"বর্ণপ্রধানতা চক্রধারায়াম।"

লেখক
খগেনচন্দ্র দাস

শিরোনামে উদ্ধৃত সূত্রটি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্তিজী সৃষ্ট "আনন্দসূত্রম্" দর্শন গ্রন্থের অন্তর্গত পঞ্চম তথা শেষ অধ্যায়ের প্রথম সূত্র।সূত্রাকারে গ্রন্থিত আনন্দসূত্রম্ গ্রন্থের প্রথম চারটি অধ্যায়ে সৃষ্টির উৎস থেকে শুরু করে মানুষের মানসাধ্যাত্মিক স্তরের সর্বোচ্চ বিকাশ সম্পর্কিত বিষয়গুলো চর্চা করা হয়েছে।এককথায় এই অংশটি আধ্যাত্মিক। দ্বিতীয় পর্যায়ে এই পঞ্চম অধ্যায়টিতে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্তিজীর আৰ্থসামাজিক দর্শন "প্রাউট" অর্থাৎ প্রগতিশীলউপযোগতত্ত্ব (Progressive Utilization Theory) সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। আর পঞ্চম অধ্যায়ের এই প্রথম সূত্রটিকে যুগান্তকারী প্রাউট দর্শনের অবতরণিকা বা মুখবন্ধ হিসেবেও ধরা যেতে পারে। সূত্রটির সঙ্গে প্রবক্তা কর্তৃক প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত ভাবাৰ্থটুকুর আধারেই আমাদের এই আলোচনা।

  শ্রীশ্রীআনন্দমূর্তিজী একজন নিপুণ শিল্পীর মত তাঁর আৰ্থসামাজিক দর্শন প্রাউটের আলোচনার সূচনা করেছেন একেবারে গোড়া থেকে। অর্থাৎ মানবসভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে।এই ঊষাকালটি সময়ের পরিমাপে আজ থেকে ঠিক কত বছর আগেকার তা নিয়ে নৃতাত্বিকদের মধ্যে মতানৈক্য থাকাটাই স্বাভাবিক।এখানে প্রাউট প্রবক্তা যে সময়কাল থেকে তাঁর বক্তব্য শুরু করেছেন সেটি তাঁর ভাষায়----"সুসংবদ্ধ সমাজব্যবস্থা যখন হয়নি সেই অবস্থার নাম দিতে পারি শূদ্র-যুগ, সবাই ছিল শ্রমজীবী।"(আনন্দসূত্রম্ পৃষ্ঠা ৩৮) অন্যত্র তিনি পৃথিবীতে মানুষের আগমনকে দশ লক্ষ বছর আগেকার বলে উল্লেখ করেছেন। আমাদের এই আলোচনায় পৃথিবীতে মানুষের আগমনের সময়কাল খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয় বলেই আমরা সচেতনভাবেই এখানে সে বিতর্ক এড়িয়ে যেতে চাই। প্ৰণিধানযোগ্য বিষয় এই যে, প্রবক্তার বর্ণনানুযায়ী; সেদিনের গুহাবাসী বা তারও আগেকার মানুষের 'শ্রম' আজকের মানুষের মত প্ৰণালীবদ্ধ 'শ্রম' ছিল না। সেদিনের মানুষের শ্রম ছিল শুধু বেঁচে থাকার অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে খাদ্যের অন্বেষণ করা। মানবসভ্যতার সেই সময়কালকেই তিনি শূদ্রযুগ বলে অভিহিত করেছেন। এই শূদ্রযুগের অত্যন্ত বাস্তবোচিত একটি চিত্র তিনি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন ১৯৫৫ সনের ৯ জানুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিত প্রথম ধর্মমহাচক্র উপলক্ষে প্রদত্ত "সমাজের ক্ৰমবিকাশ" শীর্ষক প্রবচনে। যা ১৯৫৬ সনের শ্রাবণীপূর্ণিমায় "সুভাষিত সংগ্রহ" প্রথম খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে তিনি বলেছেন----" আজ থেকে লক্ষ লক্ষ বৎসর পূর্বে যখন ব্রহ্ম-চক্রের ধারা-প্রবাহে প্রথম যে মানব শিশুটির জন্ম হয়েছিল সে তখন এই পৃথিবীকে মানুষের এমন নিরাপদ আশ্রয়রূপে পায় নি।চতুর্দিকে হিংস্র শ্বাপদ ও সরীসৃপসঙ্কুল বনভূমি, বিরাটাকার মাংসভোজী জীবসমূহ তাদের কড়াল দ্রংষ্টা বিস্তার করে আহার অন্বেষণে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আকাশের ঝড়-ঝঙ্ঝা,উল্কাপাতের হাত থেকে বাঁচবার জন্য ছিল না তার কোন মাধূর্যময় গৃহপরিবেশ, মধ্যাহ্ন-সূর্যের দাবদাহ সেই শিশুর জীবনী-সত্তাকে অঙ্কুরেই শুকিয়ে মেরে ফেলবার চেষ্টা করেছে,---এই ছিল তার অবস্থা।" (সুভাষিত সংগ্ৰহ, প্রথম খণ্ড পৃষ্ঠা ১/২) সেই যুগে মানুষ মাত্রেই ছিল, শ্রমজীবী,শূদ্র। মানবসভ্যতার প্রাথমিক স্তরের এই যে চিত্র তিনি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন তা তাঁর কল্পনামিশ্ৰিত হলেও এতটাই বাস্তব ও যুক্তিসঙ্গত যে তা পড়তে পড়তে যে কোন পাঠকেরই মনে হবে যে,প্রবক্তা যেন ঘটনাপ্রবাহের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ধারা বিবরণী শোনাচ্ছেন।

