১০ই ডিসেম্বর ২০১৮ ইং তারিখে ত্রিপুরার অন্যতম দৈনিক স্যন্দন পত্রিকায় শ্রদ্ধেয় শম্ভূদেববর্মা ‘‘প্রসঙ্গ এন.আর.সি ও ত্রিপুরা’’ শিরোনামের প্রবন্ধটি সাম্প্রতিককালে একটি উৎকৃষ্ট সমালোচনামূলক আলোচনা৷ এতে তিনি সম্মানিত হরিগোপাল দেবনাথ, রঘুবীর দাস, জহরলাল সাহা, গৌরাঙ্গরুদ্র পাল, রঞ্জিত বিশ্বাস, শংকর দাশ, কপিল তালুকদার, সংবাদ প্রতিনিধি ও জগদীশ মন্ডল মহাশয়গণের লেখার কিছু সমর্থক ও কিছু বিরোধিতা করেছেন৷ সমালোচনা এক তরফা হওয়া উচিত নয়৷ শ্রী দেববর্মার গতি ছিল উভয় দিকেই৷ এটা অবশ্যই ধন্যবাদই৷
প্রথমেই আমি মাননীয় শম্ভুবাবু যে যে কথাগুলো সমর্থন করেছেন৷ তা হলো ---
১) বাঙালীদের দেওয়া রাজস্বেই বর্ত্তমান ত্রিপুরা গড়ে উঠেছে৷ দাবি আংশিক সত্য৷ কারণ চাকলা রোশনাবাদ সমতল জমির খাজনা হিসাবে রাজস্ব আদায় করা হতো৷ এটা ছিল ত্রিপুরা রাজার একটা আয়ের উৎস৷
২) ত্রিপুরার রাজন্য আমল থেকে বাঙালীদের অবদান অপরিসীম বলে দাবী উঠে৷ দাবিটির প্রতি একমত ও বাস্তবের নিরিখে স্বীকার করতে হয়৷
কারণ, রাজন্য আমলে, জনজাতিদের মধ্যে শিক্ষিতের সংখ্যা ছিল খুবই নগন্য৷ বীরচন্দ্র মাণিক্য (১৮৬২-৯৬) প্রথম পূর্ববাংলা পরবর্ত্তীতে পূর্ব পাকিস্তান অধুনা বাংলাদেশ থেকে শিক্ষিত বাঙালীদের রাজ্যে আনেন শিক্ষক হিসাবে নিয়োগের জন্য৷ কাজেই জনজাতিদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য বাঙালীদের অবদান অনস্বীকার্য৷
দুই, শুধু শিক্ষা বিস্তারের জন্যই নয় রাজকার্য বা রাজ্যশাসনের প্রয়োজনে দেখা দেয় শিক্ষিত লোকের৷ তখন পূর্ববঙ্গ থেকে শিক্ষিত লোক আনতে বাধ্য হন৷ তিন রাজ্যে জনজাতিদের মধ্যে কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য ধর্মপালন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও বাঙালীদের অবদান স্বীকার করতেই হয়৷ যদি স্বীকার না করে তাহলে বাস্তবকে উপেক্ষা করার শামিল৷
রাজন্য আমলের উল্লেখ্যযোগ্য বাঙালী প্রশাসকরা হলেন নীলমণি দাস, শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ৷ কুমারগণের শিক্ষার জন্য মহারাজা বীরচন্দ্র রাধারমণ ঘোষকে শিক্ষক নিযুক্ত করেন৷ ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দে উমাকান্ত দাস শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন৷ পরে মন্ত্রী পদে নিযুক্ত হন রায়বাহাদুর মোহিনীমোহন বর্ধন৷ বর্তমানে উমাকান্ত দাসের নামানুসারে উমাকান্ত একাডেমী৷
৩) ১৯৪২ সালে ঢাকা জেলার রাইপুরায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়৷ উদ্বাস্ত বাঙালীরা দলে দলে ত্রিপুরা আসেন৷ মহারাজা বীরবিক্রম তাদের সাদরে গ্রহণ করেন ও তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন৷ শুধু তাই নয়, শহরতলীর অরুন্ধতী নগরে কলোনি স্থাপন করে তাদের পুনর্বাসনও দেন৷ ১৯৪৬ সনে নোয়াখালির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্থ ও আতঙ্কগ্রস্থ বাঙালি দলে দলে উদ্বাস্তু হয়ে ত্রিপুরায় এলে মহারাজা তাদেরও গ্রহণ ও আশ্রয় দান করেন৷ বাঙালীদের প্রতি ত্রিপুরার মহারাজাদের অবদান সম্পর্কে বর্তমানে কতজন জানে ও তাদের অবদান কি অস্বীকার করা যায়?
