‘‘হচ্চ তদ্দিব্যমচিন্ত্যরূপ’’

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

মানুষের বিচারেই  ছোট-বড় তো! মানুষের মনটাই  তো ছোট ৷ সেই মন দিয়ে  সে বিচার  করে৷  সুতরাং গোড়াতেই ভেবে দেখ বিচারের  মাপকাঠি  কী রকম ? নদীর জল মাপতে গেলে  হাত দিয়েও মাপা যায় , যেমন কত হাত জল ইত্যাদি  কিন্তু সমুদ্রের চেয়েও বড়  যদি  কোন  জলাশয় থাকতো  আরও মুশকিল হত৷

যাই হোক্‌ ,  মাপতে যাচ্ছে যে সে হ’ল মানুষ৷  মানুষের মাপার পরিধির মধ্যে যা আছে তা, যদি খুব বড় হয়, সংস্কৃতে আমরা তাকে বলি বিশাল, যেমন, হিমালয় খুবই বড়, কিন্তু তাকেও মাপা যায়৷  আর আমরা বলি ওটা পূর্ব-পশ্চিমে এত মাইল,                             উত্তর-দক্ষিণে এত মাইল৷ কিন্তু মানুষের ছোট্ট মাপকাঠিতে ,  ছোট্ট মনের সাহায্যে, ছোট্ট মাপক যন্ত্রের সাহায্যে  যা মাপা অসম্ভব, মানুষ যাকে মাপতে গিয়ে সব সময় ব্যর্থ হয় ফিরে আসে,  তাকে বলা হয় ‘বৃহৎ’৷ পরমপুরুষকে তাই  বলা হয় ‘বৃহৎ’ কারণ  মাপতে গিয়ে  মানুষের মন ফিরে আসে৷

‘‘যত বাচো নির্বত্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ৷

 আনন্দং ব্রহ্মণো বিদ্বান্‌ ন  বিভেতি কুতশ্চন’’৷৷

মাপতে গিয়ে  মন ফিরে এসে বলে-না ,  মাপতে পারলুম না৷ এমন জিনিসকে বলা হয় ‘বৃহৎ’৷ আবার যে ‘বৃহৎ’ তাও তো  নয়৷  এমনি এমনি একটা  অদ্ভূত জিনিস  যে তার কাছাকাছি যায় সেও বৃহৎ হয়ে যায়৷  আর যে কাছে আছে তাকে নিজের মতো করে, নিজস্ব করে নেয়৷  শুধু যে নিজের কোলে বসিয়ে রাখে তাই নয়, একেবারে এক করে নেয়৷ তার পৃথক সত্তাটা আর থাকে না৷ তাই  তাকে  বলা হয় ‘বিপুলম্‌’৷  বিপুল  হয়েছেন বলেই  ব্রহ্ম৷ তিনি যদি অন্যকে বড় করতে না পারতেন  তাহলে  বৃহৎ বলতুম, কখনো  ব্রহ্ম বলতুম না৷ সুতরাং এখানে একটা মজার কথা হচ্ছে এই, যদি তিনি নিজের নামের মর্যাদা রাখতে চান, তাহলে যিনি তাঁর ধ্যান করবেন, যিনি তাঁর ভাবনা নেবেন, তাঁকেও তিনি বড় করতে, বৃহৎ করতে বাধ্য৷ কারণ, তিনি যদি তা’ না করেন, তাহলে বলব -‘‘ দয়া করে ‘ব্রহ্ম’ নামটি ছেড়ে দাও’’৷

