অংশুমালী ৰাগচী সৰে মাত্র ডাক্তারি পাস করেছে৷ ডিস্পেনসারি খুলেছে বগুড়ায়, পসার (প্রসার ঞ্ছ পসারঃ পসরা (ঝুড়ি), পসারী, পসারিণী৷
‘‘হিসাব–নিকাশ সারিয়া পসারী, / যে যার চলেছে ওই সারি সারি’’৷
পসারিণী হেঁকে যায়–‘‘শাক নেবে শাক?’’
‘‘আজ প্রেমের পসরা নিজ শিরে লয়ে প্রাণের ঠাকুর এসেছে৷’’) তখনো তেমন জমেনি৷ চিকিৎসার চেয়েও পুরাতত্ত্বে ব্জন্তুড়্ত্রন্দ্বপ্সপ্ত তার ঝোঁক ৰেশী৷ প্রায়ই সে চলে যেত ৰাঙলার প্রাচীন রাজধানী মহাস্থানে যার অবস্থিতি বগুড়া থেকে ৰেশী দূরে নয়৷ মহাস্থানে কিছু পাথর, কিছু নুড়ি, কিছু ইট–পাটকেল পরীক্ষা করে করতোয়া নদীর তীর ধরে খানিক বেড়িয়ে আসত৷ নদীতীর ধরে যেতে যেতে এমনই একটা প্রত্যন্ত সীমায় সে পৌঁছত যেখানে আছে প্রকাণ্ড একটা তেঁতুলগাছ৷ তার নীচে সিঁদুর–মাখানো কতকগুলো নুড়ি ওই জায়গাটায় এসে মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অস্বস্তি ৰোধ করত৷ তারপর আর এগোত না৷
গ্রামের লোকেদের জিজ্ঞেস করত–ওই তেঁতুলগাছের তলায় গিয়ে তার কেমন যেন লাগে৷ ব্যাপারটা কী
এককালে ৰাঙলায়–বিশেষ করে উত্তর ৰাঙলায় কালচক্রযান নামে এক ৰৌদ্ধতন্ত্রের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল৷ সেকালে মানুষ ধরে (১৬ থেকে ৩০ বছরের ছেলে ছিল তাদের লক্ষ্য) ৰলি দেওয়া হত কালভৈরবীর বেদীর সামনে ৷ কাউকে যদি এক কোপে কাটা না যেত তবে তার ডান দিকের হাতটা বা ডান দিকের পা–টা কেটে দেওয়া হত৷ এখন আর কালচক্রযান নেই৷ শুনে অংশুমালীর খুবই খারাপ লাগল৷ সে ওই দিকটায় যাওয়াই ছেড়ে দিল৷ কিন্তু অংশুমালীর পুরাতত্ত্বে দারুণ আগ্রহ৷ একদিন আলো থাকতে থাকতে সে তেঁতুল গাছের চারিদিক একবার ঘুরে দেখলে কালভৈরবী মন্দিরের ভগ্ণাবশেষ আছে কি না তারই খোঁজে৷ নাঃ, কোনো চিহ্ণ পাওয়া গেল না৷ তবে ফেরবার সময় সে পেল একটা মানুষের হাত৷ হাতটা কাটা হয়েছে অনুমানিক একশ’ বছর আগে৷ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় তা পচে গলে যায়নি–শুকিয়ে চিমড়ে চিমসে হয়ে গেছে৷ কোন্টা ডান হাত আর কোন্টা বাঁ হাত চেনবার সোজা উপায় হচ্ছে হাতের তালুর দিক দিয়ে যদি দেখা যায় ডানহাতের পাঁচটা আঙ্গুল (বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ, তর্জনী, মধ্যমা, অনামিকা ও কনিষ্ঠা সাজানো থাকে ঘড়ির কাঁটার গতির উল্টো পথে •counter clock wise—৷ ঠিক তেমনি বাঁ হাতের তালুর দিক দিয়ে দেখতে গেলে আঙ্গুলগুলো সাজানো থাকে ঘড়ির কাঁটার চলার হিসেবে (Clock wise)৷