এটাতো ঠিক ত্রিপুরার ইতিহাস কতজন জানে? তবে মহারাজাদের অবদান কেউ বা কোন বাঙালী অস্বীকার করে না করতে পারে না৷ বাঙালী বিজ্ঞানী আচার্য্য জগদীশ চন্দ্র বসুর ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ গড়ার জন্য ত্রিপুরার রাজার অবদান সবাই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে৷ বাঙালী কবি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রথম ‘‘ ভারত ভাস্বর’’ উপাধিতে সম্মানিত করেন ত্রিপুরার রাজাই৷ পরে তিনি ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়ে বিশ্বকবি হন৷
রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরার জন্য কম করেননি৷ তিনি নীরমহল, উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদ, মালঞ্চ নিবাস ইত্যাদির নামাকরণ করেন৷ ত্রিপুরার রাজবাড়ীর ইতিহাস নিয়ে মুকুট, রাজর্ষি, বিসর্জন ইত্যাদি নাটক ও উপন্যাস লিখে ত্রিপুরাকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেন৷ তাঁর ‘‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না’’ সঙ্গীতটিও ত্রিপুরায় বসেই লেখা৷ তাঁর লেখা ‘‘ভগ্ণ-হৃদয়’’ কাব্য পড়ে মহারাজ বীরচন্দ্র উৎসাহিত হন ও কবিকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন৷
মাননীয় শম্ভু দেববর্মা কিছু জনগণনার পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন৷ তাতে সব ক্ষেত্রে হিন্দু বাঙালীদের সংখ্যা দেখাননি৷ কথা হচ্ছে জনজাতি ST) ও অন্যান্যদের সম্পর্কে৷ কারণ জেলাপরিষদ, ষষ্ঠ তপশীল ইত্যাদি তো জনজাতি (বাST) দের জন্যে ৷ ধর্মমতের ভিত্তিতে জনসংখ্যার বিভাজন আলোচ্য বিষয় নয়৷ সে সময়কার ত্রিপুরার মুসলমানরা ও তো বাঙালী৷ মণিপুরীরা জনজাতি নয় (বাST নয়)৷ তাহলে প্রকৃত হিসাবে দেখবেন ত্রিপুরায় সর্বকালে Non ST -রা বিশেষতঃ বাঙালীদেরই মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশী বা সংখ্যাগরিষ্ঠ৷ ত্রিপুরায় এমনও অনেক বাঙালী বসতি আছে যা আগেও ত্রিপুরা বা ভারতে ছিল আজও আছে৷ যথা- ১) শেখেরকোর্টের পশ্চিমে কুলতলী, গাবতলা, রায়ের মুড়া ইত্যাদি৷
২) ত্রিপুরা বাঙালীর অঞ্চলের ৯০ শতাংশ পোর্টের মধ্যে৷ তাই এখানে বাঙালীদের বসবাস সুপ্রাচীন৷ এখনকার মতো আগে কাঁটা তারের বেড়া ছিল না৷ ত্রিপুরা যখন একটি জেলা ছিল তখনকার ১০টি মহকুমা সদরে বাঙালীদের রায় অতিপুরানো৷
৩) চাকলা রোশনাবাদ ছিল ত্রিপুরার রাজার জমিদারী৷ সেখানকার রাজস্ব (কর) দাতা বাঙালীরা প্রয়োজনে ত্রিপুরায় এসে বসবাস শুরু করে৷
এবারে শ্রীদেববর্মা মহাশয়ের কিছু বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ণ জাগে৷ যথা---