  আজকের এই উত্তরাধুনিক ইন্টারনেটের যুগে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কামরার সোফায় বসে কম্পিউটারের স্ক্রীণে বিশ্বটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে সেদিনের সে দৃশ্য কল্পনা করার দুঃসাহস  হয়তো আমাদের হবে না।এটা সর্বজন স্বীকৃত যে, মানবসভ্যতার ইতিহাস মূলত ক্রমাগত বিবর্তনের ধারা প্রবাহ। তবে এই বিবর্তন ডারউইনীয় বিবর্তনবাদের মত শুধু দেহ সংরচনাগত বিবর্তন নয়। এখানেই প্রাউট প্রবক্তার সঙ্গে অন্যান্য সমাজতাত্ত্বিকদের চিন্তার মৌলিক পাৰ্থক্য। শ্রীশ্রীআনন্দমূর্তিজী দ্ব্যৰ্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করেছেন যে মানবসভ্যতার এই বিবর্তন ও উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে মানুষের মানসিক প্রগতি। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দেহ সংরচনাগত পরিবর্তনের চেয়েও বড় ভূমিকা পালন করেছে মানুষের মানসিক পরিবর্তন।আর এই পরিবর্তন সংসাধিত হয়েছে সংঘর্ষ ও সমিতির মধ্য দিয়ে। Clash and cohesion এর মাধ্যমে মানসিক বিকাশের মধ্য দিয়ে।তিনি তাঁর সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যায় দেখিয়েছেন যে মানুষের এই জয়যাত্ৰার শুরু এককোষী জীব থেকে।এই বিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলতে চলতেই সমৃদ্ধ হয়েছে মানুষের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার। আর এই সঞ্চিত অভিজ্ঞতা থেকেই সেদিনের সেই স্বল্প বুদ্ধির মানুষজনও উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে,এককভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।তাই দেখা দিয়েছিল দলবদ্ধভাবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তা।আর দল বা গোষ্ঠীর প্রয়োজনেই সেই আদিম যুগের মানুষজনও স্বল্প বুদ্ধিসম্পন্নদের মধ্য থেকে যাঁরা দৈহিক দিক থেকে অধিকতর শক্তিশালী ও তৎসহ অধিকতর বুদ্ধিসম্পন্ন তাঁদের মেনে নিয়েছিলেন দলপতি বা গোষ্ঠীপিতা হিসেবে।এই দলপতিদের কথা সকলকেই বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে চলতে হত। প্রবক্তার ভাষায়----এইভাবেই সেই পুরনো পৃথিবীতে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ক্ষাত্রপ্রধান সমাজ ব্যবস্থার।

 "মানুষের সমাজ" গ্রন্থে শূদ্র ও ক্ষত্রিয়ের পরিভাষা আরও প্রাঞ্জল ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন-----"মানুষ জাতের ভ্রুণাবস্থায় যখন পশুভাব থেকে মানুষ ভাব গড়ে উঠছিল,তখন ঠিক আজকের মানুষের মতোই তারাও তাদের সামনে দুটো পথই দেখেছিল। একটা জড়ের ভাবনায় জড় হয়ে যাবার পথ বা শূদ্রত্বের পথ অপরটি সূক্ষ্মত্বের ভাবনায় জড় তথা মানস সত্তাসমূহকে জয় করার পথ অর্থাৎ ক্ষত্রিয়ত্বের পথ।"(মানুষের সমাজ,প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড পৃষ্ঠা ১৪৮/১৪৯)

  সভ্যতার অগ্রগতি অশেষ ধারায় এগিয়ে এসেছে,এগিয়েও চলবে।একই সঙ্গে প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এগিয়ে চলার জন্য প্রাকৃতিক নিয়মেই মানুষের বৌদ্ধিক বিকাশও হয়ে চলেছে ভবিষ্যতেও হতেই থাকবে।যদিও স্বাভাবিকভাবেই এই বৌদ্ধিক প্রগতি সকলের মধ্যে সমানভাবে হয় নি,হয় না, হওয়া সম্ভবও নয়।সেই প্রারম্ভিক পর্যায়ে ক্ষাত্র প্রাধান্যের যুগে যাঁরা ছিলেন অধিকতর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন, যাঁরা মানুষের কল্যাণের জন্য করণীয়-অকরণীয় বিষয়ে জ্ঞান দিতে সমর্থ ছিলেন তাঁরা তাঁদের বিশেষ গুণের জন্যই শূদ্র-ক্ষত্রিয় নির্বিশেষে শ্রদ্ধায় পূজিত হতে থাকলেন 'বিপ্র' হিসেবে।

  সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সভ্যতাও এগিয়ে চলেছে।বাঁচার জন্য প্রয়োজন দেখা দিয়েছে অসংখ্য উপকরণের।এইসমস্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ সবসময় হাতের কাছে পাওয়াও দুষ্কর। তাই একশ্রেণির মানুষ সেবার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এলেন সেইসব নিত্য প্রয়োজনীয় দ্ৰব্যসমূহ সকলের হাতের কাছে যুগিয়ে দেবার মহান ব্রত নিয়ে।এঁরাই আদিম সমাজের প্রথম বৈশ্য সম্প্রদায়। চক্রাকার বর্ণ প্রাধান্যের এই সমগ্র প্রক্রিয়াটিতে মানুষের মনোজগতের ভূমিকাই ছিল প্রধান।