বিদ্রোহী বাঙলা : অত্যাচারী কাজীর বিরুদ্ধে শ্রীচৈতন্যদেবের গণবিদ্রোহ

লেখক
সুকুমার সরকার

শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব মূলত ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে৷ কিন্তু সমাজ সচেতনতা ও গণজাগরণেও তাঁর ভূমিকা কিছু মাত্র কম ছিল না৷ বরং তৎকালীন সমাজ-সামাজিকতার প্রশ্ণে গণজাগরণ ও গণ-বিদ্রোহের ক্ষেত্রে তাঁকে বলিষ্ঠ নেতৃত্বকারীও বলা যায়৷ আর তাঁর বলিষ্ঠতার পেছনে মূল প্রেরণা ছিল ওই বিদ্রোহী বাঙালি সত্তা৷ বাঙালি জাতি যে চির বিদ্রোহী, তা যেকোনো প্রেক্ষাপটেই হতে পারে৷ হোক তা ধর্মীয় ভাবে, কিংবা সামাজিক ভাবে, কিংবা রাষ্ট্রনৈতিকভাবে৷ যখন যেখানে যেভাবে প্রয়োজন পড়েছে বাঙালি তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে নিজেদের অধিকার, স্বাধীকার ও প্রাণধর্ম বজায় রাখতে৷ সেই ধারাতেই শ্রীচৈতন্যদেবের বিদ্রোহ৷ আর এই বিদ্রোহের রূপ ছিল কীর্তন সহযোগে৷

কীর্ত্তন ভারতীয় সমাজের ধর্ম প্রাণ৷ বিশেষ করে ভারতবর্ষের আপামর জনসাধারণ, যাঁদেরকে গণ-মানুষ বলা হয়,কীর্তন তাঁদের কাছে গণসঙ্গীত৷ যে যুগে সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক গণচেতনার উন্মেষ ঘটেনি সেই যুগে কীর্তন সহযোগে কোনো প্রতিবাদকে গণবিদ্রোহ বলা যেতেই পারে৷ শ্রীচৈতন্যদেবের বিদ্রোহ সেই ধরণের গণবিদ্রোহ৷ আর তাঁর বিদ্রোহের মাধ্যম ছিল কীর্ত্তন৷ তৎকালীন অত্যাচারী কাজীর বিরুদ্ধে তিনি কীর্ত্তন সহযোগে প্রতিবাদ বিদ্রোহ করেছিলেন৷ তাঁর এই বিদ্রোহের সঙ্গীরা ছিলেন সে যুগের অন্ত্যজ অস্পৃশ্য সাধারণ মানুষ৷ সমাজ যাঁদেরকে অচ্ছুত করে রেখেছিল৷ শ্রীচৈতন্যদেবের সমাজ ও ধর্মীয় আন্দোলন ছিল সেই অন্ত্যজ অস্পৃশ্য সাধারণ মানুষের জন্য৷ কিন্তু সেখানেই তিনি থেমে থাকেননি সেই আন্দোলনকে তিনি রাজদরবার পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ তৎকালীন গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহের অত্যাচারী কাজীর অন্যায় ফরমানের বিরুদ্ধে রীতিমতো বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব৷ খোল-করতাল এবং কীর্তন সহযোগে তাঁর সেই বিদ্রোহের মুখে অত্যাচারী কাজী নত স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন৷

আজ গণবিদ্রোহের রূপ বদলেছে৷ রূপ বদলেছে গণবিদ্রোহের গণসঙ্গীতেরও৷ কিন্তু চৈতন্যদেব প্রবর্তিত সেই গণসঙ্গীত কীর্ত্তন পাঁচশো বছর পর আজও সাধারণ মানুষের কাছে হয়ে আছে গণবিদ্রোহের গণসঙ্গীত৷ অত্যাচারী মুসলিম কাজির বিরুদ্ধে কিংবা ব্রাহ্মণ্যবাদী পণ্ডিতদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সেদিন যে গণবিদ্রোহ শুরু করেছিলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আজও তার মূল্য কিছু কমেনি৷ সেদিন যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে চৈতন্য মহাপ্রভু সশিষ্য প্রতিবাদে এগিয়ে যেতেন কীর্ত্তন সহযোগে৷ পাঁচশো বছর পরেও বাঙলার সাধারণ মানুষের কাছে সেই কীর্ত্তনই এখনো হয়ে আছে প্রধান গণসঙ্গীত৷

রাজনৈতিক পালাবদলে নানান সময়ে নানান ধরণের গণসঙ্গীত এসেছে৷ কিন্তু চৈতন্য মহাপ্রভু কর্তৃক প্রদত্ত এই কীর্ত্তনের গণসঙ্গীতকে অন্য কোনো গণসঙ্গীত আজও ছাপিয়ে যেতে পারেনি৷ আজও বাঙলার আকাশ বাতাস মুখরিত করে অষ্টপ্রহর, চবিবশপ্রহর, বাহাত্তর ঘন্টা, তিনদিন, সাতদিন ধরে চলে এই কীর্ত্তনের আসর৷ বাঙলার মানুষ তন্ময় হয়ে শোনেন এই সঙ্গীত৷ এই সঙ্গীত একদিকে যেমন ভক্তির উদয় করে, অন্যদিকে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের গণ চেতনার কথা৷