১)ত্রিপুরার উপজাতিরা/ জনজাতিরা ৫ হাজার বছর ধরে ত্রিপুরায় বাস করছে৷ যদি তা সত্য হয় তবে প্রশ্ণ--- এ সময়ে ও তারা কেন জাতিতে উন্নিত হতে পারল না? ত্রিপুরার উপজাতিরা মোট ১৯টি গোষ্ঠী৷ তাদের মধ্যে সাঁওতাল মুন্ডা--- ওঁরা ও ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড ইত্যাদি স্থান থেকে এসেছে চা- বাগান নির্মান কাজ, ইটভাটা ইত্যাদির শ্রমিক হিসাবে৷ তাও বীরচন্দ্র মাণিক্যের সময় ত্রিপুরায় যখন আধুনিকতার সূচনা হয়৷ তাও দেড়শত বছরের বেশী নয়৷ পাশ্ববর্তী রাজ্য থেকে যেমন--- সিকিম থেকে লেপচা, ভুটান থেকে ভুটিয়া, মেঘালয় থেকে খাসিয়া, মিজোরাম থেকে লুসাইরা ত্রিপুরা আসে৷ সেও ১০০/১৫০ বছরের বেশী হবে না৷ পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আসে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চাকমা, মগরা৷ কুমিল্লার লালমাই পাহাড় এলাকা থেকে আসে নোয়াতিয়া ইত্যাদি আর শ্রীহট্টের চা বাগান বা পাহাড় অঞ্চল থেকে আসে গারো প্রভৃতিরা৷ আর রইল বাকী কক-বরক ভাষী ত্রিপুরী, জমাতিয়া, রিয়ারা৷ তবে তাদের মধ্যে ভাষা, উচ্চারণ শৈলী, গোষ্ঠীগত কৃষ্টিতে কমবেশী প্রভেদ রয়েছে৷ শোণা যায় এরা ৫৫০ বৎসর আগে ব্রহ্মদেশের (অধুনা মায়ানমারের) আরাকান, শান ইত্যাদি অঞ্চল থেকে জিবীকা ও খাদ্যের জন্য ত্রিপুরায় আসে৷ ওদের রাজাদের গতিপথ ছিল বিলোনীয়ার রাজনগর, উদয়পুরের রাঙ্গামাটি, অমরপুর খয়েরপুর ও শেষে আগরতলা৷
ত্রিপুরার ইতিহাসের উপাদান বলতে ১৪৬৪ সালের রত্ন মাণিক্যের আমলের একটি মুদ্রা পাওয়া যায়৷ ১৫০১ সালে ধন্যমাণিক্য রাঙামাটি বর্তমান উদয়পুরে ত্রিপুরেশ্বরীর মন্দির নির্মান করেন৷
কিন্তু উনকোটির শিলা মূর্ত্তিগুলি ও পিলাকের দেবদেবীর মূর্ত্তিগুলি ত্রিপুরার রাজারা তৈরী করেন এমন কোন প্রমান পাওয়া যায় না৷ মহারাজা ধর্মমাণিক্যের (১৪৩১-৬২) সময় রচয়িতা/ সংকলক/ সম্পাদক দুর্লভেন্দ্র শুক্রশ্বর ও বানেশ্বরদের দিয়ে ‘‘রাজমালা’’ প্রথমখণ্ড রচনা করান৷ তাই পঞ্চদশ শতকের আগের ত্রিপুরার ইতিহাস কিংবদন্তির আড়ালে৷ কিংবদন্তি কোন ইতিহাস হতে পারে না৷
তবে দুঃখের বিষয় ত্রিপুরার ইতিহাস বিকৃত হতে শুরু করে ১৯৭৮ সাল অর্থাৎ কম্যুনিষ্টদের রাজত্ব থেকে৷ ভারতে আভ্যন্তরী জরুরী অবস্থায় বাড়াবাড়িতে এন্টি কংগ্রেস সেন্টিমেন্টে ১৯৭৮ সালে ত্রিপুরা বিধানসভায় ৫৬টি আসন নিয়ে কম্যুনিষ্টরা ক্ষমতায় আসে৷ আর বাকী চারটি পায় যুবসমিতি৷ কম্যুনিষ্টদের মনে ১৯৪৯-৫১ সালের ‘বাঙলা খেদা’ আন্দোলনের কথা মনে পড়ে৷ কম্যুনিষ্টমুক্তাঞ্চল গড়ার’’ এইতো সময়৷ মুখে শ্লোগান ছিল৷ ‘‘গরীবের বন্ধু সরকার৷’’ ত্রিপুরার আপামর জনগণ সহজ সরল মন নিয়ে ওদের বিশ্বাস করে৷ ওরা বাঙালীদের শোষক আখ্যা দিয়ে সরকারী পেট্রোল ডিজেল পুড়ে এন্টি বেঙ্গলী জনমত গড়তে থাকে৷ আর উপজাতিদের সরল মনকে নানা আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে ‘বাঙালী বিরোধী’ করতে থাকে৷ গঠন করে ৭ম তপশীল অনুযায়ী উপজাতি জেলা পরিষদ, তারপর ১৯৮০ সালের গণহত্যা৷ তার উপর কংগ্রেস সংবিধান সংশোধন করে ৬ষ্ঠ তপশীল প্রয়োগ করে মিশ্র বসতি ত্রিপুরায়৷ একটা স্থায়ী বিভেদ অবিশ্বাসের প্রাচীর গড়ে তোলে৷ তাই ত্রিপুরার চরম সর্বনাশের জন্য দায়ী কম্যুনিষ্টরা৷ তাই তো দীর্ঘ ৩৫/৪০ বছরের এন্টিকম্যুনিষ্ট সেন্টিমেন্টে ২০১৮ সালে বিজেপি-আই.পি.এফ.টি জোট ৪৬টি আসনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় বসে৷
