বসন্তোৎসব সারা ভারতের উৎসব–উত্তর ভারতে ‘হোলি’, বিহার অঞ্চলে ‘ফাগুয়া’ ও বাংলায় ‘দোলযাত্রা’৷ আদিতে এই উৎসব ছিল মূলতঃ আর্যদের৷ প্রাচীন আর্যদের বাসভূমি ছিল মধ্য এশিয়ায়৷ এই অঞ্চলটা ছিল ভীষণ ঠাণ্ডা৷ সারা শীতকাল কেবল বরফ পড়তো, এটা ছিল আর্যদের দুঃসহ কষ্টের কাল৷ নিদারুণ ঠাণ্ডায় মানুষ জবু–থবু হয়ে মরার মত পড়ে থাকতো, কোন কাজকর্ম করতে পারতো না৷ এই শীতকালটা যখন বিদায় নিত, আর্যরা তখন আনন্দে উৎসবে মেতে উঠতো৷ ‘উৎ’ মানে আনন্দে লাফিয়ে ওঠা আর ‘সব’ মানে ‘জন্মগ্রহণ করা’৷ আক্ষরিক অর্থেই বসন্তের আগমনে আর্যরা প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠতো, হৈ–হুল্লোড় ও কর্মচাঞ্চল্যে মেতে উঠতো৷
সারা বছরে বসন্তের আগমনেই আর্যদের সবচেয়ে আনন্দের সময়, বসন্ত ঋতু আর্যদের উৎসবের ঋতু৷ এই উৎসবে তারা ভেড়াকে মনে করতো শীতের প্রতিনিধি (কারণ ভেড়ার লোম থেকেই হত শীতের কম্বল), আর ভেড়ার পিঠে জবু–থবু হয়ে বসে থাকা বুড়ো–বুড়িকে মনে করতো তাদের দুঃসহ শীতের প্রতীক৷ তাই উৎসবের শুরুতেই পূর্ণিমার পূর্ব রাতে বুড়ো–বুড়িকে পুড়িয়ে দিয়ে তারা বলত, শীতকে পুড়িয়ে দিলুম৷ পরদিন পূর্ণিমা তিথিতে শুরু হত বসন্ত ঋতু, আর একে ঘিরে আর্যদের ‘বসন্তোৎসব’৷
উত্তর–গোলার্ধে পূর্ব ফাল্গুনী অথবা উত্তর ফাল্গুনী নক্ষত্রের অবস্থান কালে পূর্ণিমা তিথি পড়লে চান্দ্রমাসটার নাম রাখা হয় ‘ফাল্গুন’৷ সেই সঙ্গে সৌর মাসটারও নাম হয় ‘ফাল্গুন’৷ তাই বিহার ও উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলে বসন্তোৎসবের নাম ‘ফাগুয়া’৷
উত্তর ভারতে বিশেষ করে পঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে এই উৎসবকে বলা হয় ‘হোলি’ উৎসব৷ এই ‘হোলি’ নামটার পেছনে রয়েছে এক পৌরাণিক কাহিনী৷ হিরণ্যকশিপু নামে এক রাজা ছিল৷ তার বোনের নাম ছিল হোলিকা৷ সে ছিল নর–রাক্ষসী৷ তাই পূর্ণিমার আগের রাতে অর্থাৎ চতুর্দশীর রাতে লোকেরা হোলিকা নর–রাক্ষসীকে পুড়িয়ে মেরেছিল৷ এই উপলক্ষ্যে সেদিন তারা আনন্দে যে উৎসব করেছিল তার নাম ‘হোলিকা–দহন’ উৎসব৷ সেই থেকে এই উৎসব চলে আসছে ‘হোলি উৎসব’ নামে৷ সারা ভারতেই এখন বসন্তোৎসবের সূচনা হয় আগের দিন রাতে খড়–পাতা দিয়ে গড়া দৈত্যের প্রতীক অথবা শীত বুড়ীর ঘর পোড়ানোর মধ্য দিয়ে৷ এটা সেই মূল আর্যরীতিরই সংস্ক্রণ৷ বাঙলায় এটাকে বলা হয় ‘চাঁচর’, গ্রাম বাঙলায় ‘ন্যাড়াপোড়া’৷
বাঙলায় এই উৎসবের সূচনা করেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রায় ৫০০ বছর আগে৷ তিনি বৃন্দাবন পরিক্রমাকালে ওখানে ‘হোলি উৎসব’ দেখেন৷ শ্রীকৃষ্ণকে রঙ–আবির দেওয়া৷ মহাপ্রভু বাঙলায় এসে বিধান দিলেন, এ দিনটায় ভক্তেরা কৃষ্ণমন্দিরে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে রঙ–আবির দেবে৷ তারপর সেই রঙ–আবির নিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে খেলবে৷ আর যে যাকে রঙ দেবে, সে তাকে মালপো খাওয়াতে বাধ্য থাকবে৷ এ ভাবেই মহাপ্রভু বাঙলায় ‘শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা’ উৎসব প্রবর্তন করেছিলেন৷ ‘দোলযাত্রা’ কথাটার তাৎপর্য হ’ল, শীত চলে গেছে, মানুষ আবার কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে, মনে নানান চিন্তা, নানান ভাবনা আসছে, নূতন নূতন কল্পনা জাগছে৷ শ্রীকৃষ্ণের কথা ভাবতে গিয়ে মন আনন্দে ভরে উঠছে, সে ভাবনায় মনে দোলা লাগছে, মন আন্দোলিত হচ্ছে৷ ভক্তের মনও দুলছে, তা তো নয়, ভক্তের মনের দোলা ভক্তের প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণের মনকেও দুলিয়ে দিচ্ছে, ভগবানের মনে সাড়া তুলছে৷ এই হ’ল শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা৷