তাঁকে একবার বলছি ‘বৃহৎ’ আবার বলছি দিব্যম্‌৷ দিব্যমানে দিব্যশক্তি যুক্ত৷ দিব্যশক্তি কি? লৌকিক জগতে আমরা যেসব কাজ করি,  সেগুলো যে জড়শক্তি বা ক্রিয়াশক্তির সাহায্যে করি,  ইংরেজীতে তাকে বলে এনার্জি৷  যেমন,  ইলেকট্রিকাল এনার্জি,  মেকানিকাল এনার্র্জি, আরও কত এনার্জি৷ এনার্জিগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এরা জড়শক্তি ৷  এদের পিছনে বুদ্ধির সমর্থন থাকলে  তবেই কাজ হবে,  না হলে হবে না৷ মেঘেতে বিদ্যুৎ তৈরী হয় কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই  বিদ্যুৎটা  ব্যর্থ হয়ে যায় কারণ মানুষের মত  কোনো মনিষাসম্পন্ন  জীব তাকে কাজে লাগাচ্ছে না৷  আর বিভিন্ন বিদ্যুকেন্দ্র  মানুষের সাহায্যে  যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে সেগুলোকে আমরা কাজে লাগাচ্ছি৷ কারণ,  মনীষার সমর্থন রয়েছে , বৌদ্ধিকতার সমর্থন রয়েছে৷ জড়শক্তি তাই  বৌদ্ধিক  শক্তি,  বুদ্ধির সাহায্য না পেলে কিছুই করতে পারে না৷   সেটা একটা অন্ধাশক্তি ৷ 

যাদের এই জড়শক্তি ও দিব্যশক্তির মধ্যেকার  মূলগত পার্থক্য সম্বন্ধে জ্ঞানটাই নেই তারা  হালকাভাবে বলে যে, সবকিছুই ‘‘নেচার’’ থেকে এসেছে৷ কিন্তু তা কী করে হয়? নেচার তো জড় শক্তির দ্বারা প্রেষিত একটা কর্মৈষণা, এর পিছনে কোনো রকম বুদ্ধির সমর্থন  নেই৷ নেচার কিছু করতে পারে না৷  নেচার এই ধরণের একটা সুবিন্যস্ত বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড তৈরী করতে পারে না৷  তার তো কিছুই নেই,  সেতো একটা অন্ধাশক্তি মাত্র,  তার পিছনে রয়েছে দিব্যশক্তি৷ দিব্যশক্তিটা কী?  এই যে মন,  যাকে আমরা বলি চিত্তানুপুঞ্জ  ectoplasm) এই চিত্তাণু থেকে আসছে মন ৷ এই মন জড়শক্তিকে চালাচ্ছে আর এই চিত্তাণুকে যে তৈরী করছে  সে আরও সূক্ষ্মতর সত্তা৷ সেটা হ’ল দিব্যশক্তি  অর্থাৎ  বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের  সব কিছু স্পন্দনের পিছনে রয়েছে যে শক্তিটা তাকেই বলি দিব্য শক্তি Vibrational  force  behind all  vibrating entities)৷

তিনি  যে শুধু হৎ তা-ই  নয়,  তিনি দিব্যশক্তিও৷  আর  এই দিব্যশক্তি অনেক  ক্ষেত্রেই  প্রত্যক্ষভাবে  জড়শক্তিকে চালান, যার ফলে  এই বিশ্বব্রহ্মান্ড তৈরী  হয়েছে,  নিয়ম মেনে  চলেছে৷ নিয়মের  কোথাও এতটুকু গরমিল হবার জো  নেই৷ আবার কোথাও কোথাও মানুষের  দ্ধির  সাহায্যে, দ্ধির  মাধ্যমেও জড়শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করছে৷  মানুষ শহর গড়ছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরী করছে, নানান ধরনের অভিযান চালাচ্ছে--- সবেতেই  মানুষের  মনীষা কাজ করছে৷ আর এই মনুষ্যাকার  জীবের মাধ্যমেই তিনি কাজ করে যাচ্ছেন৷  মানুষ যদি  ভাবে, আমি আমার শক্তিতে মানুষ হয়েই কাজ করছি তাহলে সে ভুল করছে৷ ধর কোন বিরাট পণ্ডিত, তিরিশটা বিষয়ে এম, এ, কিন্তু  হঠাৎ পাগল হয়ে গেল৷ তখন  তার বিদ্যে রইল কোথায়? লোকে তখন তাকে দেখিয়ে  বলবে , হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই লোকটা এককালে বিরাট পণ্ডিত ছিল ঠিকই কিন্তু এখন ‘পাগল’৷ এই তো মানুষের দৌড়৷ সেই জন্যে বলা হয়েছে---

‘‘হচ্চ তদ্দিব্যমচিন্ত্যরূপ সূক্ষ্মাচ্চ তৎ সূক্ষ্মতরং  বিভাতি৷

 দূরাৎ  সুদূরে  তদিহান্তিকে চ চ  পশ্যৎস্বিহৈব নিহিতং গুহায়াম্‌৷৷’’