১৯৪৯ সালে ত্রিপুরা ভারতে যোগ দেবার সময় মাত্র ১০৯ কিমি পাকা রাস্তা ছিল৷ তার আগে ত্রিপুরার রাজা আগরতলা থেকে উদয়পুর যেতে হলে--- আগরতলা থেকে আখাউড়া রেল ষ্টেশন৷ রেলে কুমিল্লা গিয়ে গোমতী নদী দিয়ে নৌকায় উদয়পুর যেতেন৷ সে ত্রিপুরা ১৯৫২-৫৭ পঞ্চবাষির্কী পরিকল্পনায় আগরতলা-ধর্মনগর (আসাম-আগরতলা রোড) ও দক্ষিণদিকে আগরতলা থেকে সাব্রুম রোড তৈরী হয়৷ তারপর ১০টি মহকুমা সদরকে ওই দুই রাজপথের সাথে যুক্ত করা হয়৷ উত্তরদিকে তেলিয়ামুড়া, আমবাসা, মনু, কুমারঘাট পেঁচারথল, পানিসাগর ইত্যাদি সমৃদ্ধ বাজারগুলি গড়ে উঠে৷ আর দক্ষিণে বিশ্রামগঞ্জ, শান্তির বাজার ইত্যাদি বাজারগুলিও সৃষ্টি হয়৷ যাদের অনেকগুলি আজ শহরে পরিণত হয়েছে৷ ১৯৫২-৭৭ এই ২৫বছরে মিশ্রবসতির ত্রিপুরা বাহ্যিক ও আন্তরিকভাবে অনেকটা এগিয়ে যাচ্ছিল৷ কিন্তু কম্যুনিষ্টরা রাজনৈতিক আষাঢ়ে গল্পে ১৯৭৮-২০১৮ এই ৪০ বছরে বাহ্যিক প্রগতি অবিশ্বাস্যের প্রাচীর খাড়া হয়ে গেছে৷ দায়ী কে? দায়ী সি.পি.এম অর্থাৎ কম্যুনিষ্টরা৷
ছোট এ প্রতিবেদনে বিশেষ বলার সুযোগ কম৷ তবুও একান্ত নিজের অভিজ্ঞতায় ত্রিপুরার সরল প্রাণ উপজাতিদের আতিথিয়তার কিছু ব্যষ্টিগত প্রমাণ দিতে চাই৷ ১৯৬৫ সালে সদর বি ইন্সেপেক্টরের অধীন দক্ষিণ পূর্ব সার্কেলের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শকের এক্তিয়ারে আমি শিক্ষকতার চাকুরী পাই৷ অফিসটা ছিল বিশালগড় টাউন জে.বি.স্কুলে৷ আমি বিশালগড় গোলাঘাঁটি টাকার জলা---জমপুইজলা পার হয়ে হেঁটে প্রায় ৪০ কিমি দূরে চাম্পাশর্র্ম জে.বি.স্কুলে এক শিক্ষক বিদ্যালয়ে চেয়ারম্যান শ্রী বুদ্ধিচন্দ্র কলইয়ের কাছ থেকে চার্জ নিয়ে ক্লাশ থ্রী পর্য্যন্ত ১৬জন ছাত্রের শিক্ষক হই৷ এ বিদ্যালয়ের শিক্ষক কাঁকড়াবন বৈসিক ট্রেনিং কলেজে এক বছরের জন্য ট্রেনিংয়ে যান৷ আমি তাঁরই সাবষ্টিটিউট শিক্ষক৷ চাকুরী পাবার তিন মাস পর বেতন পাই৷ এতদিন শ্রী পবিত্র কলইয়ের বাড়ীতে খাই, থাকি৷ তিন মাস পর বেতন পেলে পবিত্র বাবু শুধু চার্ডলের দাম মাত্র ২০ টাকা আমার কাছ থেকে নেন৷
গ্রামের লোকেরা আমার জন্য ঘর তুলে দেয়, চৌকি, বালিশ, ডেক কড়াইয়ের ব্যবস্থাও করে দেন৷ শুনা যায় এক শিক্ষক স্কুলের শিক্ষকরা মাপে তিনদিন স্কুলে যায় আর ২৭ দিন বাড়ীতে থাকে৷ আমি অফিসের কাজ বেতন তোলা ও বাড়ীতে বাজার হাট করে দেওয়া নিয়ে তিন দিন স্কুল বন্ধ বা ষ্টেশন লিভ্ করতাম আর বাকী ২৭ দিন স্কুল করতাম ও ষ্টেশনে থাকতাম৷
ছাত্রদের সাথে বিকালে খেলাধূলা, শরীরচর্চা করতাম৷ যখন আমি বদলী হই--- ছাত্র/ছাত্রারা কেউ একঘটি দুধ, কেউ একটা পাকা পেঁপে, কেউ ৮/১০ টা পাকা সবরী কলা ইত্যাদি আমার জন্য নিয়ে এলো আনন্দে আমার চোখে জল আসার ব্যাপার ৷ আমি কি করব এসব নিয়ে৷ প্রত্যেকের আনা আদরের শ্রদ্ধার জিনিষটা আমি গ্রহণ করি ও একের জিনিস অন্যকে দিয়ে দিই৷ আর গ্রামবাসী ব্যাণ্ড পার্টি বাজিয়ে অনেকটাই এগিয়ে দেয়৷ ৫ কিমি দূরে দারকাইছড়া স্কুলে ২ জন গ্রামবাসী আমার লাগেজসহ আমাকে পৌঁছিয়ে দেয়৷ জানিনা এমন বিদায় সম্বর্ধনা অন্য কেউ পেয়েছে কি না?