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতায় মহাসমারোহে এই উৎসব পালিত হ’ত৷ এই উৎসব ছিল মূলতঃ কলকাতার রাজা–জমিদারদের পারিবারিক উৎসব, তাহলেও এর আকর্ষণ ছিল সর্বজনীন৷ প্রত্যেক জমিদার ও রাজবাড়ীর কৃষ্ণমন্দিরে বিগ্রহের গায়ে ফাগ–রঙ দিয়ে শুরু হত শুকনো ফাগ–রঙ বা রং মেশানো জল নিয়ে হোলি খেলা, সঙ্গে থাকতো ঢালাও মিষ্টিমুখের আয়োজন৷ এই উপলক্ষ্যে থাকতো নানা ধরনের লোক–বিনোদনের ব্যবস্থা, মেলা, যাত্রা, রকমারী নাচ–গান–বাজনা, ইত্যাদি নানা আয়োজন, চলতো মাস জুড়ে৷ এই উৎসব এতই জনপ্রিয় ছিল যে, কোম্পানীর কর্মচারীদের জন্যে এই উপলক্ষ্যে পাঁচদিন ছুটি বরাদ্দ ছিল৷ মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হলেও জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ীর দোল উৎসব ছিল আকর্ষণীয়৷
বিহার ও উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলের ফাগুয়া উৎসব যেমন জন–জাতীর উৎসব বা পিপ্লস ফেষ্টিভ্যাল, বাঙলার দোলযাত্রা তেমনি জনজাতীয় উৎসব নয়–এটা এক ধরনের ধর্মীয় উৎসব৷ কিন্তু আজকাল বাঙলায় বসন্তোৎসবের ফাগ–রঙ–আবিরের খেলা ধর্মমতের আঙ্গিনা পেরিয়ে মন রাঙানোর জাতীয় উৎসবের রূপ নিয়েছে৷ রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে এই জাতীয় বসন্তোৎসবের সূচনা করেন৷ কবি নিজে কয়েকবারই বসন্তোৎসবে উপস্থিত থেকে এই উৎসবের মাধুর্য্য তুঙ্গে তুলে দিয়েছেন৷
বসন্তোৎসবের মূল আধ্যাত্মিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন, ভক্তের মনের বর্ণ পরমপুরুষের বর্ণে মিশিয়ে দিয়ে বর্ণাতীত হওয়ার যে সাধনা সেটা হ’ল গোপী সাধনা৷ ‘গোপী’ কে? ‘গোপী’ হ’ল পরমভক্ত৷ যে মানুষ অন্তরের সম্যক মসৃণতা দিয়ে, সরলতা দিয়ে, সরসতা দিয়ে, গভীর মাধুর্যপূর্ণ মনোভাবের দ্বারা পরমপুরুষের দিকে এগিয়ে যাবে, সেইই গোপী৷ পরমপুরুষের প্রতি ঐকান্তিক অনুরক্তি হেতু গোপী ভাবের জাগরণ ঘটে৷
গোপী–ভাবে থেকেও কোন কোন সময় এমন হয় যে, মন কিছুটা যেন ক্ষণিকের জন্যে জাগতিক চাওয়া–পাওয়ার পানে ছুটতে চায়৷ জাগতিক চাওয়া–পাওয়ার স্থূল বর্ণময়তা মনে আবিলতা এনে দেয়৷ মনের ষোল–আনা সরসতা, মাধুর্য্যপূর্ণ মনোভাব অক্ষুণ্ণ থাকে না৷ ভক্তমনের মাধুর্য্য, মসৃনতায় আবিলতা এসে যায়৷ পরমপুরুষ হ’ল, ‘রসো বৈ সঃ’–আনন্দময় রসঘন সত্তা৷ অণুমনে ষোল–আনা সরসতা থাকলে তবেই সেই রসঘন আনন্দময় সত্তার সাথে একাত্ম হওয়া যায়–যা ভক্তমনের একান্ত আকুতি৷ যে প্রকৃত গোপী, সে এ তত্ত্বটা জানে, মানে৷ তাই গোপী কী করবে? সে পরমপুরুষকে বলবে, ‘হে পরমপুরুষ, তুমি ছাড়া আর অন্য কিছু চাওয়াটা আমার ভুল হয়ে যাচ্ছে৷ এই যে আমি ভুলটা করলুম–অন্যায়টা করলুম–বর্ণময় জাগতিক বস্তু চাইতে গিয়ে আমার মধ্যে যে সাময়িক আবিলতা এসে গেল, তার জন্যে আমি আমার ভুল স্বীকার করছি৷ তাই আমার মনের বর্ণ তোমার বর্ণে মিশিয়ে দিয়ে আমি বর্ণহীন হতে চাই–আমার মানস–চিন্তার ত্রুটির জন্যে আমি সাময়িক ভাবে যে বর্ণাধীনতায় এসে গিয়েছি, আমি এই ভাবে সেটা কাটিয়ে উঠতে চাই৷ বসন্তোৎসবের মূল আধ্যাত্মিক তাৎপর্য–এখানেই৷
তথ্যসংগ্রহ সূত্র–মহান দার্শনিক প্রভাতরঞ্জন সরকারের রচিত গ্রন্থ ‘অভিমত–৫ম খণ্ড’’
- Log in to post comments