কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত প্রকৃতির পক্ষপাতিত্ব দেখে এক সময় বলে উঠেছিলেন, চেরাপুঞ্জীর থেকে একখানা মেঘ ধরে দিতে পারো গোবি সাহারার বুকে? অর্থাৎ প্রকৃতি সৃষ্ট এই বিরাট পৃথিবীর কোথাও পাহাড়-পর্বত অনুর্বর পাথর কাঁকরে ভরা মৃত্তিকা, কোথাও মরুভূমি, কৃপন বর্ষা, কোথাও নদী-নালা, জঙ্গলাকীর্ণ বনভূমি, কোথাও গরম উর্বর মৃত্তিকা, কোথাও সমুদ্রের বিশালজলরাশি তার মধ্যে ছোট বড় দ্বীপভূমি, পৃথিবী এককথায় বৈচিত্র্যময়৷ সেখানে নানান ধরণের জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ, জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী ও অবশ্যই মানুষ৷ বৈচিত্রময় এই পৃথিবী দেখে স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের মনে হতে পারে পৃথিবী পক্ষপাতদুষ্ট৷ কবিও প্রকারান্তরে তাই বলেছেন৷ প্রকৃতি কাউকে বেশী কৃপা করেছে৷ কারোর প্রতি সে অকরুণ৷ কিন্তু জীবজন্তু মানুষ কোন সময়েই প্রকৃতির উপর নির্ভর করে বসে থাকেনি৷ তারা একস্থান থেকে অন্য স্থানে গিয়েছে অনুকূল পরিবেশের সন্ধানে৷ যেখানে অনুকূল পরিবেশ পেয়েছে সেখানেই সে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে৷ অবশ্য যারা অনুকূল পরিবেশের সন্ধান পায়নি তারা পৃথিবীপৃষ্ট থেকে অবলুপ্ত হয়ে গেছে৷ ফসিল হয়ে থেকেছে কেউ কেউ৷ আগ্ণেয়গিরির অগ্ণ্যুপাত, সমুদ্রের জলোচ্ছাস, সাইক্লোন, হঠাৎ হঠাৎ ভূমিকম্পে সমুদ্রের তলদেশ উপরে উঠে এসেছে৷ মরুভূমি সৃষ্টি করেছে, পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি করেছে৷ আবার উপরের স্তর নীচে নেমে জলাশয় বা সমুদ্র সৃষ্টি করেছে৷ পৃথিবী এমন খামখেয়ালীপনায় মত্ত ছিল৷ ধীরে ধীরে পৃথিবীর খামখেয়ালীপনা স্তিমিত হয়েছে একটা স্থিতাবস্থায় এসেছে মানুষ তখন অনেক উন্নত হয়েছে৷ যে যেমন পেয়েছে তাকেই তারা সাময়িকভাবে মেনে নিয়েছে৷ কিন্তু তারমধ্যে পাশবিক প্রবৃত্তিগুলি সমান কার্যকরী ছিল৷ এমন সময় এই মানুষের মধ্যেই আবির্ভূত হয়েছেন সদাশিব৷ যিনি মানুষকে নতুন পথের দিশা দিলেন৷ পাশবিক প্রবৃত্তিগুলো সংযত করার শিক্ষা দিলেন৷ গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে লড়াই বন্ধ করে শান্তি ফেরালেন৷ নৃত্যগীত, বাদ্য, নাট্য, দিয়ে তিনি মানসিক উন্নতি ঘটাতে চেষ্টা করলেন৷ আর সেখান থেকে কীভাবে আধ্যাত্মিক পথে অগ্রসর হওয়া যায় তা তিনি শেখালেন৷ আরো অনেক মানসিক সম্পদ মানুষের হাতে তুলে দিলেন৷ এরও কিছু পরে ভারত মহেঞ্জদারো-হরপ্পার মত সভ্যতা পেয়েছিল৷ এমনি করে চলছিল৷ কিন্তু মানুষতো পুরোপুরি পাশবিক প্রবৃত্তিগুলোকে সংযত করতে পারিনি৷ তাই এরপর অনেক ছোট ছোট রাজ্য গড়ে উঠেছিল৷ লোভ লালসার বশবর্তী হয়ে রাজ্যে রাজ্যে লড়াই লেগেই থাকতো৷ রক্তপাত হতেই থাকলো৷ রাজারা সব দুরাচারী হতে লাগলো৷ নিজেদের ভোগ বিলাস কায়েম