ভারতের প্রাচীন গণিতবিদ্ ভাস্কর আচার্য্য ও দাবা খেলার মজার গাণিতিক কাহিনী

লেখক
শ্রীসমরেন্দ্রনাথ ভৌমিক

পৃথিবীতে সর্বপ্রথম গণিত শাস্ত্রের চর্চা শুরু হয়েছিল ভারতবর্ষ হতেই৷ মিশর, ব্যাবিলন, মেসোপটেমিয়া, চীন প্রভৃতি দেশে প্রাচীন কাল থেকে গণিতের অনুশীলন চললেও কালের গণনায় ভারতবর্ষই ছিল গণিত শাস্ত্রের অনুশীলনে পথিকৃৎ, তথা গণিতের সূতিকাগৃহ৷ ভারতে আর্যঋষিরা অধ্যাত্ম শাস্ত্রের সহিত গণিত শাস্ত্রেরও গভীর আলোচনা বা চর্চা করতেন ৷ আজ থেকে আনুমানিক সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে মহর্ষি কপিল মুনি, কপিল পাহাড়ের গুহায় অধ্যাত্ম সাধনা করতেন ও সেই সঙ্গে গণিত শাস্ত্রের চর্চাও করতেন৷ এমনই এক গণিতবিদ্ হলেন – ভাস্কর আচার্য্য Bhaskaracharya ৷ ভাস্কর আচার্য্য ছিলেন একজন ভারতীয় গণিতবিদ্ ও জ্যোতির্বিদ৷ সম্ভবতঃ ১১১৪ খ্রীষ্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের বিদার গ্রামে ভাস্করাচার্য্য জন্মগ্রহণ করেন৷ তাঁর পিতার নাম মহেশ দেবজ্ঞ৷ ভাস্করাচার্য্য আনুমানিক ১১৫০ খ্রীষ্টাব্দে ‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি’ নামক তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেন৷ এই গ্রন্থটি (1) লীলাবতী (পাটিগণিত ও পরিমিতি) (2) বীজগণিত (3) গ্রন্থগণিতাধ্যায় ও (4) গোলাধ্যায় – এই চারটি ভাগে বিভক্ত৷ শেষ দু’টি গ্রন্থে তিনি বর্তুলের তলের ক্ষেত্রফল নির্ণয় পদ্ধতি, চন্দ্রের দ্রাঘিমা নির্ণয়, পৃথিবীর গোল হওয়ার কারণ ও মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বর্র্ণনা করেছেন৷ তিনি শূন্য দ্বারা কোন সংখ্যাকে ভাগ সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা দেন৷ দৃষ্টান্ত স্বরূপ 10 ¸ 0 = 10/0 ও 3¸ 0 = 3/0 ও এই প্রসঙ্গে লিখেছেন–এই ভগ্ণাংশটিকে যার হর শূন্য, একটি অনন্ত রাশি বলা হয়৷

ভাস্করাচার্য্য কোন গুণোত্তর শ্রেণীর n-সংখ্যক পদের সমষ্টি নির্ণয়ের একটি যুগান্তকারী সূত্র আবিষ্কার করেন৷

