দেশের কিছু বুদ্ধিজীবী এবার সরব হয়েছেন৷ তারই প্রমাণ পাওয়া গেল দুটি চিঠির মাধ্যমে৷ একটি চিঠি দেওয়া হয় দেশের প্রধানমন্ত্রীকে৷ যার শিরোণাম---‘রাম ভজনার জেরে দেশে অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ তৈরী হয়েছে৷’ ৪৯ জন বুদ্ধিজীবীর স্বাক্ষর করা এই চিঠি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়৷ এই চিঠির প্রত্যুত্তর দিতে আর একটি খোলা চিঠি প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়৷ এতে স্বাক্ষর ছিল ৬১ জন বুদ্ধিজীবীর৷ গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকগণ যে কোন বিষয়ে তাদের মতামত দিতেই পারেন৷ এ ব্যাপারে বুদ্ধিজীবীদেরই এগিয়ে আসতে হয়৷ সাধারণ মানুষ বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাতেই পরিস্থিতিটা বুঝতে চেষ্টা করে৷ কিন্তু এখানে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাতেই জনগণ বিভ্রান্ত৷ কারণ বুদ্ধিজীবীরা স্পষ্টতঃ দুটো শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন৷
বিবাদের কারণ সেই রাম৷ একটা কথা মনে আসে তা হল মহাত্মাজী রামধুন গাইতেন৷ আজ একদল উশৃঙ্খল মানুষ ‘জয়শ্রীরাম’ ধবনি দিচ্ছেন৷ শুধু তাই নয়, অন্যকেও সেই ধবনি দিতে বাধ্য করা হচ্ছে, অন্যথায় তাদের ওপর নানাভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে৷ এতে জনগণের মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে৷ কেউই এটা ভালভাবে নিচ্ছে, কেউ সহ্য করছে না৷ কেউবা নিছক মজা লুটছে৷ সবটাই জনগণের মানসিকতার ব্যাপার৷ তবে রাম নাম নিয়ে ভিন্ন সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন করাটা খুবই দুঃখের বিষয়৷ প্রশাসনের দায়িত্ব দেশের শান্তি বজায় রাখা৷ কিন্তু প্রশাসনের মাথার ওপর যাঁরা থাকেন তাঁরা তো দলেরই নির্বাচিত৷ তাই দলের ঊধের্ব উঠে নিরপেক্ষ ভূমিকা নিতে খুব কমই দেখা যায়৷ কারণ আমাদের দেশে দলবাজীটাই রাজনীতির নীতি হয়ে গেছে৷ গণতন্ত্রের নামে দেশটাকে নোংরা দলতন্ত্র গ্রাস করেছে৷ ক্ষুদ্র পরিবার থেকে বৃহৎ সমাজ সর্বক্ষেত্রেই দলীয় স্বার্থটাই আগে দেখা হয়৷ এর কুফল জনগণকেই ভোগ করতে হয়৷ তাই নির্বাচনে বোমাবাজী, দলবাজী অবাধে চলে, নিরীহ মানুষ খুন হয়, পুলিশও অনেক সময় অসহায়ের মত মার খায়৷ জনগণকে অশিক্ষার অন্ধকারে রেখে রাজনীতির এই মস্তানী চলছে৷ কারণ জনগণের গণতন্ত্র সম্পর্কে কোন স্বচ্ছ ধারণাই নেই৷ সত্যিটা হ’ল ৭২ বছরেও দেশের রাজনৈতিক নেতারা জনগণকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন করার কোন পদক্ষেপই নেয়নি৷ অনেকটা ইচ্ছা করেই এটা করা হয়েছে৷ কারণ আজ গণতন্ত্রের নামে যে দলবাজীটা চলছে রাজনীতির নামে যে দুর্নীতি দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে, জনসেবার নামে নেতা-মন্ত্রীরা যে নিজেদের আখের গোছাচ্ছে, তা সম্ভব হচ্ছে জনগণের চেতনার অভাব বলেই৷
