-ময়ূরাক্ষী ইত্যাদি নদী ব-দ্বীপ অঞ্চলে গড়ে ওঠা বাঙালী অধ্যুষিত অঞ্চলের মোট আয়তন ছিল---১৮৭২ সালে-২,৪৮,২৩১ বর্গ মাইল অর্থাৎ ৪,৩৫,৪৭১ বর্গ কিমি৷ (সূত্র ঃ বৃটেনিকা এনসাইক্লোপিডিয়া নবম সংস্ককরণ, তৃতীয় খণ্ড, পৃঃ-৫৬৪)৷

বর্ত্তমানে ওই অঞ্চলের লোকসংখ্যা হবে আনুমানিক ৪০ কোটি৷ অঞ্চলটা হলো---

১) সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ ২) সাবেক বিহার বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের (ক) সিংভূম জেলা (খ) রাঁচি জেলার-সিল্লি,জোনহা, সোনাহেতু ও তামার থানা (গ) হাজারিবাগ জেলার-গোলা, পেটারবার, জেরিডি ও দামোদরের দক্ষিনাংশ (ঘ) সমগ্র ধানবাদ জেলা (ঙ) সাঁওতাল পরগনা জেলার -জামতাড়া, দুমকা, গোড্ডা, দেউঘর, পাকুড়, রাজমহল (সাহেবগঞ্জ টাউন বাদে) (চ) পূর্ণিয়া জেলার---কিষাণগঞ্জ ও পলাশী থানা৷ (এখানে ৮০শতাংশ বাঙালীর বাস)

৩৷ উড়িষ্যা রাজ্যের - (ক) উত্তর বালেশ্বর (খ) উত্তরপূর্ব ময়ূরভঞ্জ (গ) উত্তর কেউনঝাড় ও (ঘ) পূর্ব সুন্দরগড়৷

৪৷ অসম রাজ্যের --- (ক) সাবেক গোয়ালপাড়া জেলা সমগ্র (খ) সাবেক কাছার জেলা সমগ্র (গ) কামরূপ জেলার বড়পেটা মহকুমা (ঘ) নওগাঁ জেলার --- লামডিং, হোজাই, লংকা ইত্যাদি৷

৫৷ মেঘালয় রাজ্যের ---(ক) গারো পাহাড়ের সমতল অংশ৷

৬৷ বাঙলার অঞ্চলের ৯০শতাংশ পেটের মধ্যে থাকা সমগ্র ত্রিপুরা রাজ্য৷ আর---

৭৷ আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ৷

১ লক্ষ ৪৩ হাজার ৯৯৮ বর্গ কিমি আয়তন বিশিষ্ট ‘বাংলাদেশ’ যা ১৯৪৭ সালের আগে ভারতেই অন্তর্ভুক্ত ছিল৷ তাই বাংলাদেশ বাদে ভারতে অবস্থিত বাঙালী অধ্যুষিত অঞ্চলের আয়তন হবে-২,৩৭,১৭৪ বর্গকিমি

প্রশ্ণ হলো --- ৮৮,৭৫২ বর্গ কিমি বিশিষ্ট পশ্চিমবঙ্গ বাদে বাঙলার বাকী অঞ্চল বাঙলা থেকে গেল কিভাবে? কোথায় গেল? কবে গেল?

উনবিংশ শতকের শেষ ভাগে বাঙলার বুকে জন্ম নেন--- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১), স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩), বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮-১৮৯৪), শরৎচন্দ্র (১৮৭৬-১৯৩৮), মধূসূদন (১৮২৮-১৮৭৩) প্রমুখদের আবির্র্ভব ও জ্বালাময়ী রচনাশৈলীতে বাঙলার বুকে ‘নবজাগরণ’ (রেণেসাঁ) আসে৷ তাতে ব্রিটিশ সরকারের সিংহাসনে টনক নড়ে৷ তাঁরা বাঁচার উপায় হিসাবে কৌশল নিল--- ‘ভাগ করে ভোগ কর, তারই ফলশ্রুতিতে ১৯০৫ সালে ইংরেজ প্রশাসক হিন্দু-মুসলমান এই দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বাঙলাকে ভাগ করে৷ সারা বাঙলায় জ্বলে উঠে প্রতিবাদের আগুন---পালিত হয় জনতা কার্ফু, অরন্ধন---ইত্যাদি৷ হলো মিলনের গান, একতার উৎসব রাখী উৎসব৷ রবীন্দ্রনাথ গাইলেন---‘‘বাঙলার মাটি, বাঙলার জল,পুণ্য হোক, পুণ্য হোক হে ভগবান!....

দীর্ঘ ছয় বছরের তুমুল আন্দোলনের ফলে উঠে আসে চরম গোষ্ঠী--- ১৯০৮ সালে হলো ক্ষুদিরামের ফাঁসী৷

উপায়ন্তর না দেখে ইংরেজ ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করল৷ কৌশল নিল---‘‘হাতে মারতে পারি না তো ভাতে মারি৷’’

