ভারতীয় সমাজে নারীর অবদান

লেখক
অদিতি দত্ত বাগ

‘নইকো অবলা’ বিভাগে আমরা শুরু করছি তাঁদের গুণগাঁথা যাঁরা আবহমানকাল ধরে রাঁধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরে  রাঁধার গোলক ধাঁধাঁতে থেকেও সমাজে আলোকবর্তিকা নিয়ে এগিয়ে গেছেন বা যাচ্ছেন, মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাত রঞ্জন সরকারের কথায়--- ‘‘সুপ্রাচীন সমাজে নারী পুরুষের সমানাধিকার ছিল, পরবর্ত্তীকালে সমাজে নারীর গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় এক নূতন ধরনের সমাজ ব্যবস্থার উদ্ভব হল যাকে বলা যেতে পারে মাতৃগত Matrilineal) ও মাতৃপ্রধান Matriarchal) সমাজ ব্যবস্থা আরও পরবর্ত্তীকালে দৈহিক শক্তির গুরুত্ব অন্যান্য শক্তির চেয়ে আরও বড় হয়ে দেখা ছিল৷ স্বভাবতই নারীর চেয়ে পুরুষের দৈহিক শক্তি বেশি থাকায় তাদের গুরুত্ব গেল বেড়ে৷ এরই ফলশ্রুতিতে এক নূতন ধরনের সমাজ ব্যবস্থার উদ্ভব হল যাকে বলা যেতে পারে পিতৃগত Patrilineal) ও  পিতৃপ্রধান Patriarchal) সমাজ ব্যবস্থা৷

ভারতীয় সমাজ নারীর অবদান অধ্যায়ে আমরা প্রথমে শুরু করব বৈদিক যুগে নারীদের অবদান দিয়ে৷

বৈদিক সমাজে নারীর স্থান হুবহু একরকম ছিল না, প্রথম দিকে নারীরা অনেকটাই সমধিকার পেতেন, সমাজে সম্মানের সাথে বসবাস করতেন৷ উপনিষদে বলা হয়েছে প্রজাপতি নিজেকে দুইভাগে বিভক্ত করে পুরুষ ও নারী উৎপত্তি করলেন৷ সেই পুরুষ -প্রকৃতিই আদিপতি ও পত্নী---

‘‘স ইমমেবাত্মানং দ্বেধা পাতয়ৎ

তবঃ পতিশ্চ পত্নী চা ভবতাম্‌ ’’  (বৃহদারণ্যক ১/৪/৩)

বেদে নারীকে ঊষস্‌ অর্থাৎ ভোর এর সাথে তুলনা করা হয়েছে, ‘শুচি ও সুন্দর ঊষস্‌, রক্তবস্ত্রে সজ্জিতা যেন সদ্যস্নাতা, মায়ের হাতে স্নেহভরে প্রসাধিতা এক কন্যা৷    (ঋগ্বেদ/১২৩/১)

ঋগ্বেদে দেখি নববধূকে আশীর্বাদ করে ঋষিরা বলছেন ---শ্বশুর, শ্বাশুড়ী, ননদ, দেবর, সকলের কাছেই তুমি  সম্রাজ্ঞী হও৷ (ঋগ্বেদ ১০/৮৫/৪৬)

ঘরে ঘরে বধূকে ‘সুমঙ্গলী’ বলে স্বাগত করা হয়েছে৷ সকলের কাছে নববধূর সৌভাগ্য আশীর্বাদ প্রার্থনা করা হয়েছে৷

‘‘সুমঙ্গলীরিয়ং বধূরিমাং সমেত পশ্যত৷

সৌভাগ্যমন্যৈ দওয়াখাণ্ডর বি পরেতন৷’’  (ঋগ্বেদ ১০/৮৫/৩৩)

আবার নববধূর উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে এই সংসারকে পরিচালনা করার জন্য সদা সাবধানে জেগে থাক৷ তুমি ‘সিন্ধু’র  মত আপন মহত্ত্ব ও দাক্ষিণ্যগুণে সম্রাজ্ঞীর পদ লাভ কর (অথর্ববেদ ১৪/১/৪৩)৷ বিবাহের সময়ে বধূর মধ্যে  পাঁচটি আকাঙ্ক্ষিত গুণ ছিল--- বিত্ত, রূপ, শিক্ষা, বুদ্ধি ও সদ্বংশ (মানব গৃহ্যসূত্র ১/৭৬, বরাহ গৃহ্য সূত্র-এর থেকেই ধারণা হয় যে নারীরা বেশির ভাগই শিক্ষিত ছিলেন, যাজ্ঞ্যবল্ক বিদুষী কন্যালাভের জন্যও একটি অনুষ্ঠানের নিয়ম বলেছেন৷

                     (বৃঃআঃ ৬/৪/১৩)

