বর্ণমাহাত্ম্য

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

এই মহাবিশ্ব অজস্র স্পন্দনের সমাহার৷ এই যে পরিদৃশ্যমান জগৎ যাকে সাধারণ ভাবে ‘প্রপঞ্চ’ আখ্যায় অভিহিত করে থাকি তা মূলতঃ মানস জগৎ ও অতিমানস জগতের অধিক্ষেত্রভুক্ত৷ এই স্পন্দনরাজি সংখ্যায় অসংখ্য....অগুন্তি কিন্তু অনন্ত নয়৷ যদি তারা অনন্ত হত তাহলে সৃষ্টিটাও অনন্ত হত৷ তবে হ্যাঁ, তরঙ্গ–রাজির সংখ্যা অজস্র....অগণিত৷ কিন্তু তা কোন মতেই অনন্ত নয়৷

মূলতঃ তিনটি রঙ বা বর্ণই প্রধান–শ্বেতবর্ণ, রক্তবর্ণ ও কৃষ্ণবর্ণ৷ শ্বেত হ’ল সত্ত্বগুণের দ্যোতক, রক্তবর্ণ রজোগুণের দ্যোতক ও কৃষ্ণবর্ণ তমোগুণের দ্যোতক৷ এক ও অদ্বিতীয় পরমপুরুষই এই রকম অসংখ্য বর্ণ সর্জন করে চলেছেন৷ আর এই রঙ বা বর্ণের সাহায্যেই তিনি সব কিছুকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে চলেছেন৷ যদি আকর্ষণ না থাকত তাহলে এই সৃষ্ট জীবজগৎ তার আস্তিত্বিক মাধুর্য উপভোগ করতে পারত না৷

য একোবর্ণো বহুধাশক্তিযোগাদ্ বর্ণাননেকান্ নিহিতার্থো দধাতি৷

বি চৈতি চান্তে বিশ্বমাদৌ স দেবঃ স নো বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুনত্তুণ৷৷*

যে ‘এক’ সত্তা থেকে অনেকের উদ্ভূতি, সেই এককে বলব আদি কারণ বা মূল কারণ (noumenal cause) আর এই ব্যক্ত জগৎ হ’ল প্রাপঞ্চিক (phenomenal)

এখন প্রশ্ণ হ’ল, এই বর্ণময় বিশ্ব সৃষ্টির পেছনে কারণটা কী? উত্তরে বলব, এই বর্ণময় বিসৃষ্টি না থাকলে পার্থিব মানুষ কোন কিছুই উপভোগ করতে পারত না আর তা হলে এই সৃষ্টির বুকে সে বাঁচতেও চাইত না৷ যেমন ধর, একটা ছোট্ট শিশু কাঁদছে৷ মা শিশুকে খেলনা দিচ্ছেন যাতে শিশুটি সেই খেলনা নিয়ে মেতে থাকে৷ এই খেলনা তৈরীর জন্যেই যাবতীয় বর্ণ সৃষ্টি করা হয়েছে৷ কিন্তু উদ্দেশ্যটা কী? এই বর্ণ সৃষ্টির পেছনে আসল মতলবটা কী? এখন এর পেছনে যে উদ্দেশ্য, যে কারণ তা একমাত্র পরমপুরুষই জানেন৷ যদি সেই উদ্দেশ্যটা প্রকাশ করে দেওয়া হয়, তাহলে তো ভেতরকার গুপ্ত রহস্যই ফাঁস হয়ে যায়৷ তবে এর পেছনে অন্তর্নিহিত ভাবটা কী? এখন আসল মতলবটা যদি একবার জানাজানি হয়ে যায় তাহলে জীব তো বর্ণের আকর্ষণ থেকে মুক্ত হবার চেষ্টা করবে, তখন সৃষ্টির পেছনের বর্ণরাজি নিয়ে সে অযথা মেতে থাকার চেষ্টা করবে না৷

এই যে অজস্র স্পান্দনিক অভিব্যক্তির কথা বলছিলুম তারা সবাই সেই পরমপুরুষেই সমাহিত হয়ে থাকে৷ সেই এক পরমপুরুষ থেকে উৎসারিত হয়ে আবার তাঁতেই সমাহিত হচ্ছে৷ আমরা যদি এই তরঙ্গসমুদ্রের আদি ও অন্ত খোঁজার চেষ্টা করি তাহলে সেই এক পরমপুরুষকেই পাব অর্থাৎ সেই এক পরমপুরুষই সৃষ্টির আদিতে রয়েছেন, আবার অন্তেও রয়েছেন৷

তাই আমাদের সবাইকার একমাত্র প্রার্থনা হওয়া উচিত, ‘স নো বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুনত্তুণ

*–তিনি আমাদের ৰুদ্ধিকে শুভের সঙ্গে সংযুক্ত করে রাখুন৷

(পটনা, ৫ই অগাষ্ট, ১৯৭৮)

উত্তিষ্ঠত জাগ্রত

উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিৰোধত৷

ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি৷৷*

বলা হয়ে থাকে, পরমা সম্প্রাপ্তির পথ হ’ল ক্ষুরধারবৎ৷ ধর্মের পথে চলা মানেই হ’ল শাণিত ক্ষুরের ওপর দিয়ে চলা৷ প্রাকৃত জনগণ বলতে পারে–যেহেতু তারা অতি সাধারণ অজ্ঞ মানুষ....ৰুদ্ধি–শুদ্ধি নেই, তাই তারা এই শাণিত ক্ষুরের ধারের ওপর দিয়ে চলবে কী করে? কিন্তু তাদেরও তো জানতে ইচ্ছে যাবে–সেই পরমা সম্প্রাপ্তির উপায় কী? উত্তরে বলব–উপায়টা হ’ল ভক্তি৷

তাই বলি ভক্তির সঙ্গে, নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাও....ভক্তির পথেই এগিয়ে চলো৷ মনে রেখো, যেখানে ভক্তি সেখানেই পরমাত্মা৷ যারা জ্ঞানী, যারা তার্কিক, তাদের পক্ষে ধর্মের পথ হ’ল ক্ষুরধার তুল্য কিন্তু যারা সাধক, যারা ভক্ত তাদের পক্ষে সে পথ কুসুমাস্তীর্ণ৷ তাই ভক্তির দ্বারাই যখন পরমপুরুষ লভ্য তখন ভক্তিমান সাধক পরমপুরুষকে পাবেই৷ তোমরা সাধক, তোমরা ভক্তির পথে চলছ, জয় তোমাদের হবেই৷

(পটনা, ৬ই অগাষ্ট, ১৯৭৮)