১৯২২ সালে ভারতের রাজধানী কলিকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তর করল৷ বাঙলার অঞ্চল বৃহৎ অজুহাতে ১৮৭৪ সালে--- বাঙলার ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া, কোকড়াঝাড়, বরপেটা, নওগাঁ, লামডিং, হোজাই, লংকা ইত্যাদি অঞ্চল প্রাগজ্যোতিশপুর তথা কামরূপ জেলার সাথে জুড়ে দিয়ে যে অসম প্রদেশ গঠন করেছিল, তা-ই আবার ১৯১২ সালে ঘটিত অঞ্চল বলে--- শ্রীহট্টের ১২টি থানা অঞ্চলকে কাছাড় জেলা তথা বর্তমানের---করিমগঞ্জ, হাইল্যাকান্দি, শিলচর জেলাকে অসমের সাথে জুড়ে দিয়েছে৷ ফলে, অসম রাজ্যের বর্তমান আয়তন---৭৮,৫২৩ বর্গকিমির মধ্যে ১৮৭৪ আর ১৯১২ সালে বাঙলার থেকে কেটে নেওয়া অংশের আয়তন---বর্গকিমি বা গোটা অসমের প্রায় অর্ধেক৷

শুধু তাই নয়, ওই ১৯১২ সালেই বাঙলার খনিজ অঞ্চল কেটে ছেঁটে বিহার, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা রাজ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে৷ (ওই অঞ্চলগুলোর নাম ৮ নং পৃষ্ঠায় দ্রষ্টব্য)৷

বাঙলা ও বাঙালীর ইতিহাস জানা, শোষণ, বঞ্চনার কথা বোঝা আজ বাঙালীদের বিশেষ প্রয়োজন৷ এখানে বিশেষ স্মর্তব্য---

এই ছত্রভঙ্গ বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে আত্মমর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র ১২৮৭ বঙ্গাব্দে (সম্ভবতঃ ১৮৮০ ইংরাজী সালে) জাতির উদ্দেশ্য শিক্ষিত সমাজের উপস্থিতিতে বজ্রনির্ঘোষে ঘোষণা করলেন---

‘‘বাঙালীর ইতিহাস চাই,

নইলে বাঙালীর ভরসা নাই৷

কে লিখিবে? তুমি লিখিবে, আমি লিখিব,

সকলেই লিখিবে৷ যে বাঙালী তাহাকেই

লিখিতে হইবে৷’’

এই বঙ্গজাগরণের কাজটি ১৮১৪ সালে শুরু করেছিলেন রামমোহন রায়৷ তারপর এগিয়ে এলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বঙ্কিমচন্দ্র ও অন্যান্যরা৷ ১৮৯৫ সালে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় লিখলেন ‘সিরাজদৌল্লা’৷ ১৩০৮ বঙ্গাব্দে (১৮০১ সালে) নিখিল রায় লিখলেন ‘মুর্শিদাবাদের ইতিহাস৷’ ১৮৭১ সালে মহেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় লেখেন---‘‘বঙ্গভাষার ইতিহাস৷’’ এভাবে ১৮৯৬ সালে দীনেশচন্দ্র সেন লেখেন---‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’৷ ১৮৭৬ সালে রাজগতি ন্যায়রত্ন লেখেন ‘বাঙলা ভাষা’ ও বাঙলা সাহিত্য’৷ ১৮৭৮ সালে রাজনারায়ন বসু লেখেন---‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ ইত্যাদি ইত্যাদি৷

বাঙলার ইতিহাস বাঙালীদের পক্ষে জানার আরও বিশেষ কারণ হলো--- পরাধীন ভারতে বাঙালী নেতৃত্ব কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের নিকট বাংলার হৃত অঞ্চল পুনরুদ্ধারের আবেদন জানায়৷ কিন্তু কথাটা (দাবীটা) নিমরাজীভাবে তল পড়ে যায় বা চাপ পড়ে যায়৷ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৫৬ সালে ভাষা ভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন আইন’’ অনুযায়ী ভারতের অন্যান্য রাজ্য পুনর্গঠন হলেও বাঙলার ১৮৭৪ ও ১৯১২ সালে হৃত অংশ ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি৷ আর আজও সে বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেই৷

বাঙলার অঞ্চল যদি ১৮৭৪ আগের মত একত্রিত থাকত তবে বাঙালীদের রাজ্যে রাজ্যে উদ্বাস্তু বহিরাগত, বিদেশী তখমাও পেতে হতো না আর সর্বত্র পড়ে পড়ে লাথি-ঝাঁটা-লাঞ্ছনা পেতে হতো না৷

গোটা বাঙলার অঞ্চল এককালে ছিল--- স্বয়ং সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল৷ সে সময় ছিল ---‘গোলা ভরা ধান’, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু’’৷ আরও কত কি! কারণ, গোটা বাঙলায় তখন, কৃষিজ, জলজ, খনিজ, বনজ সহ সর্বপ্রকার শিল্পজ সম্পদের অভাব ছিল না৷ তাই বাঙলায় তখন কর্মসংস্থান, ক্রয়ক্ষমতা বা বেকার সমস্যা ছিল না৷ ইংরেজের ‘হাতে মারতে পারি না তো ভাতে মাবি’--- কৌশলে বাঙালীর গেল গেল সব গেল৷ পায়ের তলার মাটিও গেল৷

শুধু তাই নয়, বাঙলার অঞ্চল কেটে ছেঁটে নিয়ে যা অসম,বিহার, ঝাড়খণ্ড বা ঊড়িষ্যায় জুড়ে দিল তাতে বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিতে বাংলায় পঠন-পাঠন তুলে দিল৷ স্বাধীনতার পরেও তা-ই চলছে৷ ত্রিপুরাতে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বা তার উপরের শিক্ষায় বাংলা ভাষাকে ঐচ্ছিক করে দিল৷ এখন ধ্রুপদী ভাষার ধূলা তুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে মাতৃভাষা বাংলায় পড়ার সুযোগ থেকে বাঙালীদের বঞ্চিত করার ব্যবস্থা হয়েছে এসব কি মেনে নেওয়া যায়? (সমাপ্ত)