ব্যক্তিত্ব : ব্যক্তি মানবের আসল পরিচিতিv

লেখক
লীনা দাস

ব্যক্তিত্ব হল প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে গড়ে ওঠা নৈতিক, চারিত্রিক ও সামাজিক মূল্যবোধ যা তার জন্মকালীন পরিবেশ, বংশগতির ধারা ও পারিবারিক ঐতিহ্য থেকে পাওয়া! এই হল ব্যক্তিত্বের লৌকিক সংজ্ঞা৷ এই সংজ্ঞা অনুযায়ী লৌকিক দৃষ্টিতে যার সম্ভ্রম আছে বলে মনে হয় তাকে লোকে বিশেষ মর্যাদা বা শ্রদ্ধার চোখে দেখে থাকে, সে-ই ব্যক্তিত্বের অধিকারী বলে প্রতিভাত হয়৷

ল্যাটিন শব্দ পারসোনা যার প্রাচীন অর্থ হল নাট্য অভিনেতা বা মুখোসধারী ব্যক্তি যারা বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুশীলন করে বা বিবিধ দৃষ্টিকোন থেকে ব্যক্তিগত জীবন ও সামাজিক ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট ফুটিয়ে তোলে দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য৷ যেমন উত্তমকুমার ধনী, দরিদ্র, অভিজাত ব্যক্তির, ভূত্যের এমনকি কখনো কখনো খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন৷ সেখানে তাঁর যে অসামান্য অভিনয় দক্ষতা বা দৃঢ়তা তাঁকে বিশেষ চারিত্রিক মর্যাদা বা ব্যক্তিত্বের অধিকারী করে তুলেছে৷

আবার আধুনিক কালে ব্যক্তিত্বের সংজ্ঞা দিতে গেলে মনোবিদদের বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে যে অভিমত সংগৃহীত হয়েছে তা সামগ্রিক, সর্বজনগ্রাহ্য, বিশ্লেষনাত্মক, ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত রূপই হল ব্যক্তিত্ব৷ যার প্রকাশ ঘটে শিক্ষার্থীগনের শিক্ষাকালে বিভিন্ন গুনাবলীর মাধ্যমে৷ আধুনিক মনোবিদ্যা দর্শনের একটি প্রয়োগমূলক শাখা৷ শিক্ষা ও মানবজীবনের নানা গতি - প্রকৃতি জানার বা তার অভিযোজন কৌশল সম্বধীয় জ্ঞানের ব্যাপক বিস্তৃত শাখাই হল প্রয়োগমূলক মনোবিদ্যা৷

বিবিধ জন্মকালীন পরিবেশ, বংশগতি, ঐতিহ্য থেকে উঠে আসা ভিন্ন ভিন্ন শিশু নানা বয়সের সার্মথ্য, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ, আগ্রহ ও প্রেষনার দ্বারা পরিচালিত হয়৷ সেই সামগ্রিক সংবেদনশীল অবস্থাকে সহানুভূতির সাথে অনুধাবনের যথার্থ প্রয়াস হল মনোবিদ্যার শিক্ষা৷ শিক্ষাবিদদের বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে পাওয়া শিক্ষাকে সংজ্ঞায়িত করা হয় এইভাবে যে শিক্ষা হল-শিক্ষার্থীর অন্তর্হিত সম্ভাবনার সুষম বিকাশ৷ এই সুষম বিকাশের মধ্যে শিক্ষার যে তাৎপর্য চরিত্রগঠন তা বিহিত৷ সৃজনশীল, গঠনমূলক মানসিকতা ব্যতীত আদর্শ শিক্ষার্থী ও আগামীর আদর্শ সামাজিক রাষ্ট্রীয় কান্ডারী হওয়া অসম্ভব৷ কারণ সেখানে সুফলদায়ী শিক্ষা যা আবহমান কাল ধরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে শিক্ষার্থীর আগ্রহ, গ্রহণ সামর্থ, অনুধাবন ধারা সেই অনুযায়ী পথপ্রদর্শক দার্শনিক ও বন্ধু হয়ে শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দান করা এবং তাকে সমস্ত অনৈতিক প্রলোভন বা মানসিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে নৈতিক মূল্যবোধগুলিকে যথার্থভাবে তার দৃষ্টিতে সংজ্ঞায়িত ও বাস্তব জীবনে মুল্যায়িত করলেই তার যথার্থ ব্যক্তিত ও চরিত্র গঠন করা যাবে৷ যা শিক্ষালয় তথা শিক্ষণের একটি আবশ্যিক পর্যাপ্ত শর্ত৷