পুরাতত্ত্ববিদ্ হলেও সে তো ডাক্তার৷ হাতটা সে নিয়ে এল, সযত্নে রেখে দিল তার ডিস্পেন্সারীতে৷ গ্রামের লোকে ৰলেছিল যারা কালভৈরবীকে সম্মান জানায় না তারা ওই তেঁতুল গাছের কাছে গেলে বিপদে পড়ে, মরেও যেতে পারে৷ এমনকি যেসব ভূত–প্রেত–দানাদত্যি কালভৈরবীকে মানে না তারাও যায় না৷ যারা মানে কেবল তারাই যায়৷ অংশুমালীর পক্ষে কালভৈরবীকে মানা না মানার কোন প্রশ্ণই নেই৷ কালভৈরবী তার কাছে প্রাচীন ৰাঙলার একজন ঐতিহাসিক ৰৌদ্ধতান্ত্রিক দেবী৷
হ্যাঁ ৰলছিলুম অংশুমালীর প্রসার তখনও তেমন জমেনি৷ সকালের দিকে দু–তিনজন রোগী, সন্ধেও দু–একজন রোগী ব্যস৷ এদিকে ডিস্পেন্সারীর ঠাঁটৰাট বজায় রাখতে প্রাণান্ত....ঢ়াকের দায়ে মনসা ৰিকোয়৷ সন্ধের একটু পরেই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত৷ মাঝরাত্রিরে একবার ঘুম একটু পাতলা হত বা ঘুম ভেঙ্গেও যেত৷ তার পরে আসত আর একটা ঘুম৷
সেদিনও মাঝরাত্রিতে অংশুমালীর ঘুম ভেঙ্গে গেল৷ ঘড়িতে দেখে আড়াইটে৷ তার মনে হ’ল যে ঘরে আর কেউ একজন রয়েছে৷ অংশুমালীর আলো নিবিয়ে শোয়ারই অভ্যাস৷ তাই অন্ধকার ঘরে সে আর কাউকে দেখতে পেল না৷ খানিকক্ষণ ঠাহর করার পরে তার মনে হ’ল তার পা থেকে ৭/৮ হাত দূরে ২২/২৩ বছরের একটি ছেলে৷ সেটি একটি ছায়ামূর্ত্তি৷ অন্ধকার ঘরের কৃষ্ণত্বের চেয়েও ওই ছায়ামূর্ত্তির কৃষ্ণত্ব ছিল ৰেশী গাঢ়৷ তাই তাকে অস্পষ্টভাবে দেখতে পেল৷ অংশুমালী ছায়ামূর্ত্তির দিকে খানিকক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকাল৷ এবার ভালো করে একবার চোখদুটো রগড়ে নিল৷ নাঃ, একটি অতিকৃষ্ণ ছায়ামূর্ত্তি–এতে কোন সন্দেহই নেই৷ ছায়ামূর্ত্তি নির্বাক৷ তবে সে হাত বাড়িয়ে ডিস্পেন্সারীর একটি আলমারীর দিকে কী যেন দেখাচ্ছে৷ খানিকক্ষণ এই রকম দেখার পরে অংশুমালীর চোখে ঘুমের আস্তরণ নেৰে এল৷ তারপরে রাতে অংশুমালী ঠিক করেছিল আজ আড়াইটের সময় সে নিশ্চয়ই জেগে থাকৰে৷
