এপারেও প্রয়োজন ২১-এর আন্দোলন

লেখক
মনোজ দেব

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী৷ মাতৃভাষার গৌরব প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বিশেষভাবে স্মরণীয় একটা দিন৷ ওই দিন ওপার বাঙলায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অবিস্মরণীয় এক ভাষা আন্দোলনের দিন৷

১৯৪৭ সালে হিন্দু-মুসলমান-এই ঝুটা দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ শাসকের ক্রুর চক্রান্তে তৎকালীন গোঁড়া মুসলীম নেতা জিন্নার অন্যায় জেদের কাছে গান্ধী, নেহেরু প্রভৃতি ভারতবর্ষের কংগ্রেস নেতৃত্ব নতি স্বীকর করে৷ তার পরিণতিতে ভারতবর্ষের বুকে ছুরি চালিয়ে একে দ্বিখণ্ডিত করা হয়৷ ভারতের  পশ্চিমে ও পূর্বে দুই ডানা ছেঁটে তৈরী করা হয় যথাক্রমে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান৷ এই দুই পাকিস্তান ছিল একই পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত৷ রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানের ইসলামাবাদ৷ জিন্না পূর্ব পাকিস্তানের অর্থাৎ অধূনা বাঙলাদেশের মাতৃভাষা বাঙলাকে অবদমিত করে তাদর ওপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেয়৷ শিক্ষা দীক্ষা থেকে শুরু করে সমস্ত সরকারী কাজকর্ম কেবলমাত্র উর্দুতে করতে হবে---এই ফরমান জারী করে৷ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীরা এর প্রতিবাদে গর্জে ওঠে৷ শুরু হয় বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ আন্দোলন৷ ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী পূর্ব বাঙলার ঢাকায় বের হয় বিশাল প্রতিবাদ মিছিল৷ শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশে পুলিশ- মিলিটারী এই মিছিলের ও সমাবেশের ওপর নির্বিচারে লাঠি-গুলি চালায়৷  পুলিশের গুলিতে নিহত হয় রফিক, বরকত, আব্দুল জববার, আবদুস সালাম, সফিউর রহমান, প্রভৃতি প্রতবাদী ছাত্রদের তাজা প্রাণ৷ ইসলামাবাদের শাসক গোষ্ঠীর দমন-পীড়ন ক্রমে বাড়তে থাকে৷

এই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু হয় পশ্চিম পাকিস্তানের সার্বিক শোষণ ও অত্যাচারের প্রতিবাদে বৃহত্তর আন্দোলন৷ যার পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাঙলাদেশের জন্ম হয়৷ স্বাভাবিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের  রাষ্ট্র ভাষা হয় বাংলা৷ মুজিবর রহমান রাষ্ট্রসংঘেও বাংলা ভাষায় বত্তৃণতা দেন৷ মাতৃভাষা অবদমনের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন যেভাবে এক সর্বাত্মক শোষণমুক্তির আন্দোলনের রূপ নিল ও স্বাধীন বাঙলাদেশের সৃষ্টি করল, তা সারা বিশ্বের কাছে এক নতুন নজির সৃষ্টি করল৷ এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্র সংঘর তরফ থেকে এই ২১শে ফেব্রুয়ারীর দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়৷ পরবর্তীকালে রাষ্ট্রসংঘ স্বীকার করে বাংলা ভাষা সারা পৃথিবীর মধুরতম ভাষা৷ স্বাধীনতা ও দেশভাগের বহু পূর্বে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ লাভ বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে বিশেষ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে৷  নিঃসন্দেহের বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে এটা পরম গৌরবের বিষয়৷

কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের বাঙালীদের কাছে এক চরম অগৌরবের বিষয় হ’ল পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষেরা তাদের নিজ ভূমে মাতৃদুগ্দ সম মাতৃভাষার অধিকার থেকে আজও বঞ্চিত৷ অসমের বাংলা ভাষী এলাকার বাঙালীরা, ঝাড়খণ্ডের বাঙালীরা বিহার ও ওড়িষ্যার বাঙালীরা তো তাদের মাতৃভূমিতে  থেকেও অর্থাৎ সুপ্রাচীন বৃহৎ বাঙলার স্বস্থানে বাস করেও কুটিল রাজনৈতিক চক্রান্তের ফরস্বরূপ স্কুল, কলেজের শিক্ষার ক্ষেত্রে বা সরকারী কাজ-কর্মের ক্ষেত্রে বাঙলা শিক্ষা ব্যবহারের অধিকার সম্পর্ণ হারিয়েছে৷ অসমের বরাক উপত্যকায় ১৯৬১ সালের ১৯শে মে শিক্ষাদীক্ষায় ও সরকারী কাজে মাতৃভাষা বাঙলাকে সরকার কর্তৃক অস্বীকৃতির প্রতিবাদে বাঙালীরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবীতে সেদিন পুলিশের গুলিতে ১১জন নিহত হয়েছিলেন৷ এরপর সরকার অসমের বরাক উপত্যাকায় বাঙালীদের দাবী মানতে বাধ্য হয়েছিল৷

বর্তমানে পশ্চিমবাঙলা ও ত্রিপুরায় প্রধান রাজ্যভাষা হিসেবে বাংলা  স্বীকৃত হলেও অধিকাংশ সরকারী কাজ---এমনকি পঞ্চায়েত স্তরেও, আদালতেও বাংলা ভাষা তার প্রাপ্য মর্যাদা পায়নি৷

মাতৃভাষার প্রতি অবদমন যে কতবড় মারাত্মক ক্ষতিকর, বাঙালী জাতির অগ্রগতির পথে কতবড় অন্তরায় তা প্রাউট প্রবক্তা শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার সুস্পষ্টরূপে ব্যাখ্যা করেছেন কণিকায় প্রাউট ত্রয়োদশ খণ্ডে৷ সেখানে তিনি বলেছেন---

‘‘ভাষা মানুষের অন্তরের ভাবপ্রকাশের শক্তিশালী মাধ্যম৷ এই ভাষা মানুষের প্রাণীন সম্পদ- যা তার প্রাণধর্ম অর্থাৎ  সত্তাগত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সম্পর্কিত৷....নিজস্ব মাতৃভাষায় একজন যেমন স্বচ্ছন্দে ও সাবলীলভাবে নিজের ভাবকে প্রকাশ করতে পারে, তেমনটি অন্য কোন ভাষায় পারে না৷ মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলতে সে অসুবিধা বোধ করে৷ প্রতিনিয়ত যদি অন্য ভাষায় কথা বলিয়ে এরূপ অস্বচ্ছন্দ্য বোধ করাতে তাকে বাধ্য করানো হয় তবে তার প্রাণশক্তি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে---ক্রমশঃ প্রাণশক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে৷ এইরকম পরিস্থিতিতে সেই ব্যষ্টি বা ব্যষ্টিসমূহের মধ্যে এক মনস্তাত্ত্বিক সংকট দেখা দেবে৷ প্রথমেই তার মধ্যে দেখা দেবে এক ধরণের হীনম্মন্যতা বোধ---যা মানুষের মানসিক দুর্বলতার কারণ৷ যাদের ভাষা অবদমিত হবে তাদের নৈতিক সাহস, উদ্যম ও প্রতিবাদ করার শক্তি হারিয়ে যাবে৷ শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে একটা পরাজিতের মনোভাব জাগবে---যা কোনও জনগোষ্ঠীর প্রাণ-সম্পদকে অচিরেই স্তব্ধ করে দেবে৷’’

 স্বাভাবিক ভাবেই এর মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়৷ ক্রমাগত অবদমনের ফলে জনগণ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না৷ তাদের ওপর অবাধে অন্য জনগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ চালিয়ে যাবে, প্রাউট প্রবক্তার ভাষায় তারা মারাত্মকভাবে মানস অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হবে৷

তাই জীবনের সর্বক্ষেত্রে-অফিস, আদালত, রেলওয়ে, বিমানবন্দর, ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারী- বেসরকারী সমস্ত কাজে মাতৃভাষার প্রয়োগ ও মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা লাভের দাবীতে সর্বত্র প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলা উচিত৷ যে কোন জনগোষ্ঠীর বিকাশ ও প্রগতির ক্ষেত্রে এটা অপরিহার্য৷ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের এটাই অত্যাবশ্যক শিক্ষা৷