এইবার আমরা শিক্ষণ ও ব্যক্তিত্বের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করব৷ ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞাটি এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে আলোচনা প্রয়োজন৷ মনোবিদ আলপেটের মতে ব্যক্তিত্ব হল এক সামাজিক, জটিল, আকর্ষণীয়, গতিবন্ত সংগঠন! ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যগুলিকে বিশ্লেষন করলেই - এই সংজ্ঞার তাৎপর্য অনুধাবন করা যাবে৷ আত্মবিশ্বাস, সামাজিকতা, ভদ্রতা ইত্যাদি শিক্ষণ বিভিন্ন প্রশিক্ষনের দ্বারা আচরণের কাম্যগত পরিবর্তন হয় যার ফলে অন্য সকলের মধ্যে থেকেও কোন একজন ব্যক্তি সর্বক্ষেত্রে বিশেষভাবে পারদর্শিতা ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা প্রদর্শন করতে পারেন৷ তিনি হলেন সামাজিকভাবে ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ব্যক্তি৷ এটি হল ব্যক্তিত্বের ইতিবাচক দিক৷ আবার নেতিবাচক দিক হল মানুষের চরিত্র থেকে মানুষের চারিত্রিক - নৈতিক মূল্য বাদ দিলে তা হয় ভিন্নমাত্রার ব্যক্তিত্ব৷

ব্যক্তিত্বের প্রকাশ বিবিধভাবে মানুষের কথায় ও কাজের মধ্য দিয়ে ঘটে থাকে৷ মানুষের বিবেচনা বোধ থেকে কোন মানুষের তাৎক্ষনিক আচরণ বা কর্মকুশলতা দেখে সেই ব্যাক্তিকে জানতে বা বুঝতে পারার বা অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তিকে ওইভাবে চিহ্ণিতকরণ করলে তবেই তার ব্যক্তিত্ব স্বয়ং সম্পূর্নরূপে প্রকাশ পায়৷ কোন মানুষের ব্যক্তিত জাগরণকারী এইরকম সুফলদায়ী শিক্ষাই মানুষের মধ্যে ব্যক্তিত্বের একটি গুরুত্বপূর্ন অংশ হিসেবে অর্ন্তদৃষ্টির জাগরণ ঘটায়৷ যে অন্তর্দৃষ্টি একটি নিষিক্ত মনুষ্য ভ্রণ বা শিশুর মধ্যে নৈতিক চরিত্র পর্যবেক্ষণ করতে পারে এবং সেই দিশাতেই একটি শিশুর নৈতিক চরিত্র গঠনে ও তার সুকুমার বৃত্তিগুলি পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় দৃঢ়তা ও সঠিক পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করে শিশু মনোবিদ্যা৷ যার ফলে বর্তমানের শিশু পরিচালকগণ শিশু পরিচালনায় দক্ষ হলে তবেই আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ সুদুঢ় হবে৷ শিশুর ভবিষ্যৎ হবে সুরক্ষিত আর পরিচালকগন সুদক্ষ হিসাবে স্বীকৃত হবেন৷

এক্ষেত্রে বর্তমানে শিশুশিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয়৷ যদি বর্তমানের শিশুশিক্ষার মধ্যে শিক্ষণের আবশ্যিক পর্যাপ্ত শর্তগুলির সমন্বয় থাকে তবেই তা হবে সার্থক শিক্ষা বা ব্যক্তিত্ব গঠনের সঠিক প্রয়াস৷ যেমন শিক্ষনের আবশ্যিক শর্ত দুটি হল স্মৃতি ও ধৃতি৷ স্মৃতিতে অন্তর্ভুক্তি হল স্মরণ শক্তি আর ধৃতি হল সেই স্মরণশক্তির ধারণ বা সংরক্ষণ ক্ষমতা যাতে মনের মধ্যে সবকিছুই ধরা থাকে বা সংরক্ষিত থাকে৷ যেমন ধরা যাক সময় বিশেষে পড়াশোনা বা খেলাধুলার সময় আবার ক্ষেত্র বিশেষে বন্ধু বা আত্মীয় স্বজনদের সামগ্রিক কথপোকথনের সময়’থেকে সুনির্দষ্ট সময়ে প্রয়োজনীয় অংশটুকুকে বিশেষভাবে ধারণ বা সংরক্ষণ করে তাৎক্ষণিক বা সুদুরপ্রয়াসী বিচার বিবেচনা দ্বারা জানতে, বুঝতে বা মেনে চলতে পারার দক্ষতাই হল স্বয়ং স্বীয় ব্যক্তিত্বের উপলব্ধি বা সামাজিক ভাবে সামগ্রিক যথার্থ ব্যক্তিত্বের প্রকাশ৷ এই আত্মবিকাশের শিক্ষাই হল ব্যক্তিত্বের শিক্ষা বা সামগ্রিকভাবে সন্তোষজনক শিক্ষা৷

পরমশ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ব্যাকরণ বিজ্ঞানের মতে ব্যক্তির পরিবর্তে ব্যষ্টি শব্দ ব্যবহার করা হয়৷ ব্যক্ত শব্দের অর্থ প্রকাশ করা৷ সমষ্টির একবচনে ব্যষ্টি৷ -                        --সম্পাদক