ঘড়িতে আড়াইটে আবার সেই ছায়ামূর্ত্তি৷ মূর্ত্তিটা আবার আলমারীর দিকে হাত বাড়িয়েছে৷ অংশুমালী অপলক দৃষ্টিতে তাকে দেখে চলেছে৷ একবার ভাৰলে তাকে সে জিজ্ঞেস করে কেন সে এসেছে, কিসের জন্যে৷ আবার ভাৰলে, ছায়ামূর্ত্তি কী কথা ৰলে? জিজ্ঞেস করাই বৃথা৷ আর একবার ভাৰলে তাকে ধরে একটু নাড়া দিয়ে ৰলে–কী তোমার মতলব বলো৷ আবার ভাৰলে তাকেই বা কেন বিরক্ত করব৷ সে তো আমাকে বিরক্ত করছে না৷ এই ধরনের ঘটনা চলতে থাকল রাতের পর রাত৷ অংশুমালীর জীবনের সঙ্গে রাত আড়াইটে যেন এক সূত্রে গাঁথা হয়ে গেল৷
এৰার অংশুমালী ঠিক করলে জিনিসটা যেন ভাল হচ্ছে না৷ আজ এর একটা হেস্তনেস্ত করতে হৰে...একটা এসপার ওসপার করতে হৰে৷ সে ঠিক করলে ছায়ামূর্ত্তি যতক্ষণ থাকৰে সে কিছুতেই ঘুমোৰে না৷ শুয়েই সে রইল, কারণ উঠে বসলে যদি ছায়ামূর্ত্তি ভয় পেয়ে না আসে
রাত আড়াইটেয় নীরব চরণে ছায়ামূর্ত্তি এল, নিজের জায়গাটিতে এসে দাঁড়াল, আলমারীর দিকে হাত দেখাল৷
অংশুমালী জেগেই আছে...জেগেই আছে৷
খানিকক্ষণ ওইভাবেই থেকে ছায়ামূর্ত্তি বেরিয়ে গেল খোলা জানালার দিকে৷ অংশুমালীও দরজা খুলে কিছুটা দূরত্বে ব্যবধান রেখে ছায়ার অনুসরণ করতে লাগল৷ ছায়ামূর্ত্তি সোজাই চলছে....পিছনে তাকাচ্ছে না৷ অংশুমালীও ছায়ামূর্ত্তিকে দেখছে৷ ডান পাশে বাঁ পাশে, পিছনে তাকাচ্ছে না৷ ছায়ামূর্ত্তি এসে শেষ পর্যন্ত বগুড়ার সৰচেয়ে পুরোনো গোরস্থানটিতে পৌঁছাল ও একটা ভাঙ্গা কবরের কাছে এসে কোথায় যেন হারিয়ে গেল৷
অংশুমালী ঘরে ফিরল৷ তারপরের রাতে অংশুমালী আর আড়াইটে পর্যন্ত অপেক্ষা করল না৷ সে রাত ১০টার পরেই আলমারী থেকে সেই শুকনো ডান হাতটাকে নিয়ে চলল সেই সাবেকি গোরস্থানের দিকে, সেই ভাঙ্গা কবরটার দিকে৷ ওই কাটা হাতটা কবরের ওপর রেখে সে ফিরছে৷ এমন সময় কবরের নীচের থেকে বেরিয়ে এল একটা অট্টহাসি... হাঃ হাঃ হাঃ
অংশুমালী ঘরে ফিরল৷ রাত আড়াইটেয় অংশুমালীর ঘুম ভাঙ্গল৷ নাঃ, আজ আর সেই ছায়ামূর্ত্তি নেই৷ হ্যাঁ, যখন সে ছায়ার পেছনে ধাওয়া করেছিল গোরস্থানের দিকে তখন সে দেখেছিল ছায়ামূর্ত্তির বাঁ হাত নড়ছে, ডান হাত নড়ছে না৷ কেন সে জানে না৷
পরের দিন ৰেলা ৰাড়তে না বাড়তেই এই ছায়ামূর্ত্তির গল্প বগুড়া শহৰে ছড়িয়ে পড়ল৷ এর কোনো ভাল দিক থাক বা না থাক, একটা খারাপ দিক হল এই যে ওই ছায়ামূর্ত্তির গল্প শুনে রোগীরা অংশুমালীর ডিস্পেন্সারীর ত্রিসীমানায় আর আসত না৷ বাধ্য হয়ে অংশুমালী বগুড়া থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে নীলফামারীতে গেল...নূতন করে চিকিৎসা ব্যবসা শুরু করতে হ’ল৷ শব্দ–চয়নিকা ২৪/১১৭