১৯৬৬ সালে দারকাইছড়া জেবিস্কুলে ছাত্র/ছাত্রা জনা চল্লিশেক৷ ক্লাসফাইভ পর্য্যন্ত৷ থাকতাম শ্রী শুকরাম দেববর্মা বাড়ী৷ তিনি আমাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মত দেখতেন৷ এটাও ছিল সিঙ্গল টিচার স্কুল৷ তাঁদের আতেথিয়তার কথা আজও ভুলতে পারিনা৷
এবছরেরই শেষের দিকে তেলিয়ামুড়া ব্রহ্মছড়া নিভু বিদ্যালয়ে বদলী হয়ে আমি ক্লাশ ওয়ান থেকে ক্লাশ ফাইভ পর্য্যন্ত ১৪০ জনের উপর ছাত্র৷ মিশ্র বসতি এলাকা৷ ওই সিঙ্গল টিচার স্কুল৷ আমার বাড়ী থেকে ৫ কিমি দূরে পায়ে হেঁটে গিয়ে একদিন সকালে পথে বাঘ দেখতে পাই৷ তারপর স্কুলটাকে দুপুরে করে নিই৷ সেখানকার ছাত্ররা এখন ঠাকুর দাদা হয়ে গেছে৷ তবুও ওরা দেখা হলে পায়ে পড়ে নমস্কার করে৷ আদর করে বলে স্যার! কেমন আছেন? এরপর একটা দ্বাদশশ্রেণী বিদ্যালয়ে বদলী হয়ে যাই৷ সেখান থেকে অবসর গ্রহণ করি৷
আমার শিক্ষক জীবনের স্কুলগুলিতে গিয়ে সমীক্ষা করা যেতে পারে৷ আমি একজন মানবতাবাদী মানুষ৷ আমার কাছে হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান সবাই সমান৷ সকলেই দেবশিশু (Divine Child) আমার লেখাগুলোতে কোথাও উপজাতি সাধারণের বিরুদ্ধে নেই৷ বরং কম্যুনিষ্ট নেতাদের বানানো আইন কংগ্রেসের, বিজেপি নেতাদের আইনী পদক্ষেপ নিয়েই আমার সব বক্তব্য৷ চলুন, ত্রিপুরার সকলের স্বার্থে ১৯৭৭ সনের আগের পরিবেশ আমরা ত্রিপুরার ফিরিয়ে আনি৷ তাতে সবার কল্যাণ হবে৷ নইলে, ওই পুরানে কথা গাঁয়ে আগুন লাগলে দেবালয় ও বাঁচবে না৷
ত্রিপুরার আসল সমস্যা অর্থনৈতিক৷ সমস্যা কর্মসংস্থান, ক্রয়ক্ষমতা ও সকলের পারিবারিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য৷ এখানে কার কি ধর্মীয় মতবাদের কে কোন রক্তের, কোন ভাষার--- এটা বিষয় নয়৷ মিলন---মিশ্রণের মাধ্যমে রক্তের সংমিশ্রন ঘটে৷ তাতে উন্নত দেহ, উন্নত মন (বুদ্ধি) সম্পন্ন মানুষ তৈরী হয়৷ তাতেই সমাজের সকলের কল্যাণ হবে৷ সুখী সমৃদ্ধ ত্রিপুরা গড়ে উঠবে৷ আর কি?
- Log in to post comments