রাখার জন্য প্রজাদের উপর অত্যাচার চালাতে লাগলো৷ এইরকম একটি অবস্থায় আবির্ভূত হলে শ্রীকৃষ্ণ৷ তিনি দুর্বল ধর্মপ্রাণ মানুষের পাশে দাঁড়ান৷ ফলে বিশ্বময় কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ করে মহাভারত রচনা করলেন৷ প্রকৃত শান্তির প্রতিষ্ঠা করলেন৷ শ্রীকৃষ্ণের মহাপ্রয়াণের পরেও সেই শান্তির পরিবেশ ছিল, সেই পরিবেশে মানুষ শাস্ত্র, ধর্ম, দর্শন, জ্ঞান, বিজ্ঞানের চর্র্চ করে একটা উন্নত অবস্থায় পৌছে গেল৷ বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় এই সময় সৃষ্টি হয়েছিল৷ মহাত্মা গৌতমবুদ্ধ এরপরে প্রেম-মৈত্রী- শান্তির বাণী জগৎবাসীকে শোণালেন৷ প্রকৃতিও এখানে অকৃপণভাবে সম্পদ ঢেলে দিয়েছিল৷ কিন্তু প্রকৃতি যেখানে অকরুণ সেই মধ্যপ্রাচ্যের মধ্য এশিয়ার মানুষের নজরে পড়লো সুজলাং সুফলাং ভারতভূমির দিকে৷ দলে দলে, শক, হুন, গ্রীক পারসিক, হানাদাররা ভারতের সম্পদ লুন্ঠনের আশায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল৷
অনেকেই স্থায়ীভাবে এখানে রয়ে গেছেন৷ আরো অনেক পরে তুর্কী,মোঘল, পাঠানরা ভারতের সম্পদ লুন্ঠনের আশায় ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ এরাও অনেকে অনুকূল পরিবেশ পেয়ে যায়৷
প্রকৃতি খামখেয়ালী, পক্ষপাতদুষ্ট, অকরুণ, এই যে অপবাদ দেওয়া হয়েছে তা কী সঠিক? এই পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ সব কিছুই ব্রহ্মের বিকাশ৷ সমস্ত কিছুতেই তার স্নেহের পরশ রয়েছে৷ তিনিতো উদ্ভিদ, জীবজন্তু, মানুষ সবাইকে ভালোবাসেন৷ তিনিইতো শ্রষ্ঠা৷ তিনিতো কারোর প্রতি পক্ষপাতিত্ব করতে পারেন না৷ কিন্তু তবুও মানুষে মানুষে হানাহানি, জাতপাতের লড়াই সম্পদের অসম বন্টন, অভাব দারিদ্র্যের জন্য মানুষের দুঃখ কষ্টের সীমা নেই৷ উদ্ভিদ ও জীবজন্তু মানুষের অত্যাচারে জর্জরিত৷ অনেকে ধরা পৃষ্ঠ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে৷ এখানে দরকার ছিল আর একজন মনীষির যিনি মানুষকে ডেকে বলবেন মানুষ তুমি পৃথিবীতে এমন একটি পরিবেশ রচনা কারো যেখানে মানুষ, জীবজন্তু ও উদ্ভিদের পরিপূর্ণ বিকাশ হয়ে থাকলে সকলে সুখে শান্তিতে থেকে সেই শ্রষ্টার দিকে এগিয়ে যেতে পারে সেই মনীষি নিঃসন্দেহে আজকের মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তথা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি৷ তিনি বলেন--- এই জগতের যাবতীয় জাগতিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক সম্পদের সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ করে সকলের মৌলিক চাহিদা পূরণ করো যুক্তি সম্পন্ন বন্টন করো, নব্যমানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে জীবজন্তু , উদ্ভিদ মানুষ সকলের বিকাশের জন্য এগিয়ে চলে শ্রষ্টার দিকে নোতুন পৃথিবী গড়ে তোলে৷
- Log in to post comments