গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ

লেখক
খগেন চন্দ্র দাস

সর্দার তন্ত্র, রাজতন্ত্র, এক নায়কতন্ত্র, সীমিত গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, ধনিকতন্ত্র, ইত্যাদি নানা তন্ত্রের উত্থান-পতন, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথ পেরিয়ে আধুনিক সমাজ আজকের গণতন্ত্রে পৌঁছেছে৷ আর এটাকেই সর্বশ্রেষ্ঠ শাসন পদ্ধতি বলে মেনে নিয়েছে৷ এই শাসন ব্যবস্থার মূল বাণী---‘‘জনগণের দ্বারা, জনগণের মধ্য থেকে জনগণের জন্য৷ প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রথম দুটি শর্ত কিছুটা গোঁজামিল দিয়ে হলেও মেনে নেওয়া যায়৷ কিন্তু তৃতীয় বিষয় অর্থাৎ ‘জনগণের জন্য’ এই বিষয়টি বরাবরই বহুলাংশে উপেক্ষিতই থেকে যায়৷ একজন জনপ্রতিনিধি জনগণের মধ্য থেকেই নির্বাচিত হবেন এতে দ্বিমত থাকার কোন কারণ নেই৷ বাস্তবেও তাই হচ্ছে৷ কিন্তু  সেই প্রতিনিধির কী ধরণের যোগ্যতা থাকলে তাকে যোগ্য প্রার্থী বলে বিবেচনা করা উচিত তা বিচার করা ক্ষমতা বা যোগ্যতা কোনোটাই জনগণের নেই৷ বহুদলীয় রাজনীতিতে সে ক্ষমতা রয়েছে রাজনৈতিক দলের হাতে৷ আবার প্রার্থী যদি ‘নির্দল’ হন তবে তার যোগ্যতার বিচার করবেন তিনি নিজেই৷ হাস্যকর হলেও এটিই বাস্তব চিত্র৷ তবে একথা  অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে যোগ্যতার বিচারের জন্য নির্বাচন কমিশন একটি মানদণ্ড বেধে দিয়েছেন৷ এই যেমন ধরুন, প্রার্থীদের বয়স, ভারতীয় নাগরিক ইত্যাদি৷ এইসব নিয়মে এতটাই শৈথিল্য রয়েছে যে, লোকসভার সদস্যদের মধ্যে সবসময়ই একটা বিরাট অংশ থাকে যাদের  ক্রিমিনাল রেকর্ড থাকে৷

এতো গেল আইনের চোখে অপরাধীদের কথা, আইনের বাইরেও এমন অনেক অপরাধ থাকে যা সমাজের যা সমাজের  চোখে অপরাধ৷ আর সমাজের চোখে যে অপরাধী তার সেরকম কোন সাজা হয় না৷ সেসব দেখার দায়িত্ব অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের নয়৷ বস্তুত একজন মানুষ যে সমাজে বাস করছেন সেই সমাজ দীর্ঘ সময়ের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে একটি মানুষকে বিচার করে, তার উপর আস্থা রাখে, বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে বুঝে নেয় তিনি কতটা নির্ভরযোগ্য৷ তাঁর নৈতিক মান কতটা উন্নত৷ আদালতে উকিলের কুটতর্ক প্রায়শই বিচারককে বিভ্রান্ত  করে ন্যায় বিচার থেকে তাঁকে সরিয়ে দেয়৷ কিন্তু সমাজের ক্ষেত্রে সেরকম বিভ্রান্তির অবকাশ অনেকটাই কম৷ তাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমরা এ দৃশ্য দেখতে অত্যন্ত অভ্যস্ত যে চুরির দায়ে জেল খাটা আসামী আবারও স্বমহিমায় রাজনীতির মঞ্চ আলো করে বসছেন৷

আর্থিক কেলেঙ্কারি ছাড়াও অপরাধ জগতের দাগী আসামীরাও রাজনীতির মঞ্চে দাপিয়ে বেড়ান৷ কারণ গণতন্ত্রে সংখ্যাই শেষ কথা বলে৷ আর এই সংখ্যা সংগ্রহে বাহুবলের এক বড় ভূমিকা রয়েছে৷ জনগণ এই বাহুবলীদের ভয়ে তার নির্দেশিত চিহ্ণে বোতাম চিহ্ণে বোতাম টিপতে বাধ্য৷ মতাদর্শ, বিগত দিনের কাজের খতিয়ান, আগামীদিনের  কর্মসূচী ইত্যাদি ব্যাখ্যা করে মানুষকে দলের সঙ্গে রাখা সব সময় সম্ভব হয় না, তখন বাহুবলই একমাত্র ভরসা৷

গণতন্ত্রে আর এক নোতুন উৎপাতের নাম, বিনে পয়সায় সবকিছু পাইয়ে দেওয়া, যার গালভরা ইংরেজি নাম Freebies৷ তবে একথাও অনস্বীকার্য যে বন্যা, খরা ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্র্যেগের সময় সরকারের উচিত সবরকম সাহায্য নিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়ানো৷ তা বলে স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষের জীবনধারণের প্রয়োজনীয় সামগ্রী যাতে মানুষ তাঁদের শ্রমের বিনিময়ে সংগ্রহ করতে পারে সে ব্যবস্থা না করে বিনে পয়সায় জোগান দেওয়া কোনোমতেই সমর্থনযোগ্য নয়৷

পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রের আর এক বড় সমস্যা গ্রাম বা এলাকা দখল৷ এমন অদ্ভূত বিষয় ভারতবর্ষের অন্য কোন রাজ্যে আছে বলে শোণা যায় না৷ আর পশ্চিমবঙ্গে বোটের Vote) এই বিচিত্র বিষয়টি কমিউনিষ্টদের আবিষ্কার৷ এরাই বুথ দখল, বুথ জ্যাম, অন্যের নামে বোট দেওয়া, প্রকৃত বোটারকে বুথে আসতে না দেওয়া, সায়েন্টিফিক রিগিং ইত্যাদি আবিষ্কার করেছে৷ এসব বিষয় গণতন্ত্র বা জাতি হিসেবে বাঙালী কারও জন্যেই শুভ সংকেত নয়৷

মহান দার্শনিক ও ‘প্রাউট’ (প্রগতিশীল উপযোগতত্ত্ব) শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর একাধিক প্রবচনে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত গণতন্ত্রের বহুবিধ ত্রুটির কথা উল্লেখ করে গণতন্ত্রকে সর্বশ্রেষ্ঠ শাসন পদ্ধতি হিসেবে স্বীকার করেননি, বরং এটিকে তিনি ‘মন্দের ভাল’ ব্যবস্থা বলে অভিহিত করেছেন৷ একধাপ এগিয়ে তিনি সকলকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন---‘‘...গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ যাদের নেই তাদের বোট vote)-এর মূল্যই বা কতটুকু? আর তাই তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের সেন্টিমেন্ট জাগিয়ে তাদের বোট কিনে নেওয়া বা হাতড়ে নেওয়া কি খুব শক্ত? এধরণের  ক্ষেত্রে কি Democracy) যে কোনো মুহূর্ত্তে Demonocracy) বা দানবতন্ত্রে পরিণত হতে পারে না! (কঃপ্রাঃ ১২-১৪ খণ্ড)

অনুরূপ সতর্কবার্র্ত উচ্চারিত হয়েছে আরও একজন বাঙালী মনীষী ঋষি অরবিন্দ-র মানসপুত্র নলিনীকান্ত গুপ্তর কন্ঠে৷ তিনিও বলেছেন---’’ বর্তমান যুগে সর্বত্রই সাধারণের মহিমা কীর্ত্তন করি, সর্বত্রই দেখিতে চাহি গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা৷ উদ্দেশ্য মহৎ সন্দেহ নাই, ইহা সহৃদয়তার পরিচায়ক৷ কিন্তু এইটুকু বোঝা উচিত যে, মুর্খ, অশিক্ষিত জনসংঘ লইয়া কোন স্থাপন করিতে যাওয়া বালুরাশির উপর হর্ম্য-নির্মাণের চেষ্টা মাত্র৷ প্রকৃত গণতন্ত্র স্থাপন করিবার পূর্বে সাধারণকে যে কতখানি শিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন--- শুধু বিদ্যার দিক দিয়া নহে, ধর্ম নীতি রুচির দিক দিয়া সর্বতোভাবে---একথাটি অনেকে তেমন তলাইয়া দেখেন না৷ এর উচ্চ আদর্শ যে সহজেই বা (ইতরতন্ত্র) এ পরিণত হইতে পারে তাহার জন্য সাবধান হওয়া উচিত৷’’ (নলিনীকান্তগুপ্ত ১মখণ্ড)

সমাধানসূত্র হিসেবে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন---‘‘এ ব্যাপারে প্রাউটের  সদ্‌বিপ্রতন্ত্রই একমাত্র মুশকিল আসান-তবে সদবিপ্রতন্ত্রে প্রতিষ্ঠা হবে অনেক বৈদূষ্যের মস্তিষ্ক চালনার  ফলশ্রুতিতে৷ তা অসির বলে, মসীর বলে বা পেশীর বলে সম্ভব নয়৷ তাই যাঁরা মানব সমাজের মিত্র পুরোধা তাঁদের আজ কর্তব্য হল প্রকৃত সত্যকে মানুষের সামনে তুলে ধরা--- মানুষ যাতে এই গুহায়িত সত্যকে বুঝতে পারে, সেজন্য মানুষের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার করা উচিত দ্রুত---দ্রুততর---দ্রুততম বেগে৷’’ (কঃপ্রাঃ ১২-১৪ খণ্ড)

গণতন্ত্রের প্রকৃত স্বরূপ প্রতিষ্ঠার জন্যই সাধারণ মানুষ এখনও প্রস্তুত নন৷ একথা প্রভাতরঞ্জন সরকার বা নলিনীকান্ত গুপ্ত-র মতো মনীষীগণ বলেছেন তা নয় আরও অনেকেই অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন৷ এইরূপ পরিস্থিতিতে প্রাউটতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনার মান উন্নয়নের পাশাপাশি যাঁরা প্রাউটতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অহোরাত্র চিন্তাভাবনা করছেন, কাজ করছেন তাঁদের যে স্তরে উন্নীত হওয়া প্রয়োজন তারও প্রস্তুতি চলুক৷