বাঙালীর স্বরাজ

লেখক
মনোজ দেব

‘‘যে মানুষ বলে ‘আগে ফাউণ্টেনপেন পাব তার পরে মহাকাব্য লিখব’, বুঝতে হবে তার লোভ ফাউণ্টেনপেনের প্রতিই, মহাকাব্যের প্রতি নয়৷ যে দেশাত্মবোধী বলে ‘আগে স্বরাজ পেলে তার পরে স্বদেশের কাজ করব’, তার লোভ পতাকা ওড়ানো উর্দি-পরা স্বরাজের রঙকরা কাঠামোটার পরেই৷ একজন আর্টিস্ট্‌কে জানি, তিনি অনেক দিন থেকে বলে এসেছিলেন, ‘রীতিমত স্টুডিয়ো আমার অধিকারে না পেলে আমি হাতের কাজ দেখাতে পারব না৷’ তাঁর স্টুডিয়ো জুটল, কিন্তু হাতের কাজ আজও এগোয় না৷ যতদিন স্টুডিয়ো ছিল না ততদিন ভাগ্যকে ও অন্য সকলকে কৃপণ বলে দোষ দেবার সুযোগ তাঁর ছিল স্টুডিয়ো পাবার পর থেকে তাঁর হাতও চলে না, মুখও চলে না৷ স্বরাজ আগে আসবে, স্বদেশের সাধনা তার পরে, এমন কথাও তেমনিই সত্যহীন ও ভিত্তিহীন এমন স্বরাজ৷’’

উপরের কথা গুলি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর রাষ্ট্রনৈতিক মত প্রবন্ধে লিখেছেন৷ কি অসাধারণ দূরদৃষ্টি থেকে তিনি কথাগুলি বলেছেন আজ দেশের প্রতিটি বাঙালী তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছে৷ সত্যিই বাঙালীর কাছে স্বাধীনতা আজ সত্যহীন ভিত্তিহীন এক বস্তু যা গত ৭৭ বছর ধরে স্বদেশী সরকারের ষড়যন্ত্রের জালে বন্দি করে রেখেছে৷ তার নিজভূমেই তাঁকে প্রতিমুহূর্তে বিদেশী অনুপ্রবেশকারীর হুংকার শুণতে হচ্ছে৷ তার ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এমনভাবে লুন্ঠিত হচ্ছে যা ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসনে হয়নি৷

স্বরাজ মানে শুধু বোট দিয়ে শাসক নির্বাচন নয়৷ স্বরাজ মানে অর্থনীতির অধিকার---গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সেটাই দাবী৷ গণতন্ত্রের অর্থ জনগণের শাসন, রাষ্ট্রের সম্পদের মালিক দু-চারজন ধনকুবের নয়, দেশের আপামোর জনগণ৷ সমাজ অর্থনীতি, রাজনীতি বিষয় অজ্ঞ অসচেতন জনগণের সে বোধ নেই৷ তাই স্বাধীনতার নামে দেশের জনগণ দেশেরই নেতাদের হাতে প্রতারিত৷

সুভাষচন্দ্র চেয়েছিলেন অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যার অর্থ দেশের প্রতিটি মানুষের হাতে স্বচ্ছ সুশৃংঙ্খল জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণের ক্রয়ক্ষমতা থাকবে৷ তাইতো দেশীয় পুঁজিপতিদের কোপে পড়েছিলেন সুভাষচন্দ্র৷ তারও আগে নাটরের প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মেলনে বাংলা ভাষার প্রবর্তন করতে গিয়ে বিদ্রুপের শিকার হয়েছিলেন স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ স্বাধীন ভারতে বাঙালীর কি দুর্দশা হতে পারে বিশ্বকবির দূরদৃষ্টিতে সেদিনই ধরা পড়েছিল৷ তাই পরবর্ত্তীকালে সুভাষচন্দ্র ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কংগ্রেস সভাপতির পদ ত্যাগ করতে বাধ্য হলে বিশ্বকবি এক ঐতিহাসিক পত্রে সুভাষচন্দ্রকে বাংলাদেশের দেশনায়কের পদে আহ্বান করেছিলেন৷ বাঙালীর দুর্ভাগ্য ভারতবর্ষের স্বাধীনতার স্বপ্ণে বিভোর সুভাষচন্দ্র সেই আহ্বানে সাড়া দিতে পারেননি৷ কারণ তাঁর জীবনে তখন একটাই আদর্শ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা,বিদেশী ব্রিটিশ শাসককে ভারত ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারত ছেড়ে চলে গেছে তবে বাধ্য হয়ে নয় সুভাষচন্দ্রের ভয়েই৷ তবে ততদিনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দোসর দেশীও পুঁজিপতিরা ও জাতীয় কংগ্রেসের সুভাষ বিরোধী দেশীও পুঁজিপতিদের প্রতিনিধিদের যৌথ ষড়যন্ত্রে পুঁজিপতিদের শোষণের কাঁটা সুভাষচন্দ্র হারিয়ে যান৷ সত্যহীন ভিত্তিহীন স্বরাজের মূল্য বাঙালীকে আজও দিতে হচ্ছে৷ তার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি সব লুন্ঠন হচ্ছে৷ বাঙলা আজ স্বাধীন ভারতের নয়া উপনিবেশ৷