 মানুষ যার চিন্তা করে তাকেই  বলা হয় ‘চিন্ত্য’ অর্র্থৎ  যে জিনিসটা  সে তার প্রজ্ঞা নাড়ী বা আজ্ঞা নাড়ীর  মাধ্যমে  বাইরের জগৎ থেকে দেখেছিল৷  যে মানুষটা  এককালে  গন্ডার  দেখেছে সেই মনে মনে  গন্ডারের চিন্তা  করতে পারে৷ আর যে কখনও গন্ডার দেখেনি  বা চিড়িখানায় যায়নি, সে মনে মনে গন্ডারকে ভাবতে পারে না৷ মানুষ কোন মৌল বিষয় চিন্তা করতে পারে না৷ বাইরের জগতে এককালে যে জিনিসটা  দেখেছিল তারই সে চিন্তা করে৷ আর যেহেতু পরমপুরুষকে বাইরের জগতে চোখ-কাণের দ্বারা দেখা যায় না, চেনা যায় না--- চোখ কাণের দেখবার শোণবার ক্ষমতাইতো  তিনি যুগিয়ে এসেছেন--- তাহলে  চোখ-কাণ দিয়ে তাঁকে  কী করে জানা যাবে  ! সুতরাং  তিনি ‘অচিন্ত্য’ আর অচিন্ত্য থেকেই যাবেন কারণ  বাইরের জগতের  কিছু দেখে চিন্তা করার সুযোগটা  তো সে পাচ্ছে না৷ সুতরাং তাঁকে বলতে হবে, ‘‘তুমি কেমনটি  তা  তো আমি জানি না, তবে তুমি যেমনটি তেমনটি তোমাকেই  প্রণাম  করছি৷’’

পরমপুরুষ বরাবরই  মানুষের  চিন্তার বাইরেই  থেকে গেছেন৷ ভক্তরা ভীসণ দ্ধিমান হয় আর জ্ঞানীরা হয় বোকা৷ কারো  বোকামির  সবচেয়ে  বড় নিদর্শন  হ’ল পৃথিবীতে  সে নিজেকে  জ্ঞানী মনে করে৷  জ্ঞানীরা নিজেকে জ্ঞানী মনে করে,  তাই তারাই হ’ল বড় বোকা, জীবনযুদ্ধে তারা  সব সময়েই  হেরে  যায়৷ আর ভক্তরা তো তা নয়৷  ভক্তরা সত্যিকারের  যা জানবার তা-ই জানে৷ জ্ঞানীরা বলে,  কেন তিনি অচিন্ত্য  হয়েছেন?  সত্যিই তো তিনি ভীষণ  ভালবাসেন, আর  ভালবাসেন বলেই তো তিনি মানুষকে এত মনীষা, এত বৈদুষ্য, এত বৈদগ্দ্য দিয়েছেন৷ এর থেকে  ভালবাসার  প্রমাণ আর  কী  পাওয়া যেতে পারে!  মানুষকে  তিনি এত এগিয়ে  নিয়ে গেছেন, তবুও  মানুষের  কাছে তিনি অচিন্ত্য কেন থেকেছেন? ভক্তরা  বলে, কারণটা হচ্ছে  এই যে  তিনি যদি  চিন্তার মধ্যে আসতেন  তাহলে  সব মানুষই তাঁকে  জড়িয়ে  ধরলেই  তো সব ফুরিয়ে  যেত৷  আর তো  পাওয়ার ইচ্ছা থাকত না৷  অচিন্ত্য থাকলে  লাভটা  হবে এই যে সব সময়  তাঁকে  পাওয়ার একটা ইচ্ছা থাকবে৷ এই পাওয়ার  ইচ্ছাটাই  মানুষকে  ক্রমশঃ মহান  থেকে অধিকতর  মহান করে দেয়, মহৎ থেকে অধিকতর মহৎ  করে দেয়৷ তাই  কবি বলেছেন---

অনন্ত হয়েছ, ভালই  করেছ,

থেকো চিরকাল অনন্ত অপার

ধরা যদি দিতে ফুরাইয়া যেতে,

তোমারে ধরিতে কে চাহিত আর ?

(১ নবেম্বর ১৯৭৮, কলিকাতা, সকালবেলা)