ধর্ম ও ধর্মমত

প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা  মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার (যিনি ধর্মগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী রূপে সমধিক পরিচিত) সুস্পষ্টভাবে বলেছেন---ধর্ম ও রিলিজিয়ন সমার্থক নয়৷ রিলিজিয়নের আরবিক প্রতিশব্দ মজহব৷ কিন্তু ধর্মের প্রতিশব্দ ইমান৷ ধর্ম মানুষকে যুগে যুগে ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করার বাণী প্রচার করেছে৷ ধর্মমত (রিলিজিয়ন) যেখানে সংখ্যায় অনেক, ধর্ম সেখানে মাত্র একটি---মানুষের অসীমকে পাওয়ার এষণা৷ ধর্ম বৈবহারিক জ্ঞান ও যুক্তিসিদ্ধ বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত৷ এতে রয়েছে পারমার্থিক সত্যোপলব্ধির যুক্তিসঙ্গত প্রচেষ্টা৷ তথাকথিত ধর্মমত বা রিলিজিয়নগত সঙ্কীর্ণতা, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস তথা ডগমা বর্তমানে রাজনীতির ক্ষেত্রে ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানান সমস্যার জন্ম দিচ্ছে৷ এই ধরণের সংকীর্ণ ধর্মবিশ্বাস মানুষে মানুষে, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে সংঘর্ষ বাধাচ্ছে৷ এই সবকে কেন্দ্র করে দেশে বিদেশে বহু রক্তপাতও ঘটেছে, এতে কোন সন্দেহ নেই৷

আজকের তথাকথিত শিক্ষিত মানুষেরাও এই কারণে ধর্মকে এড়িয়ে চলতে চান৷ মানুষের জীবনে ধর্মের প্রয়োজনীয়তাও তারা স্বীকার করেন না৷ কিন্তু তাঁরা ভুলে যান, রিলিজিয়ন বা ধর্মমতগুলি মানুষকে চিন্তা ও অন্ধবিশ্বাসের ফাঁদে জড়ালেও প্রকৃত ধর্ম মানুষের জীবনের ভিত্তি৷ ধর্ম ছাড়া মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ হবে না৷ ধর্মমত বা রিলিজিয়ন অনেক হলেও ধর্ম অনেক নয়---তা পূর্বেও বলা হয়েছে৷ ধর্ম হ’ল অধ্যাত্মবিজ্ঞান যার অনুশীলনের মাধ্যমে মনের বিস্তার ঘটে৷ মনের বিকাশ ঘটে৷ মনের সুউচ্চ অবস্থায় পৌঁছানো যায়৷

আধ্যাত্মিক চেতনার ক্রমবিকাশ মানুষের মনে সেবা ও ত্যাগের ভাবনা বাড়িয়ে তোলে৷ আর তার সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে নৈতিকতার সুদৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করে৷

বর্তমানে সর্বস্তরে ব্যাপক দুর্নীতি তথা নীতিহীনতার কারণেই আজকে কি রাজনীতি, কি অর্থনীতি, কি সংস্কৃতি, সর্বক্ষেত্রেই ভয়াবহ অবক্ষয় ও বিপর্যয় দেখা দিয়েছে৷ তাই আজ যদি সমগ্র সমাজকে কলুষমুক্ত করে সমাজের প্রকৃত উন্নয়ন আনতে হয় তাহলে ন্যায়নীতি ও ধর্মের ভিত্তিতেই মানুষের বৈয়ষ্টিক তথা সমষ্টি জীবনে এক নবজাগরণ আনতে হবে৷

আর এও স্পষ্ট করে বুঝে নিতে হবে, এই ধর্ম সমস্ত মানুষের এক---এখানে কোনও অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ও সঙ্কীর্ণতার স্থান নেই৷ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, শ্রীরবিন্দ, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ মনীষীগণ  এই মানব ধর্মের কথাই বলেছেন৷ যোগসাধনায় মানুষের দেহ, মন ও আত্মার উন্নতিসাধনের কথা বলা হয়৷ এই ন্যায়নীতিও বিজ্ঞানভিত্তিক ধর্মসাধনা, মানুষের মনুষ্যত্বের সুদৃঢ় ভিত্তি৷ এই দৃঢ়ভিত্তির ওপরেই সমাজকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে৷ সংকীর্ণ রিলিজিয়ন বা গোঁড়া ধর্মমতও নয়, আর ধর্মহীনতাও নয়---প্রকৃত ধর্মকে আমাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে সর্বপ্রকার ভেদরহিত আদর্শ সমাজ গড়ে তুলতে হবে ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের প্রতিষ্ঠা করতে হবে৷