প্রাচীন সাহিত্যে নারীদের গৃহে কি কর্তব্য সে  সম্বন্ধে স্পষ্টভাবে কিছু বলা নেই, শুধু বলা হয়েছে তারা জল আনত ও খেতের দেখা শোনা করত (ঐতরেয় উপনিষদ ৪/৫/৫)৷

শত পথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে তারা পশম পাকাত (এবং হয়তো বুনতও (শতপথ ব্রাহ্মণ ১২/৭/২/১)

বিখ্যাত লেখিকা ডঃ সুকুমারী ভট্টাচার্যের কথায় ‘‘ঋগ্বেদে নারীদের যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করারও সাক্ষ্য আছে৷ তাই আমরা শুণি-মুদ-গলিনীর যুদ্ধজয়ের বৃত্তান্ত (ঋগ্বেদ ১০/১০২/২) বিশ্‌পলা যুদ্ধে একটি পা ও বধ্রিমতী একটি হাত হারান, বধ্রিমতী ও শশীয়সী তাঁদের বীরত্বের জন্যও উল্লিখিত হয়েছেন এর থেকে প্রাচীন বৈদিকযুগে নারীর কিছুটা সাম্যভোগ করার সাক্ষ্য মেলে, দেবগণ ও পিতৃগণকে দৈনন্দিন জল দেওয়ার প্রসঙ্গে এমন তিন নারীর নাম পাই যাঁদের উদ্দেশ্যেও জল দেওয়া হত,  তাঁরা হলেন---গার্গী বাচক্লবী, বড়বা আত্রেয়ী ও  সুলভা মৈত্রেয়ী৷ তাছাড়া বেদের ছয় অধ্যয়নের অন্তে উৎসর্গ দিবসে একটি অনুষ্ঠান হতো অন্যান্য শ্রাদ্ধার্হদের মধ্যে বশিষ্টপত্নী অরুন্ধতীকে আসন দেওয়া হত৷’’ (প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ -সুকুমারী ভট্টাচার্য)

বহু বেদমন্ত্রই নারী ঋষিরা রচনা করেছেন, ঋগ্বেদেও  দেখা  যায় বহু নারী ঋষির মন্ত্র৷ রোমশা (১/১২৬) লোপামুদ্রা (১/১৭৯), বিশ্ববারা (৫/২৮), অপালা (৮/৯১/৭), যমী (১০/১০), বসুক্রজায়া (১০/২৭-২৮) ঘোষা (১০/৩৯), সূর্যা (১০,৮৫), উর্বশী (১০/৯৫), সরমা (১০/১০৮), বাক্‌(১০/১২৫), ইন্দ্রাণী (১০/১৪৬), ইন্দ্রজননী (১০/১৫৩), বিবস্বৎ কন্যা যমী (১০/১৫৪), শচী (১০/১৫৯), সার্পরাজ্ঞী (১০/১৮৯) ছাড়া আরও বহু নাম ঋক্‌বেদে-সংহিতায় ও অন্যান্য বেদে পাওয়া নারীরা যে শিক্ষাও দিতেন তা বুঝা যায় পাণিণির ‘আচার্যা’ ও ‘উপধ্যায়া ও উপাধ্যায়ী (৩.৩.২১) শব্দগুলিতে, প্রাচীন ব্যাকরণ আপিশল যে নারী শিখেছেন তিনি ‘আপিশলা’ (৪,১,১৪)

কালকৃৎস্মি ছিলেন একজন মীমাংসাচার্য৷

বিখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ্‌ শ্রীক্ষিতি মোহন সেন এর কথায়--- ‘‘নারীদের অবরোধের কথা বেদে দেখা যায় না৷ সমাজে নারীরা সহজেই বিচরণ করিতেন যাগযজ্ঞে যোগ দিতেন৷ নারীরা বেদ মন্ত্রও রচনা করিতেন৷ অথর্বে নারীদের উপনয়ণ ও ব্রহ্মচর্যের কথা আছে৷ তাই বোঝা যায় নারীদের শিক্ষার অধিকার ছিল৷ উপনিষদে ব্রহ্মবিদুষী নারীদের কথা পাই৷ নৃত্যগীতে নারীর শিক্ষা নিতে হইত (তৈত্তি সং ৬/১/৬৫) জাতিভেদ সুপ্রতিষ্ঠিত হইবার পূর্ব পর্যন্ত বরকন্যার পছন্দ ও যৌবন বিবাহ চলিত৷ তাহার পর পছন্দ ও যৌবন বিবাহ গেল স্মৃতির যুগে কন্যাদের অল্পবয়সেই বিবাহ হইত৷--- (প্রাচীন ভারতে নারী শ্রীক্ষিতিমোহন সেন)৷ এর থেকেই প্রমাণিত হয় নারীরা সব ক্ষেত্রে না হোক বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমমর্যাদার অধিকারী ছিল৷ (ক্রমশঃ)