সংবিধানে বলাই আছে ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র৷ প্রত্যেকেই নিজের ধর্ম বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে তার ধর্মাচরণ করবেন৷ জোর করে কাউকে এ ব্যাপরে চাপ দিয়ে কিছু করানো যাবে না৷ এটাই দেশেরআইন৷ কিন্তু জনগণ যেমন দেশের সংবিধান সম্পর্কে অজ্ঞ, নেতা-মন্ত্রীরাও তেমনি আইনের ধার ধারে না৷ অর্থ ও দলীয় ক্ষমতার জোরে যা মনে আসে তাই করে যায়৷ এই গা-জোয়ারীর রাজনীতি আজ ভারতবর্ষে চলছে৷ বুদ্ধিমান-বুদ্ধিজীবীদেরও এ ব্যাপারে শুভবুদ্ধির অভাব৷ তাঁরাও দলীয় মর্জিমত চলেন৷ তাই দেশের এই দুঃসময়ে তাঁদের মধ্যেও বিভাজন৷ সেই কারণে ৪৯ জন বুদ্ধিজীবীর স্বাক্ষর সম্বলিত পত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছলে তার পাল্টা ৬১ জনের আর একটা পত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে পৌঁছায়৷ এখানে কারা ঠিক, কারা ভুল---সাধারণ নাগরিক বিভ্রান্ত৷ অর্থাৎ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও দলবাজী, তবে একটু ভদ্র চেহারায়৷ সাধারণ রাজনীতিকদের মত নয়৷ এতে বিতর্কই তৈরী হয়, সমস্যার সমাধানের কোনও পথ বের হয় না৷ সাধারণ রাজনীতিকদের মত বুদ্ধিজীবীরাও ব্যষ্টি ও দলীয় স্বার্থকেই বড় করে দেখে৷ তাই দেশের এই সমূহ বিপদের সময় দল ও রাজনীতির ঊধের্ব উঠে দেশের বৃহত্তম স্বার্থে ১১০ জন বুদ্ধিজীবী ঐক্যবদ্ধ হতে পারলেন না৷
আজ দেশের বড় প্রয়োজন প্রকৃত দেশসেবক, সত্যাশ্রয়ী, কঠোর নীতিবাদে প্রতিষ্ঠিত দেশনেতা৷ যাঁরা ব্যষ্টিস্বার্থ ও দলবাজীর ঊধের্ব উঠে দেশকে ধবংসের হাত থেকে বাঁচাবে৷ আজ দেশের আর্থিক-সামাজিক অবস্থা খুবই করুণ৷ চরম দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকার সমস্যায় দেশ কাতর৷ আইন-শৃঙ্খলা বলতে কিছুই নেই৷ শুধু অকারণ হৈ-চৈ আর হুজুগে মাতিয়ে জনগণকে নেতা-মন্ত্রী-বুদ্ধিজীবীরা নিজের নিজের আখের গুছিয়ে চলছে৷
দেশের এই দুর্দিনে বুদ্ধিজীবীদের অন্ততঃ নীতিবাদে প্রতিষ্ঠিত হয়ে, ঐক্যবদ্ধ ভাবে দেশের কল্যাণে কাজ করা উচিত ছিল৷ তাতে জনগণ অন্ততঃ একটা দাঁড়াবার জায়গা পেত৷ আজ গণতন্ত্রের এই চরমসংকটে দেশ যখন ধবংসের পথে তখন দেশের বৃহত্তম স্বার্থে বুদ্ধিজীবীরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারলেন না৷ দেশের এই সংকটে বুদ্ধিজীবীদের যে ভূমিকা নেওয়া উচিত ছিল সেটা তাঁরা নিতে পারলেন না৷ দুঃখের বিষয় চিরকাল এই বুদ্ধিজীবীরা সকল সমস্যা পাশ কাটিয়েই চলেছেন৷ তাঁদের বুদ্ধির দৌড়ও দলতন্ত্রকে অতিক্রম করতে পারল না৷ তাই বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ বিশেষ দলের পক্ষ নিয়ে এই বুদ্ধির লড়াই এখনই বন্ধ হওয়া উচিত৷ কারণ এতে দলবাজীটাই বাড়ছে, সাধারণ মানুষের কোনও কল্যাণ এতে নেই৷
- Log in to post comments