এই যোগফল নির্ণয়ের সূত্রটির সহিত দাবা খেলার আবিষ্কারের এক মজার কাহিনী জড়িত আছে৷ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো খেলাগুলির মধ্যে দাবা খেলা হ’ল একটি পুরোনো খেলা৷ এই দাবা খেলার উদ্ভাবককে নিয়ে একটি মজার অতীব গাণিতিক শিক্ষামূলক গল্প আছে৷ কিংবদন্তী অনুযায়ী দাবা খেলার জন্ম এই ভারতবর্ষে৷ দাবা খেলার উদ্ভাবকের নাম হ’ল – চিস্সা৷ দাবা খেলায় অত্যন্ত প্রখর গাণিতিক বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে গুটিগুলি নিয়ে অসংখ্যবার চালাচালি করতে হয়৷ অত্যধিক বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে চাল দিতে হয়৷ যে খেলার মধ্যে এত উচ্চ ধরণের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার পরিচালনা ক’রে খেলতে হয়, সেই প্রখর বুদ্ধিযুক্ত খেলার আবিষ্কার বাদশা শেহরাম–কে বিশেষভাবে মুগ্ধ ও আনন্দিত করেছিল৷ তাই তিনি এই খেলার উদ্ভাবক–কে পুরস্কারের কথাও জানিয়ে দিয়েছিলেন৷ এর উত্তরে দাবা আবিষ্কারক যে পুরস্কার চেয়েছিলেন, তা হ’ল – দাবা ছকে ৬৪ টি ঘর আছে৷ এই ৬৪ টি ঘরের প্রথম ঘরটিতে ১টি মাত্র গমের দানা, দ্বিতীয় ঘরে ২টি গমের দানা, তৃতীয় ঘরটিতে ৪টি গমের দানা, এইভাবে প্রতিটি ঘরে ঠিক আগের ঘরের দ্বিগুণ সংখ্যক গমের দানা রাখলে ৬৪ টি ঘরের জন্য মোট যতগুলি গমের দানা হয়, ঠিক ততগুলি দানাই যেন দাবা উদ্ভাবক–কে পুরস্কার হিসাবে দেওয়া হয়৷ বাদশা, চিস্সার এই পুরস্কার মঞ্জুর পরলেন৷

পরদিন বাদশার দরবারের প্রধান গণিতবিদ্ বাদশাকে বললেন, – চিস্সাকে পুরস্কার দেওয়ার ক্ষমতা বাদশার নেই৷ এই কথা শুনে বাদশা অবাক হ’লেন ও অবশেষে গমের দানার সংখ্যা কত তা জানতে চাইলেন৷

গণিতবিদ্ জানিয়ে দিলেন –

গমের দানার সংখ্যা হ’ল –

(1, 84, 46, 74, 40, 73, 3

 70, 95, 51, 615) টি

অর্থাৎ দাবার ওই ৬৪টি ঘরে মোট যে গমের দানা জমা পড়বে তার সংখ্যা ওই উপরোক্ত বিশাল সংখ্যাটি৷ কিন্তু আমরা যদি একটু চিন্তা করি তা হলে আমরা নির্ণয় করতে পারবো যে, ওই বিপুল সংখ্যক গমের দানাগুলি রাখার জন্যে কত বড় শস্য ভাণ্ডার চাই ও এই শস্য ভাণ্ডার বাস্তবে করা সম্ভব কি না এখন, এই দাবার ৬৪টি ঘরের মধ্যে যতগুলি গমের দানা রাখতে হবে তা যোগ করলে যোগফল দাঁড়ােেব      

=1 +2+22 +23+ ——— + 263

= 1. (264 - 1) / 2 - 1 [ ভাস্কর আচার্য্য–এর সূত্র]

= 264 - 1

= 18446744073709551615

অর্থাৎ 18446744073709551615 টি গমের দানা চিস্সা–কে পুরস্কার দিতে হবে৷

কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক গমের দানা রাখার জন্য কতটা পরিমাণ স্থান দরকার আনুমানিক,1 ঘনমিটার গমের আয়তনে 15000000 টি গমের দানা রাখা যায়৷ এই হিসাবে, দাবা খেলার উদ্ভাবক যে পুরস্কার চেয়েছেন তার জন্যে প্রায় 1, 20, 00, 0000,00000 ঘনমিটার বা 12000 ঘন কিলোমিটার শস্যভাণ্ডারের প্রয়োজন৷ আমরা যদি 4 মিটার উঁচু ও 10 মিটার চওড়া একটি শস্যের গোলা তৈরী করি, তা হলে সেই গোলার বা শস্য ভাণ্ডারের দৈর্ঘ্য হবে 30, 00, 00, 000কিলোমিটার৷ অর্থাৎ এই দৈর্ঘ্য হবে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের দ্বিগুণ৷ যেহেতু, সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব হ’ল 149503923 কিলোমিটার অর্থাৎ 150 000000 কিলোমিটার (প্রায়)৷

বাদশা যদি গণিতে পারদর্শী হতেন তা হলে এত বিশাল পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিতেন না৷